:: আশরাফুল হক ::
একুশ ঘন্টা। ছয়তলা ভবন জুড়ে আগুন আর আগুন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় পুড়ে গেলো কতগুলো তাজা প্রাণ। মরে গেলো কতগুলো মানুষ! এই তো বাংলাদেশ।
আপনারা হয়তো খুঁজছেন, আগুনের সূত্রপাত কীভাবে। ভাবছেন, আগুন নেভাতে এতো সময় লাগলো কেন? ভারাক্রান্ত হচ্ছেন হতাহতের কথা ভেবে। দু ফোঁটা অশ্রুও হয়তো ফেলছেন স্বজনহারাদের আর্তনাদ দেখে।
আমি বলছি এ সবকিছুর প্রকৃত সূত্রপাত। একটু সামনে পড়ুন।
মনে আছে গত ২৭ জুনের মগবাজার ট্রাজেডি?
২০২০ সালে ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যু?
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার চুড়িহাট্টার কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জনের মৃত্যু?
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড?
এভাবে কতো আর হিসাব করবেন? এক দশক আগে গেলে মনে আছে ২০১০ সালে ৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১২১ জনের মৃত্যু?
অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং সবকিছুতে রাজনৈতিক কৌটিল্য বিরাজ করিয়েছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনার অভাব নেই। সর্বমুখী দুর্যোগে ভরে আছে সোনার দেশ। এবং প্রতিটি দুর্যোগের আড়ালে এগুলোই কারণ। এগুলোই সূত্রপাত। একুশ ঘন্টা ধরে আগুন নির্বাপিত না হওয়া-এই লেখা তৈরি হওয়া পর্যন্ত এখনো পরিপূর্ণ নেভেনি আগুন, কেন আপনা-আপনি আগুন বন্ধের অপেক্ষা করছে ফায়ার সার্ভিস, ভবনে উপস্থিত শ্রমিকদের সংখ্যা এবং হতাহতের চিত্র নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা, এখনো একটিও লাশ শনাক্ত করতে না পারা, এগুলোর মূল কারণ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক কৌটিল্য ছাড়া আর কিছু নয়। পিছনের ঘটনাগুলো মনে করে দেখুন।
পরিসংখ্যানে গত দশকে মোট ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮ টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে৷ প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৪৯০ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৯৪১ জন। অর্থাৎ, প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫০ জনই মারা যাচ্ছেন আগুনের কারণে৷ এসব দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৪২৮৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বেশি।
কিন্তু আপনি জানেন, এসব মোকাবেলায় সরকার কী ব্যয় করে? গত দু’তিন বছর আগেও দুর্যোগ, দুর্ঘটনা থেকে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তায় বাজেটে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০০.৮৭ কোটি টাকা৷ জনসংখ্যা বিচারে অগ্নিকাণ্ডসহ সব ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকারের মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় মাত্র ৩০ টাকা৷
যদিও আপনি নিজেকে যে মানের উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিক ভাবছেন, সেসব উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে বেবাক হয়ে থাকবেন। ডয়েচেভেলের রিপোর্ট অনুযায়ী ধরা যাক নরওয়ের কথা৷ ওইসিডি স্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাত্র ৫৩ লাখ নাগরিকের জন্য অগ্নি নিরাপত্তায় দেশটির বাজেট ছিল ৭৭৭ কোটি ৬০ নরওয়েজিয়ান ক্রোনা, অর্থাৎ ৯১ কোটি ৮১ লাখ ডলারের বেশি৷ সে হিসেবে মাথাপিছু তাদের বরাদ্দ ছিল ১৭২ ডলার করে৷ ওইসিডি স্ট্যাটের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখা যাচ্ছে, জাপান মাথাপিছু ব্যয় করছে ১৩৪ ডলার৷ অন্যদিকে ফ্রান্স ১০৪ ডলার, জার্মানি ১০৭ ডলার, সুইডেন ১০২ ডলার, সুইজারল্যান্ড ৯৭ ডলার ও যুক্তরাজ্য বছরে মাথাপিছু ৫৮ ডলার ব্যয় করে জনগণের অগ্নি নিরাপত্তায়৷ সেখানে বাংলাদেশ!
সেসব বলে লাভ নেই। বাংলাদেশের এটাই নিয়তি। আবশ্যক স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে অনন্ত পরাধীনতার জগতে। চূড়ান্ত দখলের আগে প্রতি টুকরো ভূখণ্ডে এমনই অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং সবকিছুতে রাজনৈতিক কৌটিল্য বিরাজ করিয়েছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনার অভাব নেই। সর্বমুখী দুর্যোগে ভরে আছে সোনার দেশ। এবং প্রতিটি দুর্যোগের আড়ালে এগুলোই কারণ। এগুলোই সূত্রপাত। একুশ ঘন্টা ধরে আগুন নির্বাপিত না হওয়া-এই লেখা তৈরি হওয়া পর্যন্ত এখনো পরিপূর্ণ নেভেনি আগুন, কেন আপনা-আপনি আগুন বন্ধের অপেক্ষা করছে ফায়ার সার্ভিস, ভবনে উপস্থিত শ্রমিকদের সংখ্যা এবং হতাহতের চিত্র নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা, এখনো একটিও লাশ শনাক্ত করতে না পারা, এগুলোর মূল কারণ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক কৌটিল্য ছাড়া আর কিছু নয়। পিছনের ঘটনাগুলো মনে করে দেখুন।
এখন কী হবে! একাধিক তদন্তকমিটি হবে। এক কমিটি আরেক কমিটির নিয়োজকদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিবে। নিজ নিজ নিয়োজকদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে দুষবে। নেতারা শো-অব করবে। মিডিয়াগুলো টিআরপি বৃদ্ধির সবদিক রক্ষা করে টকটকানি অনুষ্ঠান আর রিপোর্ট করবে। এভাবেই কদিন আলোচনায় থাকবে এই অগ্নিকাণ্ড।
ওদিকে স্বজনহারা মানুষ হাহাকার করবে। কদিন পর ঘটনা চাপা পরে যাবে। অপরাধীরা বীরদর্পে চলাফেরা করবে আনবিরদের মতো। আর অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক আগুনে পড়তে থাকবে-পুড়তেই থাকবে সোনার বাংলাদেশ।