:: ফেনী বুলবুল ::
বয়স্ক একজন মানুষ আসলেন এফডিআর এর রেট জানতে। আলাপকালে জানলাম ভদ্রলোকের নাম সুবল চন্দ্র বিশ্বাস। বয়স ৭২ বছর। ৪৪ বছর ওমান শহরে প্রবাস জীবন কাটিয়ে ২০২১ সালে চুড়ান্তভাবে দেশে ফিরেন। কথায় কথায় নিজের জীবনের গল্প বললেন। নবাবগন্জের এক দরীদ্র পিতার সন্তান ছিলেন, বাড়ি ছাড়া কোন জায়গা জমি ছিলো না।১৭ বছর বয়সে বাবা মারা গেলে মা আর ছোট তিন ভাই বোনের সংসারের হাল ধরতে গিয়ে উনার আর পড়ালিখা করা হয়ে উঠেনি। সংসারের স্বচ্ছলতা আর ভাই বোনদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৮সালে ২৭ বছর বয়সে বিদেশ পাড়ি জমান। ভালোই রুজি রোজগার করেন। ১৯৮৪ সালে দেশে এসে সবিতা দেবিকে বিয়ে করেন। ১৯৯১সালে মাকেও হারান। মাকে হারানোর পর তার স্ত্রী সবিতা দেবি তার তিন সন্তান দুই মেয়ে এক ছেলের পাশাপশি দুই দেবর এক ননদেরও মায়ের রূপ নিলেন। সবিতা দেবি সুবল বাবুর একমাত্র বোনকে বিয়ে দিলেন, ছোট দুই ভাইকে শিক্ষিত করলেন।এর মাঝে নিজের দুই মেয়ে এক ছেলেকেও মানুষ করলেন। শহরে ছোটখাট একটা ফ্লাটও কিনেছেন।এই পর্যন্ত গল্পটা খুব হাসি খুশিতেই বললেন।
হঠাৎ কিছুটা গম্ভীর হয়ে সুবল বাবু বললেন, ২০২১ সালে সবিতা দেবির অসুস্থতার খবর পেয়ে নানা জটিলতার মাঝেও তিনি দেশে ফিরে আসলেন। দেশে ফিরে বউয়ের চিকিৎসা করালেও কেন জানি সবিতা দেবি সুস্থ হয়ে উঠছিলেন না, অথচ তার তেমন কোন জটিল রোগ ছিলনা। একদিন সবিতা দেবি সুবল বাবুর হাত ধরে বললেন, “যদি কখনও আমার কারনে আপনার মনে কোন কষ্ট লেগে থাকে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।আমাদের বৈবাহিক জীবন ৩৭ বছরের কিন্তু দাম্পত্য জীবন ৩৭ মাসের, আপনি বছরে একবার আসতেন এবং একমাস করে থাকতেন। আপনি মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সুন্দর জীবনের কথা ভেবে কত কষ্টে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন সেটা ভেবে আপনার প্রতি সবসময় ছিল আমার অপূরান ভালবাসা শ্রদ্ধা সন্মান। আমি বছরের ১১ মাস আপনার প্রতীক্ষায় কাটাতাম। আপনি ছাড়া আমি কখনও কোন পুরুষ মানুষের দিকে ভাল করে একবার দেখিওনি বা দেখতে ইচ্ছাও করেনি। মনে খুব ইচ্ছা ছিল আপনি প্রাবস জীবন শেষ করে আসলে আপনার সাথে একবার গয়া-কাশী ঘুরে আসবো। কিন্তু মহামারীর কারনে তা আর মনে হয় হয়ে উঠবেনা। আমি ভগবানের কাছে চাইবো স্বর্গে যেন তিনি আপনাকে আমারে ভিক্ষা দেন, সেখানেই আমাদের দাম্পত্য জীবন হবে। আমি সতি, আমি জানা মতো কোন পাপ করিনি। ভগবান নিশ্চয়ই আমার কথা রাখবেন”।
কথাগুলো বলার ১১ দিনের মাথায় সবিতা দেবি স্বর্গীয় হলেন। সুবল বাবু, সবিতা দেবির কথা বলতে বলতে তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়ালেন আর আমি শুনতে শুনতে। আমরা সবসময় প্রবাসি ভাইদের কষ্টের কথা বলি, কিন্তু সুবল বাবুর গল্প শুনার পর নিশ্চয়ই সকলের বুঝতে কোন কষ্ট হবার কথা নয় যে একজন প্রবাসীর স্ত্রীর ত্যাগ স্বীকার কত! “আমাদের বৈবাহিক জীবন ৩৭ বছরের কিন্তু দাম্পত্য জীবন ৩৭ মাসের”, সবিতা দেবির এক লাইনের এই কথাটি- একটা মহাকাব্য।