:: ফারহান আরিফ ::
ঢাকা সিটিতে হিন্দুদের বসবাস আধিক্য আছে এমন জায়গাগুলোর মধ্যে লক্ষীবাজার অন্যতম। এখানেই আছে খৃস্টানদের দু’টি বিখ্যাত মিশনারি স্কুল। মিশনারি স্কুলটিকে মাঝখানে রেখে একটি ক্যাথলিক চার্চ এবং লক্ষীবাজার শাহী মসজিদ। সন্ধ্যা নামলে এখানে একইসাথে মাগরেবের আজান এবং উলুধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু কখনো কি কোন হানাহানির সংবাদ পাওয়া গিয়েছে? বলতে পারেন শহরের মানুষ আধুনিক মানসসম্পন্ন। তাই সবাই সচেতনভাবে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারে। গ্রামের অবস্থা ভিন্ন। তাহলে এই পুজোর একটি উদাহরণ নিন। বাঞ্ছারামপুরের একটি পুজোমণ্ডপের পাশেই একটা কওমি মাদ্রাসা। দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এ মাদ্রাসায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র আবাসিক থাকে। কুমিল্লাকাণ্ডে এখানে প্রভাব পরতে পারতো। কিন্তু পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
কৈশোরে লালমোহনে দেখতাম বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মুসলিম ছেলেরা পুজামণ্ডপে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিরাপত্তা বিধান করছেন। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সেই রীতি এখনো চালু আছে।
আগামীকাল একইসাথে দশমী এবং পবিত্র জুম্মা। যে কোন অপ্রীতিকর অবস্থা ঠেকাতে প্রথমেই করণীয় হচ্ছে, জুম্মার খুৎবায় ইমাম সাহেবদের সচেতন দিকনির্দেশনা। প্রকৃত বদমাইশকে সামনে নিয়ে আসা। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান যেমন অন্য ধর্মাবলম্বীর অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে না; ঠিক তেমনি একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দুও অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে না- এই বিশ্বাসটুকু ছড়িয়ে দেয়া চাই। কতিপয় উগ্রপন্থী কিংবা স্বার্থাণ্বেষী সুযোগসন্ধানীর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আমরা যেন আমাদের দীর্ঘকালের সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিসর্জন না দেই, সেই খেয়ালটুকু রাখা চাই।
‘৯২ সালে গুজরাটের দাঙ্গাকালে আমাদের এদেশে কিছুটা প্রভাব পড়েছিল। স্থানীয় জমিদার গোছের কিছু প্রভাবশালী সে সময় কিছু সুযোগ নিয়েছিলেন। মূলত: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়কের ভূমিকায় এদেরকেই অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। ধর্মপ্রাণ এবং বোধবুদ্ধিসম্পন্ন কোন মুসলমান বা ইসলামি বিধি-বিধান সম্পর্কে ধারণা রাখা সুস্থ কাউকে কখনো কোন হাঙ্গামায় দেখা যায়নি। রামু, শাল্লা, নাসিরনগরসহ যতগুলো ঘটনাই ঘটছে, সবখানেই দেখবেন একদল প্রভাবশালী জোতদারের ভূমিকা। গত পড়শু নাসিরনগর হামলার সাথে জড়িত কয়েকজন আলোচনায় এসেছেন। এরাও যে প্রভাবশালী সেটা তাদের ইউপি নির্বাচনে নৌকার মাঝি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া থেকেই বুঝা যায়। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে যেসব সাম্প্রদায়িক সংঘাত আমরা দেখি এগুলোর পেছনকার শানে নুযুল এমনই।
আগেও বলেছি বাংলাদেশে যে ঘটনাগুলো ঘটে তার বেনিফিসিয়ারি গ্রুপ মোটাদাগে দু’টি: আওয়ামী লীগ আর বিজেপি-আরএসএস চক্র। আওয়ামী লীগের লাভটা হচ্ছে, বহির্বিশ্বে বুঝানো যে আমরা ক্ষমতায় না থাকলে মৌলবাদিরা এসকল কাজ নির্বিঘ্নে করে যাবে। তাতে বাংলাদেশ বাঙ্গিস্তান হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ভোট-ফোটের দরকার নাই। আমাদেরকে ক্ষমতায় রাখো। কুমিল্লার ঘটনাকে যদি কাঁচির নিচে রাখি, তাহলে প্রথমেই চিন্তা করতে হচ্ছে দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বহির্বিশ্বে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়া, জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর দেশীয় চক্রটির হাতে আছে এখন এই একটিই ট্রাম্পকার্ড। কোনক্রমে একটা সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারলেই ‘১৪, ‘১৮ এর পূনরাবৃত্তি সম্ভব বলে এই চক্রটির ধারণা। একটু মাথা খাটালেই বুঝতে পারবেন, বহির্বিশ্বে আগের দুইবারই তারা এই জিনিসটাই সেল করেছিল। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে এটা এখন সেলেবল প্রোডাক্ট হিসেবে অচল; অন্তত: এই মূহুর্তে। তবুও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় চেষ্টা করতে আপত্তি কি! সীমানার ওপাড়ে যে চক্রটি রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার বুঝা যায়। তারা এই ঘটনাগুলো পুঁজি করে ভারতীয় মুসলমানদের উপর খড়গহস্ত হবার সুযোগ পায়। তাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে এনআরসি-সিএএ-কেও জাস্টিফাই করে নেয়া যায়।
এখন এই চক্রের অপচেষ্টাকে রুখে দেয়ার দায়িত্বটা সর্বাগ্রে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরই। এই মূহুর্তে জযবাতি না হয়ে সচেতনভাবে পরিস্থিতি শামাল দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনের অবমাননা স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। সুতরাং প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল হওয়াকে নিরুৎসাহিত করা যায় না। এটা মুসলমানদের ধর্মাবেগ। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়া অগণতান্ত্রিক। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ যেন সহিংসতায় রূপ পরিগ্রহ না করে।
আগামীকাল একইসাথে দশমী এবং পবিত্র জুম্মা। যে কোন অপ্রীতিকর অবস্থা ঠেকাতে প্রথমেই করণীয় হচ্ছে, জুম্মার খুৎবায় ইমাম সাহেবদের সচেতন দিকনির্দেশনা। প্রকৃত বদমাইশকে সামনে নিয়ে আসা। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান যেমন অন্য ধর্মাবলম্বীর অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে না; ঠিক তেমনি একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দুও অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে না- এই বিশ্বাসটুকু ছড়িয়ে দেয়া চাই। কতিপয় উগ্রপন্থী কিংবা স্বার্থাণ্বেষী সুযোগসন্ধানীর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আমরা যেন আমাদের দীর্ঘকালের সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিসর্জন না দেই, সেই খেয়ালটুকু রাখা চাই। আর অবশ্যই ভাসুরকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। প্রত্যক্ষ হামলায় অংশ নেয়া এবং অর্থের যোগান দেয়া ব্যক্তিদেরকে কারা রাজনৈতিক সমর্থন দেয় তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। নাসিরনগর সদর, পূর্ববাগ এবং হরিপুরের দুষ্কৃতকারীদেরকে কারা প্রণোদনা দেয়, কোন মনোনয়ন বোর্ডে তাদেরকে সিলেক্ট করা হয়, সেই মনোনয়ন বোর্ডের প্রধানই বা কে- এসব ফ্যাক্টসকেও জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। তবেই নিরাপদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
পরিশেষে একজন মুসলমান হিসেবে আমাদেরও চাওয়া থাকবে, যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিবাদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও সোচ্চার হবেন।