:: হাবিবুর রহমান ::
লিমিটেশন আইনের নীতি হচ্ছে — limitation bars the remedy, not the right. যেমন: আমার কাছে কেউ যদি এক লক্ষ টাকা পায় এবং আমি তাকে পহেলা জানুয়ারি ২০২৩ টাকা পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেই, তাহলে ওইদিন টাকা পরিশোধ করতে না পারলে সে পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি ২০২৬ এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে টাকা আদায় করে নিতে পারবে। কিন্তু ওই তিন বছর পার হয়ে গেলে সে এই টাকা উদ্ধারের জন্য মামলা করতে পারবে না। অর্থাৎ এখন আর তার প্রতিকার নাই। কিন্তু আমি যদি তাকে তিনবছর পরে টাকা দিয়ে দেই তাহলে সে টাকা নিতে পারবে। এখন যদি আমার মনে হয়, ও তো আইনি প্রক্রিয়ায় টাকা ফেরত নিতে পারত না, ওর তো এটা পাওয়ার অধিকার শেষ হয়ে গেছে, তাই আমি যে ফেরত দিয়েছি ওইটা আবার ফেরত নিতে চাই — এটা করা যাবে না। কারণ, তার প্রতিকার শেষ হয়ে গেলেও অধিকার রয়ে গেছে।
এখনকার আইনে ১২ বছর দখলে থাকলে সরাসরি কেউ মালিক হয়ে যায় না। যেটা হয় তা হচ্ছে, প্রথমে আসল মালিক তার দখল পুনরুদ্ধারের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা করতে না পারলে তার পক্ষে আইনগত প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকে না ( সেকশন ২৮, লিমিটেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮)। আবার কোনো জমি কেউ দখলে থাকলে ( ন্যায্যভাবে৷ বা অন্যায়ভাবে যেভাবেই হোক না কেন) তাকে দখলচ্যুত করার একমাত্র উপায় সিভিল কোর্ট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এর ডিক্রি বা অর্ডার। এই প্রক্রিয়া ছাড়া একজন প্রকৃত মালিকও কোনো জবরদখলকারীকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারে না। এর কারণ হচ্ছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। সবাই যদি নিজেকে আসল মালিক দাবী করে দখলদারকে উচ্ছেদ করতে শুরু করে তাহলে চারদিকে গণ্ডগোল শুরু হয়ে যাবে।
সম্পত্তির আইনে দখলদারকে ৯০% মালিক মনে করা হয়। কোনো সম্পত্তি কারো দখলে থাকলে আইন ধরে নেয় সেই দখলদার ব্যক্তি উক্ত সম্পত্তির মালিক। কেউ যদি নিজেকে বা অন্য কাউকে মালিক দাবী করে তাহলে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব সেই ব্যক্তির ( এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২ এর সেকশন ১১০)।
সম্পত্তি আইনের আরেকটা নীতি হচ্ছে, কারো মালিকানা চিরদিন অনিশ্চিত থাকতে পারে না। একটা সময় পরে এই মালিকানা নিরঙ্কুশ হতে হবে। তা না হলে, ৩০-৪০-৫০ বছর ভোগদখল করার পরে হঠাৎ কেউ এসে জমির মালিকানা দাবী করে বসবে। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কেউ শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করতে পারবে না। আইন ঠিক করেছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষেত্রে এই সময়টা ১২ বছর।
কোনো জমি বেদখল হলে দখল পুনরুদ্ধার করার সহজ তিনটা উপায় আছে।
এক. বেদখল হওয়ার দুই মাসের মধ্যে সিআরপিসির সেকশন ১৪৫ এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পিটিশন করা। এছাড়াও কাউকে জোরপূর্বক বেদখল করা হলে সিআরপিসির ৫২২ ধারায় দখল পুনরুদ্ধার করা যায়।
দুই. এস আর অ্যাক্টের সেকশন ৯ এ মামলা করা। এটা করতে হয় ছয় মাসের মধ্যে ( তামাদি আইন, ১৯০৮ এর প্রথম তফসিল এর ৩ অনুচ্ছেদ)। শুধুমাত্র দখল ছিল কিন্তু জোরপূর্বক বেদখল করা হয়েছে প্রমাণ করতে পারলেই দখল পুনরুদ্ধার করা যাবে।
তিন. এস আর আইনের সেকশন ৮ অনুসারে সিপিসির প্রসিডিওর অনুসরণ করে ইজেক্টমেন্টের স্যুট। এটা করতে হয় ১২ বছরের মধ্যে (তামাদি আইন, ১৯০৮ এর প্রথম তফসিল এর ১৪২ অনুচ্ছেদ)। এখন কেউ যদি তার জমি বেদখল হওয়ার ১২ বছরের মধ্যে এটা পুনরুদ্ধার করার জন্য মামলা দায়ের না করে তাহলে ১২ বছর পরে আর মামলা দায়ের করা যায় না। আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। এমনকি জবরদখলকারীকেও আসল মালিক দখল থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে না। একমাত্র উপায় সিভিল কোর্টের ডিক্রি। ১২ বছর হয়ে গেলে যেহেতু ডিক্রি পাওয়ার উপায় নাই তাই দখলদার ব্যক্তিই মালিক হয়ে যায়।
এখন এই নিয়ম পরিবর্তন করলে লিমিটেশন আইনের বেসিক প্রিন্সিপল চেইঞ্জ হয়ে যাবে। সব ধরনের সিভিল মামলা করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা দরকার। তা না হলে এক্ষেত্রে দলিলে কারো নাম থাকলে সে ৫০ বছর, ১০০ বছর পরে মামলা করতে পারবে। হঠাৎ করে দেখা যাবে ১৯৩০ সালের ট্রান্সজেকশন চ্যালেঞ্জ করে বসবে। আবার দেখা যাবে আজকের ট্রান্সজেকশন ৪০ বছর পরে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হল। তখন চেইন অব ওনারশিপ, দলিল, খতিয়ান সব পরিবর্তন হয়ে যাবে।
মামলাজট কমানোর জন্য এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। অ্যাডভার্স পজেশনকে ক্রিমিনাল অফেন্স ধরা হয়েছে। এটা ইতিমধ্যে পেনাল কোড এর ৪৪৭ সেকশনে একটা অফেন্স — ক্রিমিনাল ট্রেসপাস। আমার ধারণা, এটি বাস্তবায়ন করা হলে মামলা তিন চারগুণ বাড়বে। দখলে রাখা নিয়ে মারামারি করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে ক্রিমিনাল মামলাও বাড়বে। আবার নিজের নামে দলিল করার জন্য দলিল জালিয়াতির মামলাও বাড়বে।
কেউ যদি আসলেই দলিলের ভিত্তিতে মালিক হয় তাহলে সে দুই মাসের মধ্যে ডিসির কাছে যেতে পারে, অথবা ছয়মাসের মধ্যে জেলা আদালতে যেতে পারে, তা না হলে বারো বছরের মধ্যে জেলা আদালতে যেতে পারে। বারো বছরের মধ্যে যদি কেউ জমির মালিকানা বিষয়ে আইনের শরণাপন্ন হতে না পারে তাহলে সে ওই জমিতে তার অধিকার ছেড়ে দিয়েছে বলে ধরে নেওয়াটাই সঙ্গত। জমির দখল উদ্ধার করতে দলিল ভিত্তিক মালিকানার কোনো প্রয়োজন নাই। আসল সমস্যা হচ্ছে, ডিসি অফিসে কিংবা সিভিল কোর্টে দুর্নীতি এবং হয়রানি মুক্ত উপায়ে অল্প সময়ে প্রতিকার পাওয়া নিশ্চিত করা। এই আসল জায়গায় সমস্যা সমাধান না করে ‘দলিল ভিত্তিক মালিকানা’র নীতি হিতে বিপরীত হবে।
লেখক: শিক্ষানবিস আইনজীবী, হাবিব ল একাডেমীর শিক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী