:: আনিকা নাওরিন ::
সিনেমা দেশের অন্যতম একটা বড় মাধ্যম যেখানে রগরগে দৃশ্যই হলো মুনমুন, সিমলা বা ময়ূরীর ধর্ষনের দৃশ্য! ধর্ষন কিভাবে মুখরোচকভাবে করা যায় সেটাই দেখানো হয় সেখানে… বহু সিনেমাতে ডিপজল, মিশা সওদাগর বা অন্য কোন ভিলেনকে নায়িকার জামার হাতা ছিঁড়তে দেখা গেছে…
এভাবেই শুরু।
একটা বাচ্চা যখন কিছু বুঝে না উঠার আগেই যদি এই দৃশ্যটা দেখে তখন ধর্ষনটা তার কাছে নিছক মজার,বিনোদনের বিষয়… তখন সে জানে না আসলে ধর্ষনটা কি জিনিস। দেখতে দেখতে তার মনে একটা বিষ ঢুকে যায় আর এভাবেই প্রথম ব্রেইন ওয়াশটা শুরু হয় তার…
এখন আসি বিবাহিত জীবনের কিছু সাংসারিক এবং তথাকথিত ব্যক্তিগত জীবনের কথায়। বিবাহিত জীবনে সে সুখী কি সুখী না সেটার হিসাব আলাদা… কারন যারা সুখী তারাও অনেক সময় বউ,বাচ্চা থাকা সত্বেও অশালীন আচার আচরণ করে… তারা সুখী কি সুখী না এটা মূখ্য ব্যাপার না এখানে। যে পুরুষ ধর্ষক, সে সবখানেই ধর্ষক। এটা আমরা মানি আর নাই মানি। কিছু গতানুগতিক প্রতিকার বা প্রতিরোধের কথা বলে আমরা বিষয়টা থেকে পার পেয়ে যেতে চাই। কিন্তু আসলেই কি আমরা পার পাই এটা ভাবার বিষয়!
সিমন দ্য বোভোয়ার মতো আমিও আজ একটা উক্তি করতে চাই –
“কেউ ধর্ষক হয়ে জন্মায় না, বরং ধর্ষক হওয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত হয় “
ধর্ষক তার দীক্ষা ফলানোর জন্য যখন শিশুদের বেছে নেয়, সে তখন নরকের জঘন্যতম কীট থেকেও অধম। এখনতো ছেলে শিশুরাও বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষনের শিকার হচ্ছে। ধর্ষনের ক্ষেএে নারী-পুরুষ-জীব-প্রাণী মূখ্য নয়।
মূখ্য হলো যার মনে ধর্ষনের বীজ আছে সে নারী পুরুষ কেন, একটা নির্বোধ প্রাণীকেও তার পাশবিকতা থেকে রেহাই দিবে না। আমার একটা বিষয় জানার ইচ্ছা একজন ধর্ষকের মা, বউ, বোন, বাবা কেমন হয়?! তাদের মুখটা কি খুব উজ্জ্বল হয় এটা বলতে পেরে “আমার ছেলে একজন ধর্ষক” !! আমার তাদের কাছে শুধু এই একটাই প্রশ্ন!
যাইহোক, ধর্ষন কমাতে হলে কিছু বিষয় নিয়ে আমাদেরকে ভাবতেই হবে –
১। ধর্ষনটা আসলে ঠিক কি কি কারনে হচ্ছে, সেই কারনগুলো বের করতে হবে। দরকার হলে ধর্ষকের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে আসল কারনগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
২। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাবা-মা তার সন্তানকে কিভাবে গড়ে তুলছেন সেটা দেখার বিষয়। বাবা-মা কি এসব অশালীন মিডিয়া বা ছবি সন্তানদের সাথে একসাথে বসে দেখছেন কিনা সেটাও বিবেচনার বিষয়। যেহেতু দেশে এখন ধর্ষনের ঘটনা বেড়ে গেছে তাই বাবা-মায়ের উচিত ছেলে শিশুকে আস্তে আস্তে শেখানো কিভাবে মায়ের কাজগুলোকে মর্যাদা দিতে হয়। একটা মেয়ে তার মায়ের মতোই মর্যাদাবান তার মাকেও যেভাবে সে সম্মান করে, ভালোবাসে; অন্য মেয়েদেরও যেন সেভাবেই দেখে। আর ভালোবাসার মানুষও যদি থেকে থাকে, তাহলে যেন তাকে তার যোগ্য মর্যাদা এবং যথাযথ সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা দেয়।
৩। যেহেতু একটু বড় হলেই বাবা-মায়ের পর বন্ধু-বান্ধব খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাই সন্তানের বন্ধু-বান্ধবগুলো কেমন সেটা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। একটা নিদিষ্ট বয়সের পর ক্লাসে কিছু ছেলেমেয়ে অশালীন বিষয় অন্য ক্লাসমেটদের সাথে শেয়ার করে যা অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যেই এসব বিষয়ে আগ্রহ তৈরী করে পরে তারা এসব বিষয় নিয়েই মেতে থাকতে চায়!
৪। ঠিক কি কি কারনে একটা শিশু ধর্ষক হিসেবে বেড়ে উঠে এজন্য প্রচুর গবেষণা করা প্রয়োজন। এজন্য মিডিয়া,বিনোদনের মাধ্যম এবং সংবাদপত্রগুলোকে আরো বেশী সচেতন থাকতে হবে কারন তাদের প্রদর্শিত বিষয়গুলোই একটা শিশুর মনে প্রভাব ফেলতে পারে মারাত্মক!
৫। বিবাহিত জীবনে সুুখ-দুঃখগুলো একে অন্যের সাথে ভাগ করে না নিতে পারলে হতাশা বাড়ে। আর শারীরিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হলে তো কথাই নেই! ঠিক তখনি অন্যের উপর আকর্ষণ বাড়ে আর সবসময় একটা শারীরিক চাহিদার তাড়না হয় তাদের। তার তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না! আমার নিজস্ব একটা গবেষণার মাধ্যমে আমি বিভিন্ন মেয়েদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তাদের কম বেশী প্রায় সবাই যারা পাবলিক যানবাহন ব্যবহার করে তারা কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ হয়তো হাত দিয়ে চাপ দিয়ে বা স্পর্শ করে, অযথাই ঠেলাঠেলি করে বা অশালীন কোন আচরণের মাধ্যমে। হতাশাগ্রস্ত, কুরুচিপূর্ণ এবং পাশবিক মানুষই পারে এমন আচরণ করতে! কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ রাস্তাঘাটে বা অন্য কোথাও অন্য কোন মেয়ের সাথে এমন আচরণ করতে পারে না।
তার যদি মানসিকতা ভালো হয়, সে যদি মেয়েদের সম্মান বা শ্রদ্ধা করতে জানে তাহলে সে একাকি একটা নীরেট, আবদ্ধ কক্ষে থাকলেও সে একইভাবে মেয়েটাকে সম্মান এবং একই সাথে শ্রদ্ধা করবে এটাই নিশ্চিত।
৬। ধর্ষকের শাস্তির বিষয়টা এখন আরো জোরদার করার সময়টা চলে এসেছে। ধর্ষনের ঘটনা খবরের কাগজে, সংবাদে দেখানো হয় যে, অভিযুক্ত ধর্ষক পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু একটা ধর্ষক ঠিক কতোদিন জেলে বন্দী থাকে বা শেষ পর্যন্ত সাজা পায় কি না সেটাই খতিয়ে দেখার বিষয়।
৭। এতোই যখন তার শারীরিক চাহিদা যে বাচ্চারাও তার হাত থেকে রেহাই পায় না তাহলে তো সে অসুস্থ! আর তার অসুস্থ মানসিকতার ও চিকিৎসা দরকার। তার উচিত একজন ভালো শারীরিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা। এটাতে কি তার খুব সংকোচ বা লজ্জা লাগে??! আর চিকিৎসা না করিয়ে যে একটা বাচ্চার সাথে সে যে আচরণ করছে সেটা তার পরিবারের সামনে প্রকাশ পেলে তার এই অহেতুক লজ্জা কোথায় থাকবে তার ভেবে দেখা উচিত! আর সর্বোপরি রোগ হলে চিকিৎসা করানোটা লজ্জার কিছু না। চিকিৎসা করানো মানে ভালোর পথে, আলোর পথে অগ্রসর হওয়ার একটা হওয়ার প্রথম ধাপে অগ্রসর হওয়া।
৮। একটা ধর্ষকের চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে নপুংসক ব্যবস্থা বা বিশেষ অঙ্গ কর্তনের প্রবর্তন করা যেতে পারে। এবং একটা বিশেষ মোবাইল কোর্ট চালু করা যেতে পারে যারা ঘটনার সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
৮। সর্বোপরি নিজের সন্তানকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব তার বাবা-মায়ের। পরিবারের খুব কাছের মানুষরা অনেক সময় সুসম্পর্ক বজায় থাকায় সুযোগ গ্রহণ করে। তাই সন্তানদেরকে ভালো স্পর্শ (Good Touch), খারাপ স্পর্শ (Bad touch) সম্পর্কে ছোটোবেলায়ই শিক্ষা দিতে হবে। সেটা ছেলে এবং মেয়ে দুইজনকেই! এতে করে ছেলে শিশুটা জানতে পারলো কোনটা খারাপ স্পর্শ যেটা করা উচিত নয়, আর কোনটা করবে তারা। এতে করে দুইজনই সুশিক্ষা পেলো। বাবা অথবা মা অন্তত একজনকে তার ছেলে বা মেয়ের কোন ব্যক্তিগত বা শারীরিক সমস্যা আছে কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সাথে একটু বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব প্রকাশ করলে সন্তানরাও তাদের সাথে শেয়ার করতে চাইবে। তাই ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা কে একটু একটু করে শারীরিক জ্ঞান প্রদানের চেষ্টা করবেন যে বয়সে যতোটুকু জানালেই পর্যাপ্ত মনে করে ঠিক ততোটুকুই জানাতে পারলে তাদের ছেলে-মেয়েরা সচেতন হতে পারবে আগেই। অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সাথে বয়সন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়টা বলতে চান না এড়িয়ে যান কিন্তু তাতে সন্তান কোনদিনও জানতে পারবে না এমনতো নয়! তাহলে গোপনে ভুল পথে যাবার আগেই তাকে তার বয়সের উপযোগী করে বুঝাতে পারাটাই একজন সফল বাবা-মায়ের দায়িত্ব।
সবশেষে এটাই বলবো, একটা সুস্থ মানসিকতার সমাজ চাই। শিশুরা খেলবে, হাসবে, একটা নির্মল আনন্দের পরিবেশে বেড়ে উঠবে। কেন সেখানে ধর্ষনের মতো জঘন্য বিষয় তাদেরকে মাথায় রাখতে হবে!
এবং একইসাথে নারীরাও স্বাধীনভাবে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। একটা ধর্ষক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী। সমাজ প্রতিটা ক্ষেএে যেন ধর্ষকদের বুঝিয়ে দিতে পারে যে তারা পাপী এবং আর কেউ যেন ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত না হয় সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখকঃ মাস্টার্সের শিক্ষার্থী, উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়