:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষকের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়েছেন কলেজের এক শিক্ষার্থী। ঘটনার পর রায়হান শরিফ নামের এই শিক্ষককে আটক করেছে পুলিশ।
গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমাল বর্তমানে ওই শিক্ষার্থী শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার চেয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা।
কলেজের শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছে শিক্ষার্থীরা। তিনি কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক।
শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আমিরুল হোসেন জানিয়েছেন, ওই শিক্ষক মাঝে মধ্যেই অস্ত্র প্রদর্শন করে ক্যাম্পাসে আসতেন। যতটুকু জেনেছি, আজ তিনি অসময়ে তার ক্লাস নিতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস করতে অপারগতা জানায়। এই নিয়ে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে ওই শিক্ষক তার পায়ে গুলি করেন। কলেজ শিক্ষার্থীরা জানায়, ডা. রায়হান শরিফ বিভিন্ন সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কুপ্রস্তাব ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসতো। এ বিষয়ে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ক্লাস চলাকালে সময় ছাড়াও প্রায় সময় তিনি পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করতেন।
এদিন বিকেলে ক্লাস চলাকালে দেশীয় পিস্তল ও ১০ থেকে ১৩টা দেশীয় ধারালো চাকু নিয়ে হঠাৎ করে ক্লাসের সময় শিক্ষক অষ্টম ব্যাচের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করে। তার চিৎকারে সবাই এগিয়ে এসে ডা. রায়হান শরিফকে আটক করে তালাবদ্ধ করে রাখে। আহত অবস্থায় তমালকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে।
সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওই শিক্ষকের বিচার চেয়ে মেডিকেলের ছাত্রছাত্রী আন্দোলন করছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আজ ভাইভা চলাকালীন ৪৫ জন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে শিক্ষক রায়হান শরিফ তমালের ডান পেয়ে গুলি করেন। ওই শিক্ষকের শাস্তি দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেয়। পরে তমালকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জুলহাজ উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, ওই শিক্ষক প্রতিদিন ক্লাসে পিস্তল নিয়ে আসতেন। আজ বিকেল ৫টার দিকে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষক রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গুলি ছোড়ে। এ সময় গুলিতে আহত হন শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন। এ ঘটনার পর ওই শিক্ষককে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তিনি টেবিলে পিস্তল রেখে ক্লাস নিতেন বলে জানিয়েছেন মেডিকেল কলেজটির শিক্ষার্থীরা।
রায়হান শরীফের বাবা আব্দুর রাজ্জাক সিরাজগঞ্জ ইসলামিয়া সরকারি কলেজ ও সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের শিমলা গ্রামে। বর্তমানে রায়হান শরীফ পরিবার নিয়ে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের পাশের একটি ভবনে বসবাস করেন।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষক রায়হান শরীফের বাবা আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন আহমেদ শুভ বলেন, ‘ওই শিক্ষক সব সময় গরম দেখাতেন। অস্ত্র নিয়ে ক্লাসে আসতেন। শিক্ষার্থীরা ভয়ে কিছু বলতে পারত না। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষা অবগত করেছি। তারপরও কিছু হয়নি। শিক্ষক বলেন, আমি মেডিকেল কলেজে লেখাপড়ার সময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি। সকালে তিনি ভাইভা ক্লাসে আসেন। এসে আমাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, পরীক্ষার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে গুলি করে মারা হবে। তখন শিক্ষার্থীরা সবাই ভয় পেয়ে যায়। আমরা প্রতিবাদ করলে তিনি গুলি ছুড়ে মারেন এবং গুলিতে তমাল আহত হয়।’
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রওনক জাহান রিজা বলেন, ‘কোনো কারণ নেই। তিনি যখন ক্লাস নিতে আসেন প্রথমেই ব্যাগ থেকে পিস্তল ও ধারালো ছুরি বের করে টেবিলের ওপর রাখতেন। তারপর পিস্তলে গুলি লোড করে আমাদের দিকে তাক করে রাখেন। এমনটাই তিনি সব সময় করে থাকেন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি ক্লাস করার জন্য ডেকেছিলেন আমাদের। সন্ধ্যায় তো ক্লাস থাকার কথা না। কারণ ক্লাস সিডিউল দুপুর ৩টা পর্যন্ত। তাঁর ক্লাসে না যাওয়ার কারণে তিনি আমাদের ফোন করেন। তোরা কেন ফোন কল ব্যাক করিসনি। আজ তোদের বুঝিয়ে দেব। একটা প্রশ্নের উত্তর পারবি না তো গুলি করে মেরে ফেলব। এই বলে গুলি করেন।’
কলেজের আরেক শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, ‘আমাদের ভয় দেখানোর জন্য তিনি পিস্তল নিয়ে ক্লাসে আসতেন। কলেজে যখন থেকে ভর্তি হয়েছি তখন থেকে দেখতাম তিনি ক্লাসরুমে পিস্তল নিয়ে ঢুকতেন এবং টিবিলের ওপর পিস্তল ও গুলি রেখে দিতেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রীদের তিনি কুপ্রস্তাব দিতেন। ছাত্রীদের মোবাইলে মেসেজ দিতেন তাঁর কাছে আসার জন্য।’
কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. আব্দুল্লাহ হেল কাফিও বলেন, রায়হান শরীফ অস্ত্র নিয়ে কলেজে আসতেন। তিনি বলেন, ‘এটা সবাই জানে। মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে বিষয়টি জানালেও কোনো সুরাহা হয়নি। অধ্যক্ষ ওপরের মহলকেও বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. হান্নান বলেন, শিক্ষকের ব্যবহৃত অস্ত্রটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। অস্ত্রের কাগজপত্র না থাকলে অস্ত্র আইনে মামলা হবে।
সিরাজগঞ্জ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলহাজ উদ্দিন জানান, মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ শিক্ষকের কাছ থেকে পিস্তলটি জব্দ করা হয়েছে। এটি ৭ দশমিক ৬ এমএম মডেলের পিস্তল বলে জানান তিনি।
‘স্যার রাতে কল দিয়ে তাঁর কাছে যেতে বলতেন‘
সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ ছাত্রীদের ‘সেক্সচুয়াল হ্যারেজমেন্ট’ করতেন বলে অভিযোগ ছাত্রীদের। তাঁরা বলেন, স্যার রাতে ভিডিও কল দিতেন এবং তাঁর কাছে যেতে বলতেন। আজ সোমবার দুপুরে ছাত্রীরা এই অভিযোগ করেন। তাঁরা শিক্ষক রায়হান শরীফের বহিষ্কার দাবি করেন।
ছাত্রীরা বলেন, ‘রাত নাই, দিন নাই স্যার আমাদের হ্যারেজমেন্ট করে আসছেন। পরীক্ষার রুমে গেলে তিনি বিভিন্ন প্রকার অঙ্গভঙ্গি করেন। আমাদের হ্যারেজমেন্ট করার চেষ্টা করেন। গায়ে হাত দেন। রাত ১২টা-১টায় কল দেন আমাদের। ভিডিও কল দিয়ে তাঁর কাছে যেতে বলেন। রাত ৩টার দিকে ম্যাসেজ দিয়ে বলেন খবর আছে। তোদের দেখে নেব। শিক্ষক রায়হান শরীফ আমাদের তিন মাস ধরে জ্বালিয়ে আসছেন। আমরা অন্য স্যারকে বিষয়টি জানিয়েছি।’
মেডিকেল কলেজের ছাত্রী আফিয়া বলেন, ‘রাত নাই, দিন নাই স্যার আমাদের হ্যারেজমেন্ট করতেন। রাত ৩টার সময় ভিডিও কল দিতেন। তাঁর ভয়ে কেউ কথা বলতে পারত না। এই কলেজ থেকে তাঁর অপসারণ চাই। তিনি থাকলে কলেজের পরিবেশ নষ্ট হবে।’
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রওনক জাহান রিজা বলেন, ‘কথায় কথায় পিস্তল তাক করতেন আমাদের দিকে। সঙ্গে ধারালো অস্ত্রও নিয়ে আসতেন। প্রায় প্রতিটি ছাত্রীকে তিনি হ্যারেজমেন্ট করে আসছিলেন। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সবাই প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। তাঁকে এই কলেজ থেকে অপসারণ করতে হবে।’
সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে গুলি করার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আজ সোমবার এই কমিটি গঠন করা হয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন মাতুব্বর ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মোহসিন উদ্দন।
মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব দূররে শাহনেওয়াজের সই করা এক অফিস আদেশে বলা হয়েছে, আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে তারা সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবেন। যথাসময়ে তদন্ত সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন।’