:: আবু রুশদ ::
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনীতি ও সরকার পরিচালনা ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকার বিষয় সবার জানা। যা জানা নেই তা হলো তারা কিভাবে বছরের পর বছর ধরে পুরো জাতিকে পর্দার আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রন করছেন। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শই তাদের গোপন কর্মকান্ড প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, কখনো কখনো প্রেসিডেন্টেরও জানার উপায় থাকে না!
যেসব জেনারেলরা পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটনে, সবার অজান্তে যুদ্ধ শুরু করায় ও সরকার ব্যবস্থা পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেনারেল আজিজ খান। কাশ্মীরি বংশোদ্ভুত চার তারকা এই জেনারেল ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে সরিয়ে জে. জিয়াউদ্দিন বাটকে সেনাপ্রধান নিয়োগের প্রচেষ্টা বানচাল করে দেন। ব্যাপক জনপ্রিয় ও নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেদিন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সে সময় জে.আজিজ খান ছিলেন পিন্ডির জিএইচকিউ’র সিজিএস-চীফ অফ জেনারেল স্টাফ।
এরও আগে ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী,প্রতিরক্ষা মন্ত্রীসহ পুরো সরকারকে না জানিয়ে পাক সেনাবাহিনী অকস্মাৎ কারগিল যুদ্ধ শুরু করে ভারতের বিরুদ্ধে। সেসময় সেনাপ্রধান জে.মোশাররফ ছিলেন বেইজিং সফরে। সেখান থেকে তিনি স্যাটেলাইট ফোনে সিজিএস লে.জে.আজিজ খানকে কারগিল অপারেশন শুরু করতে নির্দেশ দেন। নওয়াজ শরীফ এসবের কিছুই জানতেন না। এই ঘটনায় ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী হতভম্ব হয়ে পরেন। কারন তার কিছু দিন আগেই নওয়াজ তাকে পাকিস্তানে ওয়ার্মলি রিসিভ করেন। নওয়াজও দিল্লী ঘুরে এসেছিলেন। দুইদেশের মধ্যে তখন কাশ্মীর নিয়ে মোটামুটি একটা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কারগিল নিয়ে নওয়াজ শরীফের কাছে জানতে চাইলে পাক প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পরেন। সে সময় দুই দেশ পূর্ণ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়ায়। এই কারগিল অপারেশনের মূল পরিকল্পনাকারি তিন জন অফিসারের একজন ছিলেন লে.জে.আজিজ খান।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালে তাকে চার তারকা জেনারেল বানিয়ে জয়েন্ট চীফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। অবসরে যান ২০০৫ সালে।
যাহোক, ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে তাঁর সাথে দেখা হয় ইসলামাবাদ ক্লাবে। তিনি সেখানে বাংলাদেশ থেকে সফরে যাওয়া দলের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। আই এস পি আর-এর অনুষ্ঠান থাকার পরও ডিজি মেজর জেনারেল শওকত সুলতান সম্মান দেখিয়ে জেনারেল আজিজ খানকে আমাদের হাতে শুভেচ্ছা উপহার তুলে দিতে বলেন। ওই অনুষ্ঠানেই ঠিক হয় তার বাসায় আমাদের দুপুরের খাবার খেতে যেতে হবে।
পিন্ডির ডিওএইচএসে জেনারেল আজিজ খানের বাসা। দোতলা। সামনে নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে দিয়ে তৈরি করা লন, গাড়ি বারান্দা। ওখানে কোন বাসায় দোতলার উপরে তৈরি নিষেধ। যাদের বাড়ি তারাই কেবল থাকেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের যে ডিগিনিটি কিন্তু বিলাসহীন সাদাসিধে জীবন কাটানোর কথা জেনারেল আজিজ খান তাই উপভোগ করছেন। দীর্ঘ সামরিক জীবনের পর সঙ্গতকারনেই তিনি অবসরে প্রকৃত অবসর কাটাচ্ছেন। কোন চাকুরি বা ব্যবসায় জড়িত হননি।
ওনার বাসায় বেশ ক’জন অতিথি দাওয়াত দেয়া হয়েছিল আমরা ছাড়া। ফেরদৌসী মজুমদারের বড় ভাই কর্নেল কাইয়ুম, অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালি মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, কর্নেল কামাল, বাংলাদেশের হাইকমিশনারসহ আরো কয়েকজন। তবে পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ঘরোয়া।আমাদের আপ্যায়ন করার জন্য জেনারেল আজিজ খান ইসলামাবাদে থাকা তার মেয়েকে ডেকে এনেছেন। তার স্ত্রী ও মেয়ে মিলে রান্না করেছেন। খাবার টেবিলে তারাই তদারকি করলেন। একটি ব্যাটম্যান গোছের যুবককে শুধু এক্সট্রা দেখলাম।
লিভিং রুমে যখন সবাই আড্ডায় ব্যস্ত তখন জেনারেল আজিজ খানকে অনুরোধ করলাম তার সাথে দুয়েকটি ‘ অফ দ্যা হুক’ আলোচনা করার জন্য। তিনি বললেন-চলো বাইরে যাই, এখানে কথা বলা যাবে না।
গাড়ি বারান্দার পাশে লনে দাড়িয়ে প্রথমে তার সাথে একটা ছবি তুললাম। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম-স্যার, জনাব মিয়া নওয়াজ শরীফ তো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করছিলেন রাষ্ট্রীয় পর্য়ায়ে। সেসময় আপনার হুট করে তাকে না জানিয়ে কারগিল যুদ্ধ শুরু করলেন কেন?
সব তো তোমাকে বলা যাবে না, এছাড়া জেনারেল মোশাররফ এখনও ক্ষমতায়। আমি কেবল রিটায়ার করেছি। তবে এটুকু বলতে পারি সব অপারেশনের কথা সবাইকে জানানোর দরকার নেই। তাতে গোপনীয়তা থাকে না, সারপ্রাইজ থাকে না। আমরা ভারতকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
বুঝলাম, এর চেয়ে বেশি কিছু জানা সম্ভব নয়! তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। জানতে চাইলাম কেন জেনারেল জিয়াউদ্দিন বাটকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার পরও তিনি সিজিএস হিসাবে তা ঠেকিয়ে দেন? সেনাপ্রধান নিয়োগের এক্তিয়ার তো প্রধানমন্ত্রীর। ওটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল?
মুচকি হেসে তিনি শুধু বললেন- আমাদের সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফ তখন শ্রীলংকা সফরে ছিলেন। তাকে অবহিত না করে ওভাবে অপমান করা কোন অফিসার ও সৈনিকের পক্ষে হজম করা সম্ভব ছিল না। আমরা আমাদের সেনা প্রধানদের মর্য়াদাকে সমুন্নত রাখি। ওইদিনও রেখেছিলাম। সিজিএস হিসাবে আমার যা দায়িত্ব সেটা আমি সেসময় পালন করেছি মাত্র।
কথা আরো কিছু হয়েছিল। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর সময় অনেক কিছুই করতে হয়। দেশে বিদেশে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলোয় যোগাযোগ করতে হয়। তিনি এনিয়ে মজার কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। তবে তা তার অনুরোধে বলতে মানা।
নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর মর্য়াদা বেশি না সেনাপ্রধানের তা নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই! বিশেষ করে সেই দেশটি যদি হয় পাকিস্তান। তবে একটা কথা না মানলেই নয় যে তাদের সেনাবাহিনী কখনো কোন দলের পদলেহন করে না।পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাব প্রায় শূন্য।চাকুরিরত কোন কর্মকর্তা সরকারি দলসহ কোন রাজনৈতিক দলের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না।
ওহ! তিনি আমাকে চমৎকার একটা ট্রাডিশনাল দামী কাবুলি সেট উপহার দিয়েছিলেন যা এখনো আছে।
পুনশ্চঃ সাম্প্রতিক ঘটনার সাথে অবশ্য আগের ঘটনাগুলোর অমিল অনেক। তা নিয়ে এখন লিখবো না। জজবা ও আবেগ যাক, তারপর দেখা যাবে…
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের প্রধান সম্পাাদক