:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেট কারে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আজ সোমবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর গার্ডারটি পড়ে। এর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর গাড়িটির ওপর থেকে গার্ডারটি সরান উদ্ধারকর্মীরা। এরপর প্রাইভেট কারের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পাওয়া যায়।
লাশগুলো উদ্ধারের পর রাত পৌনে আটটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সাইফুজ্জামান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন পুরুষ, দুজন নারী ও দুটি শিশু রয়েছে। তাঁদের সবার লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকায় একটি বউভাতের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন হতাহত ব্যক্তিরা। ঘটনার পরপরই দুজনকে আহত অবস্থায় প্রাইভেট কার থেকে বের করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তখন গার্ডারের নিচে চাপা পড়া গাড়িটির ভেতরে পাঁচজন ছিলেন। তাঁদের কয়েকজনকে বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল।
ক্রেন দিয়ে গার্ডারটি সরানোর পর প্রাইভেট কারের এক পাশ কেটে ভেতর থেকে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে বিকেলে এ দুর্ঘটনার পর উৎসুক জনতা সেখানে ভিড় করে। তাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ঘটনাস্থলে যেতে বেগ পেতে হয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্বজনেরা জানান, শনিবার (২৫) ও রিয়া মনির (২১) বিয়ে হয়। তারা সোমবার ছেলের বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন। হৃদয়ের পরিবার দক্ষিণখান থানার কাওলা আফিল মেম্বারের বাড়ির ভাড়াটিয়া। আর কনে রিয়া মনির বাড়ি আশুলিয়ার খেজুরবাগানে আসরাফউদ্দিন চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায়।
সোমবার স্বজনেরা নবদম্পতিকে নিয়ে কনের বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড় সংলগ্ন সড়কে বিআরটির প্রকল্পের গার্ডার পড়ে তাদের প্রাইভেটকারের ওপর। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন পাঁচজন।
গাড়িটি চালাচ্ছিল হৃদয়ের বাবা রুবেল। হৃদয়, হৃদয়ের বাবা রুবেল, রিয়া ছাড়াও প্রাইভেটকারটিতে কনে রিয়ার একজন আত্মীয় ও ২ শিশু ছিল।
হৃদয়ের চাচাতো ভাই রাকিব (১৯) বলেন, বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তারা দুর্ঘটনার খবর পান। কিন্তু এতো সময় পরও গাড়ি থেকে মরদেহগুলো বের করতে পারেননি উদ্ধারকারীরা। ভেতরে যদি কেউ বেঁচে থেকেও থাকেন তাহলে এতোক্ষণে মারা গেছেন।
রাকিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার কীভাবে এভাবে অব্যবস্থাপনার মধ্যে কাজ করছে? আমরা কার কাছে বিচার দিব! আমাদের অন্তত লাশগুলো বের করে দিক। কিন্তু এখানে তো কোনো উন্নত যন্ত্রপাতি নেই।’
এদিকে দুর্ঘটনার তিন ঘণ্টা পর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া প্রাইভেটকারের ওপর থেকে সরানো হলো গার্ডার। সোমবার সন্ধ্যা ৭টার পর গার্ডার সরিয়ে লাশগুলো বের করে দুটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহগুলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
প্রাইভেটকারে আরোহী ছিলেন সাত জন। ছিলেন নববিবাহিত হৃদয়ের বাবা রুবেল (৬০), হৃদয়ের শাশুড়ি ফাহিমা (৪০), কনে রিয়া মনির খালা ঝরনা (২৮), ঝরনার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)। ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। শুধু বেঁচে আছেন হৃদয় ও রিয়া। তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
যেভাবে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা
উড়ালসড়কের একটি বক্সগার্ডার তুলবেন নির্মাণকর্মীরা। বরাবরের মতোই চেষ্টা। কিন্তু যে ক্রেনটি দিয়ে তুলবেন, সেটি হঠাৎ ব্যর্থ। গার্ডারটি ধরে রাখতে না পেরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। উল্টো দিকে ঘুরে কাত হয়ে যায় ক্রেনটি। এতে চলতিপথের একটি প্রাইভেট কারের উপরে পড়ে যায় বিশালাকৃতির গার্ডারটি। এ ঘটনায় পাঁচজনের মরদেহ করেছেন নিরাপত্তাকর্মীরা।
সোমবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে রাজধানীর জসিমউদ্দীন এলাকার প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনের সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আরেকটি ক্রেন এনে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে বিআরটি প্রকল্পের উড়ালসড়কের গার্ডারটি সরিয়ে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ভয়াবহ এ ঘটনার পর ক্রেনের অপারেটরসহ দায়িত্বরতরা পালিয়ে যান। এজন্য ওই সময় ঠিক কী ঘটেছিল তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির’ কারণে ক্রেনটি ভারসাম্য হারিয়ে কাত হয়ে যায় এবং তখনই এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।
অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিআরটি প্রকল্পে উত্তরা উড়ালসড়ক হচ্ছে চলমান সড়কের মাঝ বরাবর। প্রাইভেট কারটি যাচ্ছিল রাস্তার একপাশ দিয়ে। গার্ডার তোলার সময় এক পাশে কাত হয়ে যায় সেটি। তখন গার্ডারটি একপাশে কাত হয়ে প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে।
তখন পেছনে একটি মাইক্রোবাসসহ আরও কয়েকটি গাড়ি ছিল। সেগুলো থেমে যাওয়ায় রক্ষা হয়। দুর্ঘটনার পর পুরো এলাকায় যানজট দেখা দিলে বিমানবন্দর সড়কে যাতায়াতকারীরা ভোগান্তিতে পড়েন।
ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বলেন, দুর্ঘটনার সময় ক্রেনটি ঘুরে ঠিক উল্টো দিকে প্রাইভেট কারের ওপর আছড়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, স্লিপ কেটে ভারসাম্য হারিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে গেছে এটি।
বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণে ক্রেনটি একদিকে হেলে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ক্রেন দিয়ে আরও গার্ডার তোলা হয়েছে। তার মানে গার্ডারের ওজন তোলার ক্ষমতা ওই ক্রেনের আছে। কোনো কারিগরি ভুলের কারণে ক্রেনটা কাত হয়েছে। ক্রেনটা চলে চেইনের ওপর, চেইন থেকে স্লিপ করতে পারে।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, বক্সগার্ডার তোলার সময় ভারসাম্য রাখতে না পারায় বহনকারী ক্রেন একদিকে কাত হয়ে যায় বলে তারা শুনেছেন। তখন গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর পড়লে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।