:: মারুফ মল্লিক ::
গত শতকের ৬০, ৭০ ও ৮০’র দশক ছিল সামরিক শাসকদের রমরমা সময়। দেশে দেশে কুদেতা। গণতান্ত্রিক শাসন নির্বাসিত। কথায় কথায় গনতন্ত্রপন্থীদের ধরে নিয়ে গুম করে দিচ্ছে সামরিক শাসকরা। দক্ষিণ আমেরিকার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। ১৯৬৪ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থানে বামপন্থী হোহাও গৌলার্তের সরকারকে হাটিয়ে ব্রাসিলে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।
জাতি গঠন, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, উন্নয়ন নানা চটকদার করে বলে সামরিক শসকরা যখন ব্রাসিলের জনসাধারনের টুঁটি রীতিমত চেপে ধরেছেন তখনই ফুটবল মাঠ ফুড়ে বের হলেন এক বিপ্লবী। পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ফুটবলকেই পেশা হিসাবে বেছে নিলেন। মার্কসবাদী এই ফুটবলার মাথায় নানা রাজনৈতিক স্লোগান লেখা ব্যান্ড লাগিয়ে মাঠে নামতেন। হাসপাতালের নার্সদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খাটলেন।
চেইন স্মোকার এই খেলোয়ারের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে ব্রাজিলিয়ান লিগ কাপের ফাইনালে সাওপাওলোর বিপক্ষে খেলায় ঐতিহ্যবাহী করিন্থিয়াস তাদের জার্সি তে ‘Democracia’ শব্দটি লিখে খেলতে নামে। খেলোয়ারদের হাতে ব্যানারে লিখা ছিল, “Win Or Lose, But Always With Democracy”। তিনি গড়ে তুলেন করিন্থিয়াস ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট। করিস্থিয়াসের ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে দুই মিলিয়ন মানুষের সমাবেশে যোগ দিয়ে জোড়ালো কণ্ঠে দাবী তুলেন, আমরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরতে চাই। আমার ভোট আমি দিতে চাই। আমার ভোটে শাসক নির্বাচিত করতে চাই্।
নানা আইন কানুন দিয়ে সামরিক শাসক যখন ব্রাজিলিয়ান নাগরিকদের জবান বন্ধ করে রাখছেন তখন করিস্থিয়াসের এই অভিনব প্রতিবাদ শাসকদের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। ফুটবলারদের জান্তাবিরোধী প্রতিবাদ সারাবিশ্বকে আলোড়িত করে।
যার নেতৃত্বে এই প্রতিবাদ, জান্তাবিরোধী আন্দোলন তিনি হলেন ব্রাসিলের অমর ফুটবলার সক্রেটিস। সক্রেটিস বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। কিন্তু ব্রাসিলের জন্য গনতন্ত্রকে জয় করে এনেছিলেন। সারা বিশ্বের কোটি কোটি নিপিড়ীত মানুষেরর মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। ফুটবলের মাঠে, রাজপথ সব জায়গাতেবই ছিল সক্রেটিসের সদর্প উপস্থিতি।
সক্রেটিসকে বলা হয় রাজনৈতিক ফুটবলার বা পলিটিক্যাল ফুটবলার। ফুটবলের পাশাপাশি গ্রামসির অনুসারী সক্রেটিসকে সারাবিশ্ব মনে রাখবে তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য। তিনি ফিদেল ক্যাস্ত্রো, চে গুয়েভেরা ও জন লেলনের ভক্ত ছিলেন। ঝাকড়া চুল, দাড়ি ও হেডব্যান্ডের জন্য সুপরিচিত সক্রেটিস ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যাওয়ার এক অফুরন্ত অনুপ্রেরনার উৎস।
৪ ডিসম্বের ছিল এই রাজনৈতিক ফুটবলার মৃত্যুদিবস। না ভুল বললাম। সক্রেটিসদের মুত্যু হয় না। এরা যুগ যুগান্তরে বিরাজ করেন। ২০১১ সালের এই দিন সাওপাওলোর এক হাসপাতালে অনন্ত অসীমের পথে যাত্রা করেন সক্রেটিস।
কোরিয়ার সঙ্গে ব্রাসিলের গোলগুলো পেলের সুস্থতা কামনার পাশাপাশি আজীবন বিপ্লবী সক্রেটিসের উদ্দেশে উৎসর্গ করা যেতে পারে। আজকে আমাদের দেশে গণতন্ত্র নেই। ভোটাধিকার নেই। রাতের বেলায় ভোট হয়ে যায়। গুম, খুন, জেল, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হতে পারেন সক্রেটিস। কোনোভাবেই আমাদের সাকিব, মাশরাফি না।
ড. মারুফ মল্লিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক