:: অধ্যাপক মফিজুর রহমান ::
সশস্ত্র অবস্থায় একটা সাদা-কালো গ্রুপ ফটোগ্রাফ আর একটা কবর এ দুটো জিনিসই কালের আবর্তে টিকে আছে বাংলাদেশি যুবকদের সবেচেয় মূল্যবান স্মৃতি হিসেবে যারা ১৯৮০’র দশকে ফিলিস্তিনের হয়ে ইসরাইলি আগ্রাসন ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়ায়ে শরীক হতে স্বেচ্ছায় ছুটে গেছিল লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। তাদের কেউ কেউ লড়েছিল সরাসরি অস্ত্র হাতে আবার কেউ কেউ ভলান্টিয়ার হিসেবে বিভিন্ন কাজে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করেছিল আপন ভায়ের মত। তাদের এ অবদান ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে মোটেও নগন্য নয় । ফিলিস্তিন থেকে বহু দূরের এক অনারব দেশের মুসলিম যুবক হিসেবে তাদের সাহসিকতা-বীরত্বের বিভিন্ন কাহিনী সময়ের পরিবর্তনে অবহেলায় চাপা পড়ে গেলেও যতটুকু জানা যায় তা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার এবং আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক।
অন্যায়-অবিচার, জুলুম-হত্যা আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দাড়িয়েছে ফিলিস্তিনের পাশে। জাপানিজ রেড আর্মি কিংবা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির মত বেশ কিছু সংগঠন এবং গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্যরা ধর্ম-বর্ণ ভুলে লড়েছিল ফিলিস্তিন মুক্ত আন্দোলনের সাথে। এসব সংগঠন এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অবদান নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই কিংবা তৈরী হয়েছে ডকুমেন্টারি কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশের বেশ কয়েক হাজার যুবকের কাহিনী চাপা পড়ে যায় কালের আবর্তে। তাদের ব্যাপারে কোন আরব বা অনারব ঐতিহাসিক কিংবা সাংবাদিক কোন অনুসন্ধানমূলক কোন পদক্ষেপ হাতে নেননি আজ পর্যন্ত, ফলে এ প্রজন্মের ফিলিস্তিনীরা তো বটেই এমনকি বাংলাদেশিরাও জানেনা এই ইতিহাস। তখনকার চরম গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামীদের সাথে অস্ত্র হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়া থেকে শুরু করে অস্ত্র-রসদ বহন এমনকি পাহারার কাজও করেছিল এসব বাংলাদেশি যুবকেরা।
“প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশি যুবক সেসময় প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সাথে লড়ায়ে অংশ নিয়েছিল স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে” – ইউএস লাইব্রেরী অফ কংগ্রেস
লেবাননে প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন সাথে ইসরায়েল বিরোধী লড়ায়ে অংশ নেয়া বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একটি দূর্লভ গ্রুপ ছবি, এ ছবিটা ১৯৮২ সালে বৃটিশ ফটেগ্রাফার ক্রিস স্টিল পারকিন্সের তোলা। তিনি তখন বৈরুত থেকে লড়ায়ের খবরাখবর কাভার করতেন ।লেবাননে প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন সাথে ইসরায়েল বিরোধী লড়ায়ে অংশ নেয়া বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একটি দূর্লভ গ্রুপ ছবি, এ ছবিটা ১৯৮২ সালে বৃটিশ ফটেগ্রাফার ক্রিস স্টিল পারকিন্সের তোলা। তিনি তখন বৈরুত থেকে লড়ায়ের খবরাখবর কাভার করতেন ।
সাদা-কালো স্মৃতি
১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন হামলা ও দখলের আগে বৃটিশ ওয়ার ফটোগ্রাফার ক্রিস স্টিল পারকিন্স কোন এক এলাকায় দেখা পান একদল বাংলাদেশি যুবকের। পারকিন্স বাংলাদেশি এই সশস্ত্র গ্রুপের সাথে খুব বেশী কথা বলতে না পারলেও একটা ছবি তুলে নেন। পরে এই ছবিটাই হয়ে ওঠে লেবাননে বাংলাদেশি যোদ্ধাদের একমাত্র আইকনিক দূর্লভ ছবি।
ফিলিস্তিনের সাথে বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেকটা জন্মের পর থেকেই। গোঁয়ার এবং অত্যাচারী পাকিস্তানের শাসকদের সাথে রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং ১৯৭১ এ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের সাহায্য নিয়ে আলাদা যায় বাংলাদেশ। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আলাদা হয়ে যাওয়া গোটা মুসলিম বিশ্ব সহজভাবে নেয়নি এবং আরবরা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও অনীহা প্রকাশ করে । স্বাধীনতার স্থপতি এবং তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই অচলাবস্থা কাটানোর উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে ওআইসিসহ আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনযোগ দেন তিনি। আরবদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় বাংলাদেশের ব্যাপারে যখন ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিশর-সিরিয়া-ফিলিস্তিন অক্ষের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন ঘোষনা করেন মুজিবুর রহমান। এসময় যুদ্ধে সেবা দেবার জন্য তিনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল টিম এবং ত্রান সামগ্রীও পাঠান। এর কিছু পরেই ঐ একই বছরে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় বাংলাদেশ । ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন মুজিবুর রহমান এবং সেই সম্মেলনে ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিলিত হোন তিনি যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনী কোন সংগঠনের এত উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানকে আরব রাষ্ট্রগুলো চাপ দিতে থাকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের দরজা উম্মুক্ত করা হয় ফিলিস্তিনের জন্য এবং ঢাকায় পিএলও কে সরকার আমন্ত্রণ জানায় অফিস খোলার জন্য। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকায় পিএলও নেতা এবং কূটনীতিকরা আসেন এবং ফিলিস্তিনের প্রথম কোন দপ্তর খোলা হয় ঢাকায়। এসময় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং কূটনৈতিক প্রোগ্রামে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিকদের প্রায়ই অংশ নিতে দেখা যেত বলে জানা যায় ১৯৭৬ সালে আমেরিকান এম্বাসি ঢাকার পাঠানো এক বার্তায় যা ফাঁস করে উইকিলিকস।
মুসিলম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সবসময়ই সহানুভূতি-ভালবাসা ছিল ফিলিস্তিন এবং তার জনগণের জন্য। এ সম্পর্কের আরেক মাইলফলক উম্মোচিত হয় ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। এসময় ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে তা স্মরণীয় করে রাখতে সরকার প্রকাশ করে একটি স্মারক ডাকটিকেট যেখানে একজন ফিলিস্তিনী যোদ্ধাকে দেখা যায় অস্ত্র হাতে এবং তার পেছনে কাঁটাতারে ঘেরা মসজিদুল আক্বসা। এই ডাকটিকেটে ইংরেজীতে লেখা হয়, ‘আমরা বীর ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের স্যালুট/সালাম জানাই’ ।
১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশের প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকেট। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশের প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকেট।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সফরে আসেন পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত। মুসলিম বিশ্বে খুব কম সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া বাংলাদেশি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে উপস্থিত থেকে গাল গালিচা সংবর্ধনা জানান ফিলিস্তিনি এই নেতাকে। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালবাসা এবং ফিলিস্তিন নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখে অভিভূত হোন ইয়াসির আরাফাত। রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদের কর্মকর্তারা তাকে যথেষ্ট সম্মান এবং সমাদর করেন।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত
১৯৮৮ সালে ইউএস লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রনে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের তার দ্বিতীয়বারের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদশ সরকার তাকে জানান যে সেদেশের প্রায় ৮ হাজার যুবক স্বেচ্ছায় ফিলিস্তিনের জন্য লড়ায় করছে । এছাড়া এই রিপোর্টে আরো জানানো হয় যে ফিলিস্তিনী সশস্ত্র সংগ্রামের বেশ কিছু নেতা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এসময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
দলিল কী বলে
আজকের দিনে এরকম ডকুমেন্টস খুজে পাওয়া খুবই কষ্টকর যেখানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে ঠিক কতজন বাংলাদেশি লেবাবনে সেইসময় ফিলিস্তিনীদের সাথে লড়ায়ে অংশ নিয়েছিল বা কতজন শহীদ হয়েছিল কিংবা তারা কোন গ্রুপের সাথে ছিল ।
মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় পত্রিকা আল-আখবার বৈরুতে এ বিষয়ে বাংলাদেশ এম্বাসির সাথে যোগাযোগ করলে এম্বাসির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এরকম ইতিহাস বা ঘটনা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের দলিলে থাকলেও খুব বেশী বিস্তারিত বা বলার মত সেরকম কোন তথ্য তাদের কাছে নাই।
রৈুতের ফিলিস্তিন এম্বাসিও এ বিষয়ে খুব বেশী বলতে পারেনি কারণ তাদের দপ্তরে ইসরায়েল হামলা চালিয়ে সব পুড়িয়ে দেয় লেবাননে আগ্রাসনের সময়। সুতরাং কোন দলিল এ বিষয় থেকে থাকলেও তা নষ্ট হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের তৎকালীন নেতাদের স্মৃতিতে কি আছে বাংলাদেশের সেসব দুঃসাহসী তরুণদের কথা ?
“তারা সংখ্যায় ছিল প্রায় এক থেকে দেড় হাজার মত। এমনও ব্যাটলিয়ন ছিল আমাদের যেখানে সংখ্যাগরিষ্টই ছিল বাংলাদেশি । তবে তাদের বেশীরভাগই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে বিভিন্ন গ্রুপের সাথে কাজ করেছে।
আমার মনে পড়ে তারা ছিল খুবই সুশৃঙ্খল এবং অদম্য। যখন ইসরায়েল লেবাননে হামলা করল তখন বেশ কিছু বাংলাদেশি যুবক ইসরায়েলীদের হাতে ধরা পড়ে। তারা ইসরায়েলী সেনাদেরকে বলত, ‘PLO, Israeli No’ ! এমনকি প্রচন্ড নির্যাতন করার পরও এমন কথা বলত। অন্যান্য সকল যোদ্ধাদের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির ব্যাপারে তাদের দৃঢ় আশা এবং বিশ্বাস ছিল।” -ফাতহি আবু আল আরাদাত, লেবাননে ফাতাহর সেক্রেটারী এবং তৎকালীন পিএলও নেতা
যদিও সেই সময়ে ফাতাহ অর্থাৎ পিওলও ই ছিল ফিলিস্তিনী মুক্তি আন্দোলনের প্রধান গ্রুপ তাই বিদেশী যোদ্ধাদের বেশীরভাগই তাদের সাথে কাজ করত। এছাড়া আরো ছোটখাটো কিছু গ্রুপ ছিল যারা ফাতাহর কমান্ডের বাইরে লড়াই করত। এরকমই কিছুটা বামপন্থী আদর্শের একটা গ্রুপ Palestinian Front for the Liberation of Palestine – General Command (PFLP-GC) । এই গ্রুপটা তাদের মুল দল PFLP থেকে পৃথক হয়ে যায় আদর্শগত বিরোধের কারনে এবং তারা সিরিয়ার বামপন্থী সরকার থেকে সমর্থন পেত।
“তাদের অনেকেই PFLP-GC’র সাথে ছিল। তাদের মিলিটারি ট্যালেন্ট ছিল চমৎকার কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই তারা সেবা দেবার কাজ করত, যেমন অস্ত্র-গুলি বহন কিংবা যোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ। অফিস/ঘাঁটি পাহারাতেও তারা আমাদের সাথে কাজ করত। কখনও সরাসরি লড়ায়ে অংশ নিতে চাইলে তারা ফিল্ডে চলে যেত। আমি তাদের মধ্য থেকে এখনও ২/৩ জনকে পরিষ্কার মনে করতে পারি। একজন বেকাতে আমাদের ঘাঁটি পাহারা দিত আরেকজন বাবলেকে। তারা কেউ কেউ চমৎকার আরবীও বলতে পারত এজন্য মানুষ ভুলেই গেছিল তারা বাংলাদেশি ।” – জিয়াদ হাম্মো, PFLP’র তৎকালীন একজন কমান্ডার
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কয়েক হাজার বাংলাদেশির মাত্র কয়েকজনের অবদান কেন স্মরণ করতে পারেন ফিলিস্তিনী নেতারা কেন বড় কোন গ্রুপ বা বড় কোন ঘটনা নয়?
এমন প্রশ্নে জবাবে হাম্মো তার মতামত এভাবে ব্যক্ত করেন,
“PLFP তে আমরা চেষ্টা করি এসব যোদ্ধাদের স্মরণ করতে বা তাদের ইতিহাস সংরক্ষণ করে রাখতে। যেমন জাপানী রেড আর্মি সদস্যদের ভূমিকা ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেসময়, তাই তাদের বিভিন্ন অপারেশন বা অবদানের ইতিহাস আমরা উদ্ধার করে সংরক্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাংলাদেশি দের কাজ ছিল অনেকটা সীমাবদ্ধ এজন্য তাদের ব্যাপারে খুব বেশী ফাইল আমাদের হাতে নাই, অন্তত PLFP তে। অন্য কোন সংগঠনে হয়ত থাকতে পারে বাংলাদেশি দের ব্যাপারে আরো কোন বিস্তারিত। “
১৯৮২ সালে লেবাননে জাতিসংঘের বাহিনী মোতায়েন হবার পর তারা লেবানন ছাড়া শুরু করেন। অনেকেই শহীদ হয়ে যান যুদ্ধে, অনেকেই ইসরায়েলের হাতে আটক হয়ে অনেকদিন পর ছাড়া পান। কেউ কেউ লেবাননেই বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। এখনও হয়ত খুজলে কোন কোন বাংলাদেশি বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পাওয়াও যেতে পারে বৈরুতের কোন গলিতে, আর সাথে সাথে পাওয়া যেতে পারে চাপা পড়ে যাওয়া এক ইতিহাস।
কামাল মুস্তাফা আলী: একজন বীর এবং শহীদ
দক্ষিণ লেবাননের শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পের অদূরেই একটা কবরস্থান। ১৯৭০ থেকে শহীদ হয়ে আসা ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামের শহীদদের সমাধি এখানে। একটু খুজলেই কিছু বিদেশী ব্যক্তির কবর চোখে পড়ে। বেশ কিছু লেবানিজ, সিরিয়ান, তিউনিশিয়ান, ইরাকী বা দু একজন কুর্দ, রাশিয়ান শহীদের কবরের মধ্যে চোখ আটকে যায় ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি কবর ফলকে। বাংলাদেশি সে শহীদের নাম কামাল মুস্তাফা আলী।
কামাল মুস্তাফা আলী কে বা তার বাড়ি বাংলাদেশের কোথায় কিংবা তার জন্ম কবে এর কিছুই লেখা নাই কবর ফলকে। শুধু নাম, দেশ, শহীদ হবার স্থান-সময় এবং পবিত্র কুরআনুল কারিমের একটি আয়াত সেখানে লেখা আছে।
وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فِى سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
“আর যারা আল্লাহ রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত”। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৬৯)
কামাল মুস্তাফা আলী শাহাদাত বরণ করেন ১৯৮২’র ২২ জুলাই এক দুঃসাহসী লড়াই এ। দক্ষিণ লেবাননের নাবাতিয়া এলাকায় অবস্থিত হিগ রক দূর্গে ইসরায়েলীদের হাতে তিনি শহীদ হোন। সুপ্রাচীন এই দূর্গটি Beaufort Castle নামেও পরিচিত। অবস্থানগতভাবে এই দূর্গটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এই দূর্গে বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে হাজার বছর ধরে। সেই ক্রুসেডার এবং সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সময়ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক লড়াই এবং সংঘাতের সাক্ষী এই দূর্গ। ১৯৭৬ সাল থেকে এই দূর্গটি ফিলিস্তিনীরা নিয়ন্ত্রণ করত এবং ইসরায়েল সীমান্তে লড়ায়ের জন্য একটি মজবুত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৮২ সালের ৬ জুন লেবানন আক্রমণ করে ইসরায়েল এবং বৈরুতে ঢোকার পথে তাদের প্রথম দফা টার্গেটে ছিল হিগ রক ক্যাসল। ইসরায়েলে র স্থল এবং বিমান হামলার ভয়াবহতার মুখেও ২ দিন এই দূর্গের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাথে ফিলিস্তিনীরা। কঠিন প্রতিরোধের মুখে বেশ বেগ পেতে হয় ইসরায়েলকে দূর্গের পতন ঘটানোর জন্য। কামাল মুস্তাফা আলী সেই সৈন্যদেরই একজন যারা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য লড়ে গেছিল এবং শেষ রক্তবিন্দুটিও ইসলামের শত্রুদের মোকাবিলায় ঢেলে দিয়েছিল।
মুস্তাফা কামাল আলীর লাশ পাওয়া যায় ২০০৪ সালে, জার্মানীর মধ্যস্থতায় হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের এক বন্দী বিনিময় চুক্তির পর। এই চুক্তিতে হিজবুল্লাহ ৪ জন ইজরাইলি সৈন্যের বিনিময়ে প্রায় ৪০০ জনকে ছাড়িয়ে আনে ইসরায়েলী জেল থেকে। এছাড়া ইজরাইলিদের হাতে শহীদ হওয়া ৫৯ জনের লাশও ফেরত পায় হিযবুল্লাহ যার মধ্যে একজন ছিলেন এই মুস্তাফা কামাল আলী। বোনাস হিসেবে পাওয়া যায় দক্ষিণ লেবাননের পরিত্যক্ত এলাকাগুলোতে ইসরায়েলে র পুতে রাখা মাইনের নক্বশা ।
ধারনা করা হয় যুদ্ধরত অবস্থায় সেই দূর্গে অথবা আহত অবস্থায় ইসরায়েলের কারাগারে শহীদ হোন তিনি। শহীদ মুস্তাফা কামাল আলীর লাশ দাফনের জন্য বাংলাদেশে তাঁর গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয় এবং তাঁর মহান ত্যাগ ও বীরত্বকে স্মরণ করে একটি কবর রাখা হয় ফিলিস্তিনী শহীদদের পাশেই। সেই কবরের ফলকে তাঁর নাম, দেশ এবং শাহাদাতের সময়-স্থান উল্লেখ করা আছে। ফিলিস্তিনীদের আজাদীর সংগ্রামে ইতিহাসের অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের অবদানও স্বর্ণক্ষরে লেখা আছে সেখানে।
আল্লাহ তাঁদের সবাইকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন এবং আজকের ফিলিস্তিনকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নেবার জন্য এরকম যুবকদেরকে আবার দলে দলে বায়তুল মুকাদ্দাসের পথে কবুল করে নিন। আমিন