:: কামরুজ্জামান কামরুল ::
“The technical man must not be lost in his own technology; he must be able to appreciate life, and life is art, drama, music, and most importantly, people.”
২০০৯ সাল। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করছেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। রাজনৈতিক বক্তব্যের পাশাপাশি নিজেদের কথা বলতে গিয়ে ওবামা বললেন, “আমরা শ্রদ্ধা জানাই এক বাঙালি প্রকৌশলীকে। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কারণ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আকাশচুম্বী ভবনটি তাঁরই নকশা করা।”
আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার হবার পরে পৃথিবীর মানচিত্রে বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছিলো। বিরাট একটা ভূখন্ড আর তার সাথে সাথে ক্রমঃশ উন্নতির সোপানে এটি বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীর একটা সামষ্টিক প্রতিমূর্তি লাভ করেছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় এই আমেরিকায় ১৯৫২ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২৩ বছরর এক তরুণ, তার মাতৃভূমি ছেড়ে। যার কারণে সারা পৃথিবীতেই স্থাপত্যশিল্পে বিরাট এক দিগন্তের সূচনা হয়েছিলো, নতুন ভূখন্ডের আবিষ্কারের সাথে সাথে যেমন অপার সম্ভবনা এবং অসংখ্য নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়, তেমনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুরনো কাঠামোই পুরো বদলে দিয়েছিলেন ওই তরুণ। উন্মোচিত হয়েছিল ভবননকশার নয়া নয়া দিগন্ত।
আমেরিকায় পাড়ি জমানো সেই তরুণের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই বাংলাদেশে। নাম ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান)। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের অধ্যাপক মির এম আলী তার আর্ট অব দ্য স্কাইস্ক্র্যাপার : দ্য জিনিয়াস অব ফজলুর খান বইতে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশি এই বিদ্বানকে বলা হয় ‘আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার’। আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন ১১০ তলাবিশিষ্ট সিয়ারস টাওয়ারের নকশা এঁকেছিলেন বাংলার এই আইনস্টাইন। তার জীবনী সম্পর্কে জানলে আসলেই বোঝা যাবে, তার এই উপাধির সার্থকতা কতটুকু। নিজের কথার সম্পূর্ণ প্রতিফলন তিনি তার নিজের সমগ্র জীবনে রেখে গিয়েছেন।
ফজলুর রহমানের পরিচয়
ফজলুর রহমান খান (এপ্রিল ৩, ১৯২৯ – মার্চ ২৭, ১৯৮২) এর জন্ম মাদারীপুর জেলার, শিবচর উপজেলার ভান্ডারীকান্দী গ্রামে বাবার নাম খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়রে এক সময়ের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। পৈতৃক দিক থেকে আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল ছিলো তার পরিবার। কখনই আর্থিক কোনো সমস্যার কারণে তাকে পড়তে হয় নি। মেধা আর পরিবারের সমর্থনে তরতরিয়ে এগিয়ে গেছেন, পড়াশোনার জন্য কখনই থমকে দাড়াতে হয়নি তাকে।
তার শিক্ষাজীবন ছিলো তার অন্যান্য পরিচয়ের মতই, ঈর্ষণীয় ফলাফল আর সেরা হওয়াটাই তার জন্য যেনো স্বাভাবিক ছিলো!
ছোটবেলায় পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবা-মায়ের হাতেই, তারপরে ভর্তি হন স্কুলে। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন আরমানিটোলা স্কুল থেকেই। এরপর পড়াশোনার জন্য চলে যান কলকাতায়, ১৯৪৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, শিবপুর।) এর আরেকটি নাম আছে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালকাটা) । ১৯৫০ সালে, কলেজের পাঠ্যক্রমের একদম শেষ সময়ে ফাইনাল পরীক্ষার সময় শুরু হয় দাঙ্গা। সমগ্র ভারতেই এই দাঙ্গার উত্তাপ ছড়িয়ে পরে। ফলশ্রুতিতে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
এরপর ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, তদানীন্তন দাঙ্গার কথা বিবেচনা করে বিশেষ ব্যাবস্থায় তিনি বাকি পরীক্ষাগুলো সমাপ্ত করেন এখানেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তদানীন্তন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার এবং আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পরীক্ষার উভয় পরীক্ষায় দুর্দান্ত ফলাফল করেন তিনি। পুরকৌশলে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি লাভ। এর পরপরই তাকে আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়, এবং কর্মজীবনের শুরু হয় এখানেই।
অবিশ্বাস্য মেধার স্বাক্ষর দেখিয়ে তিনি একই সাথে তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফুলব্রাইট স্কলারশিপ এবং সরকারী স্কলারশিপ অর্জন করেন, ফুলব্রাইট স্কলারশিপ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেওয়া হয়। স্কলারশিপ পেয়ে তিনি ১৯৫২ সালে আমেরিকা যান। তিনি সেখানে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় এ আরবান ক্যাম্পেপইন এ উচ্চতর শিক্ষা নেন। পরবর্তী ৩ বছরে তিনি দুটি মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন:
১) স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং
২) থিওরিটিক্যাল এন্ড এপ্লাইড মেকানিক্স
এবং একই বছর তিনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপরে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
এর সাথে সাথেই ১৯৫৫ সালে তিনি আমেরিকার শিকাগো শহরের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমোর, ওউইং ও মেরিল নামের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।
স্কিডমোরে কাজ করার সময়ই এফ আর খান বুঝতে পারেন, এবার দেশে ফেরা চাই। দেশে তার মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত তিনি এখন! এফ আর খান ভালোবাসতেন স্বদেশকে, স্বদেশের মাটি ও মানুষকে। কাজেই বছরখানেক কাজ করেই ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পূর্ব পদে যোগদান করেন ৷
এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি যোগ দেন করাচি ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে এখানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পেলেন না। ক্রমঃশ হতাশ হতে শুরু করেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন ছিল নির্মাণ-কৌশলকে ঘিরে। কিন্তু নানা কাজের চাপে করাচি ডেভেলপমেন্টে তাঁর স্বপ্নটা শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এফ আর খান ছিলেন দারুণ বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। খুব সহজেই তিনি অনুমান করতে পারেন, এখানে থাকলে আর যাই হোক, যে স্বপ্ন তিনি লালন করে চলেছেন বুকের ভেতর, তার বাস্তব প্রতিফলন কখনো তিনি দেখাতে পারবেন না। নিয়মতান্ত্রিক বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে তিনি তার মেধা, দূরদর্শিতার প্রতিফলন কখনই করা সম্ভব হবে না তার জন্য!
ফলে মাতৃভূমি ছেড়ে আবার আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চিন্তা করেন তিনি। কিন্তু ভেতরের দেশপ্রেমী খান ভাবেন দেশে থেকে স্বপ্নটাকে লালন-পালন করার কথা। এভাবে মনস্তাত্ত্বিক এক দোটানায় পড়ে বেশ কিছু সময় কেটে যায়। অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। ক্রমঃশ সময় কেটে গেলেও একটা পর্যায়ে গিয়ে বুঝতে পারেন তিনি, প্রচলিত প্রশাসনিক ব্যাবস্থার মধ্যে তিনি আসলেই নিজেকে আবদ্ধ করে তার মেধা ও সময় নষ্ট করছেনই শুধু, দেশকেও নতুন কিছু দিতে পারছেন না, নিজেও বঞ্চিত হচ্ছেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের থেকে। “না, স্বদেশই যখন তাঁকে সম্মান জানাতে পারেনি, ভিনদেশিদের ওপর অভিমান করা চলে না’, নিজেকে এভাবেই সান্ত্বনা দেন তিনি। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান) ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাওয়ার। এবং ১৯৬০ সালে আমেরিকার সেই স্থাপত্য সংস্থা স্কিডমুর-ওয়িংস-মেরিলে পুনরায় যোগদান করেন।
এরপর স্বপ্নটা তাঁর ডানা মেলা শুরু করে। উনিশ শ ষাটের দশকে এফ আর খান একের পর এক বড় বড় সব ভবনের নকশা আঁকতে থাকেন এফ আর খান। এতোদিন ধরে যে অদম্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সবটুকু ঢেলে দিয়ে এবার তার ভালোবাসার কাজে নিজেকে নিয়োগ করেন তিনি।
ফজলুর রহমান খান প্রবাসে এসে একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করেন। গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে যেয়ে তিনি আকাশচুম্বী ভবন বানানোর পদ্ধতি আবিস্কার করেন এবং তিনি সফলও হন। তার যুগান্তকারী এ থিওরীর নাম টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম। ১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আকাশচুম্বী সুউচ্চ ভবনগুলো তার টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেমকে অনুসরন করেই বানানো। এছাড়াও হাইরাইজ বিল্ডিং এর উপর সাত খন্ডে প্রকাশিত একটি পুস্তকের তিনি সম্পাদনা করেন ৷
১৯৬০-১৯৭০ সালের মধ্যেই তিনি বিখ্যাত হয়ে যান তার দুটি অবাককরা সৃষ্টির জন্য।
১৯৬০ সালের শিকাগো শহর। ক্রমঃশ প্রসারিত জনগোষ্ঠী সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় অফিস স্থানের। শহরের যত শূণ্যস্থান, সবই একে একে দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছিলো, ক্রমঃশ নতুন বসতি স্থাপনের জায়গাও কমে যাচ্ছিলো। উচ্চতর স্থাপত্য বিদ্যা না থাকায় তখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ভবনেরই সীমা ছিলো সর্বোচ্চ ত্রিশ তলা পর্যন্ত, কারণ ত্রিশ তলার উপরে ভবন নির্মাণ করতে গেলে তখন প্রচন্ড ব্যায়বহুল দশার মধ্যে দিয়ে ভবনের গঠনকাজ করতে হতো! ফলাফল হিসেবে দেখা গেলো, খুব দ্রুতই শহরের প্রায় সব স্থানই ছোটো ছোটো বর্গাকার ভবনে ভরে গেছে।
এই রকম ক্রান্তিকালীন সময়ে ফজলুর রহমান খান স্থাপত্য পুরকৌশলের জগতে প্রবেশ করেন। তিনি তখনকার স্থাপত্যকৌশলের সাথে বাস্তবক্ষেত্রের অসামঞ্জস্য বুঝতে পারেন, এবং নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব তুলে নেন শিকাগো এবং তার আশেপাশের স্থানগুলোর স্থাপত্যকাজের পূর্ণাঙ্গতা দেবার জন্য।
১৯৬৯ সালের কথা, বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি তখন সিয়ারস অ্যান্ড কোং। তাদের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার। সব কর্মীর একটি মাত্র কার্যালয় বানানোর স্বপ্ন ছিলো সিয়ারস কোম্পানির। তারা চাচ্ছিলেন, তাদের সকল কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল হবে একটি ভবনেই, সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে এই একটি ভবন থেকেই, কাজগুলো সম্পন্নও হবে এখানেই।
কিন্তু এই বিরাট প্রতিষ্ঠানের বিরাট কর্মযজ্ঞ একটি স্থানে নিয়ে আসা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তার জন্য চাই বিরাট স্থান, বিশাল আয়োজনের বহুতল ভবন, নইলে এতো কিছুর স্থান হবে কি করে? সুতরাং, পরিকল্পনা করা হলো, বিরাট একটা ভবন তৈরী করা হবে, বহুতল সেই ভবনের নকশা প্রণয়ন করা চাই! তো আর কি, ডাক পড়লো ফজলুর রহমান খানের!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে বহুতল আকাশচুম্বী ভবনের ধারণা থেকে সিয়ার্স কোম্পানীর পরিকল্পিত ভবনের নকশা করা সম্ভব ছিলো না। এ জন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের স্থাপত্যকৌশল, যা একই সাথে নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি স্থান সংকুলানসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণে সক্ষম! কাজে কাজেই সিয়ার্স টাওয়ারের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে যদি না কেউ নতুন কোনো পথ দেখায় তাদের।
এ স্বপ্নটার বাস্তবায়ন করেন আমাদের এফ আর খান। ১১০ তলা উঁচু একটি ভবনের নকশা তৈরি করেন তিনি। ১০১ একর জমির ওপর তিন বছর এক মাস ১০ দিনে সেই ভবনটি দাঁড়িয়ে যায় সম্পূর্ণ মাথা উঁচু করে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এক বাঙালি ব্যক্তিত্বও। সিয়ারস টাওয়ার (১৬ জুন, ২০০৯ থেকে পরিবর্তিত নাম উইলিস টাওয়ার) ছিল ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। এবং এখনো আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন সেটিই। কেউ যদি সেখানে গিয়ে থাকেন, দেখে থাকবেন করিডরের মূল ফটকে বাংলায় লেখা ‘স্বাগত জানান’, সাথে আর এফ আর খানের একটা ছবি।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ওই ফটকে কোথাও পরিচিতিতে এফ আর খানকে বাংলাদেশি উল্লেখ করা নেই। শুধু এভাবে লেখা আছে যে ইলিনয়ের ঐ সময়ের সেরা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার।
টাওয়ারের নিচে এফ আর খানের মূর্তি
পরবর্তীতে তার টিউব স্ট্রাকচার সিস্টেমের তত্ব ব্যাবহার করে আরো অনেকগুলো বিশাল বিশাল জগদ্বিখ্যাত কাজ সম্পন্ন করা হয়।
উদাহরন হলো: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, জিন মাও বিল্ডিং ইত্যাদি। দুবাইর বুর্জ খলিফা তৈরীতেও তার থিওরী অনুসরন করা হয়েছে।
এছাড়া প্রথম স্কাই লবিও এই বাঙ্গালির আবিস্কার। জন হ্যানকক সেন্টারের ৪৪ তলার স্কাই লবি আমেরিকার সর্বোচ্চ এবং এটিতে একটি সুইমিংপুলও আছে।
১৯৭২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডে তিনি ম্যান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন এবং পাঁচবার স্থাপত্য শিল্পে সবচেয়ে বেশি অবদানকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গৌরব লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন তাকে শিল্প ও স্থাপত্যের ওপর প্রচ্ছদ কাহিনীতে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে। এ ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী অট্টালিকা ও নগরায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার স্থাপত্য নকশার মধ্যে আরও আছে শিকাগোর জন হানফক সেন্টার, জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হজ টার্মিনাল এবং মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য মডেল অঙ্কন। ১৯৯৮ সালে শিকাগো শহরের সিয়ার্স টাওয়ারের পাদদেশে অবস্থিত জ্যাকসন সড়কের পশ্চিম পাশের এবং ফ্রাঙ্কলিন সড়কের দক্ষিণ পাশের সংযোগস্থলটির নামকরণ হয় ‘ফজলুর আর খান ওয়ে’।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই ব্যাক্তির সেরা কাজগুলো, তার সেরা ১০ ডিজাইন –
১। ব্রানসউইক ভবন, শিকাগো ৩৭ তলা
নকশা : ১৯৬২ সাল। সম্পন্ন : ১৯৬৪ সাল।
২। চেস্টনাট ডি-উইট প্লাজা, শিকাগো ৪৩ তলা
নকশা : ১৯৬৩ সাল। সম্পন্ন : ১৯৬৬ সাল।
৩। জন হ্যানকক, শিকাগো ১০০ তলা
নকশা : ১৯৬৫ সাল। সম্পন্ন : ১৯৬৯ সাল।
৪। ওয়ান সেল প্লাজা, হোস্টন ৫২ তলা
সম্পন্ন : ১৯৭১ সাল।
৫। সিয়ারস টাওয়ার, শিকাগো ১১০ তলা
নকশা : ১৯৬৯ সাল। সম্পন্ন : ১৯৭৩ সাল।
৬। ইউএস ব্যাংক সেন্টার, ৪২ তলা
সম্পন্ন : ১৯৮০ সাল।
৭। হজ টার্মিনাল, জেদ্দা
[কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট]
নকশা : ১৯৭৪ সাল। সম্পন্ন : ১৯৮০ সাল।
৮। কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, জেদ্দা
নকশা : ১৯৭৭ সাল। সম্পন্ন : ১৯৭৮ সাল।
৯। ওয়ান ম্যাগনিফিশেন্ট মাইল, শিকাগো ৫৭ তলা
সম্পন্ন : ১৯৭৮ সাল।
১০। অনটারি সেন্টার, শিকাগো ৬০ তলা
সম্পন্ন : ১৯৮৬ সাল।
জীবদ্দশাতে যশ-খ্যাতির পেছনে কখনো দৌড়াননি তিনি, বরঞ্চ উল্টোটাই দেখা গেছে তার ক্ষেত্রে। অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন, পুরষ্কার পেয়েছেন। এই কৃতি বাঙ্গালির অর্জিত পুরস্কার সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
১) ওয়াসন মেডেল (১৯৭১)
২) আলফ্রেড লিনডাও এ্যওয়ার্ড (১৯৭৩)
৩) থমাস মিডলব্রুকস এ্যওয়ার্ড (১৯৭২)
৪) আরনেস্ট হোয়ার্ড এ্যওয়ার্ড (১৯৭৭)
৫) কিমব্রুক মেডেল (১৯৭৩)
৬) ওস্কার ফাবেল মেডেল (১৯৭৩)
৭) ইন্টারনাশনাল এ্যওয়ার্ড অব মেরিট ইন স্ট্রাকাচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং (১৯৮৩)
৮) দি এআইএ ইনস্টিটিউট অনার ফর ডিস্টিংগুইশ এচিবমেন্ট (১৯৮৩)
৯) জন পারমার এ্যওয়ার্ড (১৯৮৭)
আসলে আমরা এখনো অনেক স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে ফেলছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এফ আর খানের স্বপ্ন বেঁচে গিয়েছিল তিনি বিদেশে চলে গেলেন বলেই। তিনি কিন্তু বিদেশে গিয়ে ভুলে যাননি তাঁর স্বদেশকে। এ জন্যই ফিরে এসেছিলেন দেশে, শেষমেষ কিছু করতে না পেরে ফেরত গিয়েছিলেন তার পুরনো অফিসেই, সেই বিদেশ বিভূইয়েই।
পরবর্তীতে এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে এ কোম্পানীর শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ৷ পাশাপাশি তিনি আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এর স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন ৷ সেখানে পরে তিনি প্রফেসর এমিরিটাস হয়েছিলেন ৷ এছাড়া ডঃ এফ আর খান নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লি হাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইস ফেডারেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
তার প্রবর্তিত টিউব স্ট্রাকচার সিস্টেম ছিলো অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি সাশ্র্য়ী, নির্মাণশৈলীর নিপুণতার এক অনন্য উদাহরণ। যে সব মানুষগুলো এই স্থাপত্যে কর্মযজ্ঞে ছিলেন, অথবা পরবর্তীতে এখানে থেকেছেন, কাজ করেছেন, তাদের সবার মনের অনুভূতিই প্রায় একইরকম। এরকম আকাশচুম্বী দালানের একটা অংশে নিজে অবস্থান করলে প্রকৃতির বিশালত্ব খুব ভালোমতো অনুভব করা যায়, সাথে আরো অনুভব করা যায় নিজের ক্ষুদ্রতা। মনে হয়, আক্ষরিক অর্থেই যেনো আমরা “আকাশের বাসিন্দা” হয়ে গেছি।
হ্যাঙ্কক টাওয়ারের বাসিন্দাদের সবার অনুভূতিই প্রায় একইরকম। এরকম সুবিশাল আকাশ, চারপাশে হ্রদ। এই সুবিশাল উচ্চতায় থেকে সূর্যের আগমনের আভাস পাওয়া যায় কিছুটা হলেও আগে,শহরের কেন্দ্রে থেকেও নির্জনতা, নিঃস্তব্ধতাকে অনুভব করা যায় অনেক গভীরভাবে। রাতের আকাশের চাঁদ, তাঁরা, বাসস্থান পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়া অসংখ্য পাখির দল, সবকিছুই।
তিনি ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন ৷ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রবাসে বাঙ্গালীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গণসংযোগ এবং সাহায্য সংগ্রহে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে যখন দেশ ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ লিপ্ত, প্রবাসের বাঙালিদের নিয়ে তিনি একটা ফান্ড গঠন করেছিলেন।
এফ আর খানই প্রথম বাঙালি, যিনি মার্কিন সিনেটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমনে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য? এ জন্য বিনিময়ে দেশ তাঁকে একবার স্বাধীনতা দিবস মেডেল দেয়, তাও তাঁর মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯৯ সালে। দেশ তাঁকে ‘যোগ্য সম্মান’ না দিলেও বাংলাদেশ ছিল তাঁর অস্তিত্বে আর অনুভবে।
১৯৯৯ সালে ফজলুর রহমান খানের স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ৪ টাকা মূল্যমানের এই টিকিটটিতে রয়েছে ফজলুর রহমান খানের আবক্ষ চিত্র, আর পটভূমিতে রয়েছে সিয়ার্স টাওয়ারের ছবি।
আমরা বাঙ্গালীরা এই কৃতিকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ হলেও আমেরিকানরা প্রতিদিন তাকে সম্মানের সাথে স্মরণ করে। তার সৃষ্টি সাবেক সিয়ার্স টাওয়ার এবং টাওয়ারের লিফটগুলোতে তার কীতি ও সৃষ্টির কথা প্রতিদিন প্রচার করা হয়।
জীবনকে কীভাবে দেখতেন এফ আর খান?
তিনি বলতেন, ‘প্রতিটি মানুষের জীবনই প্রযুক্তি। আর জীবন মানেই শিল্প। জীবন মানে একটা নাটক আর সুর-সংগীত।’
জীবনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা?
বাংলার আইনস্টাইন বলতেন, ‘জীবন মানে মানুষ, মানুষই জীবন।’
মানুষ কেন বেঁচে থাকে?
এফ আর খান বলতেন, ‘মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের জন্য। মানুষ বাঁচে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে কেউই চায় না। কিন্তু আমি মাতৃভূমি ছেড়েছি স্বপ্নকে বাঁচাতে।’
তাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। কারণ নিয়তি তো তাঁর সঙ্গে ছিল।
এফ আর খানের কন্যা ইয়াসমিন সাবিনা খান বাইরন বাবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে বাবা ছিলেন ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্যতিক্রম ধারার এক ইঞ্জিনিয়ার। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন নম্র-ভদ্র, সরল এবং দূরদর্শী ও উদ্যমী।’
এফ আর খান বেঁচে আছেন ইমারতশিল্পে, মানুষের হৃদয়ে।।