:: শেহাজ সিন্ধু ::
সপ্তাহ পেরোয়নি নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছি। কেন যেন বাড়ির দারোয়ান আমাকে দেখতে পারে না।
তাকে বললাম, আকবর, আমাদের পার্কিংয়ের জায়গায় প্রায়ই অন্যেরা গাড়ি রেখে যায়। খুব সমস্যা হয়। এরপর থেকে কাউকে এমন করতে দেখলে নিষেধ করে দেবেন। বললো, আমার কথা হুনবো ক্যান? আমি কি বিল্ডিংয়ের মালিক নি?
বিগড়ানো মেজাজ সামলে নিলাম। ব্যাটাকে চটানো ঠিক হবে না। এপার্টমেন্ট কমিটি নিয়ম করেছে, রাত সাড়ে এগারোটায় মূল ফটক বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার বায়িং হাউজের কাজ। ব্যবসার কারণেই অনেক সময় দেরি হতে পারে। ব্যাটা হাতে না থাকলে বিপদ। বললাম, আরে গ্রাউন্ড ফ্লোর আর বেইজমেন্টের মালিকতো আপনিই। আপনার অনুমতি ছাড়া কেউ বিল্ডিংয়ে ঢুকতে পারে?
আকবর ঘুরে, লিফট অপারেটিংয়ের কাজে থাকা পিচ্চিকে বললো, ঐ চান্দু, যা আইজ থিকা তোর চাকরি নট। চান্দু মুখ ভেঙচে বললো, যা পিক! ‘যা পিক’ মানে খুব সম্ভবত ‘যা ভাগ’ টাইপ কিছু। কারণ চান্দু ওটা বলার সময় আঙুল তুলে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে। তার নিশ্চয়ই আকবরের কাছে আমার মতো ঠ্যাকা নাই।
আকবর আমাকে পুরো উপেক্ষা করে আরেকদিকে চলে গেলো। যেতে যেতে গজগজ করছে শুনলাম, হাহ, আমি হইলাম মালিক, ঘন্টা!
চরম অপমান। রাগে মাথা ভনভন করছে। কমিটির কাছে অভিযোগ জানাবো। কিন্তু লোকটা আমাকে এতো অপছন্দ করে কেন? আমার মার্জিত ব্যবহার, ভদ্র চেহারার কারণে সাধারণত মানুষ আমাকে সহজেই পছন্দ করে। এটা আমি জানি। কিন্তু এই ব্যাটা আমাকে দুই চক্ষে দেখতে পারে না!
। ২।
সাত সকালে অফিসে যাই, রাতে ফিরি, সাড়ে এগারোটার মধ্যেই। কমিটির কাছে অভিযোগ করা হয়ে ওঠেনি। আসা-যাওয়ার পথে আকবরের দিকে তাকাইনা। তারপরও বুঝি, আমাকে দেখলেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। আমি গাড়ির হর্ন দিলে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে, বেশি শব্দ করে গেইট খুলে দেয়। অনুভব করতে পারি, এসময় যতোটা সম্ভব আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে! আমি তার চোখ এড়াতে মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে থাকি।
একদিন রাত করে ফিরছি, সাড়ে এগারোটা বাজতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি। গাড়িটা বাসার গলিতে ঢুকতেই অন্ধকার একটা জায়গায় চার পাঁচ জন যুবক পথরোধ করলো। বুঝলাম, ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে যাচ্ছি।
অভিজাত এলাকায় শুনশান নিরবতা। তারা আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে থামার নির্দেশ দিলো। এই গলির মধ্যে তাদের উপর গাড়ি চালিয়ে পালানোর উপায় নাই। আর সুযোগ থাকলেও জ্বলজ্যান্ত মানুষকে জেনেবুঝে গাড়ি চাপা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
আমাকে একরকম টেনেহিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামালো তারা। ওই …টুট টুট …যা আছে …টুট টুট …বাইর কর …টুট টুট … যদিও, যা আছে বের করে দেয়ার সুযোগ না দিয়ে, অশ্রাব্য গালিতে কান গরম করে দিলো এক ষণ্ডা। তারচেয়েও ভয়ংকর একজন হাত-পা ঠান্ডা করা চাপা গলায় সঙ্গীকে বললো, আওয়াজ কম কর, কল্লা ফালা আগে। ঝামেলা রাখিস না, দ্রুত কাম সাইরা ফুটতে হইবো।
গাড়িতে লাখ দুয়েক টাকা আছে। মোবাইল, ঘড়িসহ দামি যা আছে দ্রুত সব বের করে দিতে চাইলাম। মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে, ঘ্যাঁচ করে পেটে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিলো কেউ। সন্তান, বৌ, মা, বাবা একটা একটা প্রিয় মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। এতো কাছে থেকেও তাদের একবার দেখে যেতে পারবো না।
দেখলাম আকবরকে। দুই বিল্ডিং পরেই আমাদের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চিনতে পেরেই লাঠি বাগিয়ে ভয়াবহ হুংকার দি্তে দিতে তেড়ে এলো সে। তখনই টহল পুলিশের একটা দল গলির মুখ পেরোচ্ছিল। কীভাবে যেন অপরাধ সংঘটনের মুহূর্তে তারা হাজির! বিপুল আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেলো হাইজ্যাকাররা। আমাকে ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও সব কয়টা ধরা পড়লো।
আমার জখমটা আসলে খুব মারাত্মক কিছু না। বাসায় ফোনে জানালাম ফিরতে দেরি হবে। পুলিশী হেফাজতে চিকিৎসা নিয়ে, থানার পাট চুকিয়ে ফিরলাম অনেক রাতে।
আকবর জেগে আছে। গেইট খুলে দিলো। আজও আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। সর্বাঙ্গে শ্বেতী রোগের কারণে যার দিকে সরাসরি তাকাতে পারতাম না, আজ তার স্পর্শেও কোনো অস্বস্তি হলো না।
বুঝতে পারছি শ্বেতী রোগের কারণে শুরু থেকেই আকবরকে আমি অবচেতনে ঘৃণা করেছি, এড়িয়ে গেছি। সে আমাকে অপাংক্তেয় নয়, আমিই তাকে অপাংক্তেয় ভেবেছি। এজন্যই আমার উপর তার রাগ জমেছিল। আজ সেই রাগ পানি হয়ে আকবরের চোখে। ভেসে যায় তার সমস্ত অভিমান। মায়া মমতায় ভেজা মুখটা পবিত্র হয়ে ওঠে।
লেখক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক