:: ফেনী বুলবুল ::
আমাদের এলাকাটি মুসলিম এবং হিন্দু ধর্মালম্বী মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ছোটবেলা থেকেই আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মধ্যেই বেড়ে উঠেছি। আমাদের প্রিয় দাদাদের তালিকায় যেমন বারিক দাদা আলতু দাদা ছিল তেমনি বকসী দাদাও ছিল, যেমনি হোসেন কাকা মোস্তফা কাকা ছিল তেমনি জগদীশ কাকাও ছিল, যেমনি বাবুল ভাই জাহাঙ্গীর ভাই ছিল তেমনি সঞ্জুদা-ও ছিল, যেমনি বন্ধু জামাল সবুজ ছিল তেমনি শ্যামল প্রবীরও ছিল। স্কুলে যেমনি প্রিয় স্যার জাকারিয়া কামাল ছিল তেমনি গোপাল স্যার নারায়ন স্যার অমল স্যারও ছিল।
সেই সময়ও রাজনীতি ছিল ভিন্নমত ছিল কিন্তু, বিদ্বেষ সহিংসতা ছিলনা। তরুন ছিল তারুন্যতা ছিল প্রবীণদের প্রতি অসন্মান ছিলনা। খেলাধুলা সাহিত্য সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল কিন্তু, ভয়ংকর মাদকের ছোবল ছিলনা। ক্লাব ছিল আড্ডা ছিল চাঁদাবাজী ধান্ধা ছিলনা।
এই বৈরাগীর বাজার এর হাজারও স্মৃতি গেঁথে আছে মনে।আমাদের বৈরাগীর বাজারে নবারুন সংঘ নামে একটি ক্লাব ছিল। ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমাদের চাচা জসিম উদ্দিন মিয়া (জসিম মিয়া)। জসিম কাকা ছিলেন সভাপতি আর সঞ্জুদা ছিলেন সেক্রেটারি। সঞ্জুদা যখন বড় বড় চুল এবং দাড়ি রাখলেন তখন আমারা সঞ্জুদাকে সক্রেটিস নামে সম্বোধন শুরু করি। কারন সঞ্জুদাকে দেখতে লাগতো ঠিক তখনকার বিশ্ব বিখ্যাত ব্রাজিলের ফুটবল তারকা সক্রেটিসের মতো। নবারুন সংঘের পরিচালনায় কেরাম, বলিবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট ও ফুটবল সব খেলার আয়োজন হতো। এই সব খেলার সাথে সাথে হতো কথার বাহাস যা থেকে সবাই খুব আনন্দ পেত। নবারুন সংঘের অনেক আয়োজনের মধ্য হতে একটি আয়োজন ছিল শীতকালীন বনভোজন। জসিম কাকা একবার নবারুন সংঘের ব্যানারে আমাদের সবাইকে নিয়ে বনভোজনে গেলেন টেকনাফ এবং কক্সবাজার। আমি অদ্যাবধি দেশে বিদেশে বেশকিছু ভ্রমনে গিয়েছি কিন্তু আজও আমার কাছে জীবনের সেরা আনন্দময় ভ্রমন নবারুন সংঘের সেই বনভোজন।
রাতের বেলায় আমরা রওয়ানা দিব রিজার্ভ করা বাসে, সেইভাবে সব আয়োজন। বাসের কাছে গিয়ে দেখলাম একটা বাসের ছাদে ডেকরেটরের বড় বড় পাতিল এবং আরেকটি বাসের ছাদে লাকড়ি। একটি বাসের পিছনের সিটে কতগুলো জ্যান্ত ছাগলখাসী অন্য বাসের পিছনের সীটে মুরগির খাঁচা। কাকা বললো সব কিছুই এখান থেকে নিয়ে যাবে এবং সব কাজই নিজেরা নিজেরা করতে হবে। সকল প্রস্তুতি নিয়ে অবশেষে আমরা রওয়ানা হলাম। আমার সিট হলো পিছনে ছাগলখাসী রাখা বাসে। রাতের বেলায় চলছে বাস আর বাসের ছাদে সেট করা মাইকে বাজছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অমৃতসম গান, আহ্ কি যে ভালো লাগছিল। কারো চোখে যেন ঘুম নাই, চলছে গল্প। বাসের পিছনে থাকা ছাগল ভ্যাঁ ভ্যাঁ ডাকতেই সঞ্জুদা বললো কিরে লাতু ভাইয়ের গলা কি ঠান্ডায় বসে গেল নাকি ! লাতু মিয়া পেছন থেকে বলে আমার গলা বসে নাই ছাগল গুলা জিজ্ঞাসা করছে কিরে আমাদের সাথের দাড়িওয়ালা ছাগলটা কৈ ? এমন হাসি তামাসা চলছে সারাপথে। মাঝে কেক কমলা সিদ্ধডিম খাওয়ালো সবাইকে। চলতে চলতে কখন যে সবাই বাসের সিটে ঘুমিয়ে গেছি টেরই পাই নাই। হঠাৎ করে চিৎকার হুড়াহুড়িতে জেগে যাই, বাস দেখি বন্ধ, সবাই নেমে সামনে থাকা আমাদের অন্য বাসের দিকে দৌড়াচ্ছে। বুঝলাম আমাদের ঐ বাস কোন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। উৎকন্ঠার সাথে আমিও নেমে দৌড়ে ঐ বাসের কাছে গেলাম এবং দেখছি মোস্তাফা কাকাকে জসিম কাকা বকাবকি করছে এই বলে – গালিভারের মতো খালি দেহ হইছে বুদ্ধি শুদ্ধি আর হলো না। আমি কিছুই বুঝতেছিলাম না, শুধু দেখলাম মোস্তাফা কাকাকে একজন ধরে গাড়িতে উঠাচ্ছে। পরে বাসে উঠে যেটা শুনলাম তা হল – টেকনাফের খাড়া ঢালু রাস্তায় বাস উঠতে গেলে সামনে অন্য বাস থাকায় ড্রাইভার বাস জোরে টানতে না পারায় ব্রেক করে এবং হেল্পারকে জাম লাগা জাম লাগা বলে চিৎকার করে (কাঠের টুকরা চাকার পিছনে দেয় যাতে গাড়ি পিছনে না যায়)। ঘুমের ঘোরে মোস্তাফা কাকা এবং জাহাঙ্গীর ভাই ভাবছিল গাড়ি একসিডেন্ট হচ্ছে তাই ড্রাইভার সবাইকে জাম্প করতে বলছে। তারা দু’জন জানালা দিয়ে জাম্প দিয়ে নামতে গিয়ে হাঁটুর চামড়া ছেঁড়ে ফেলেন এবং ব্যাথা পান। বাকি সময়টুকু সবাই এই ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করে কাটায়। মোস্তাফা কাকা লম্বা চওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সহজ সরল হাসিখুশি এক মানুষ। তাকে সবাই দুস্টুমী করে গালিভার নামে ডাকতেন।
সকাল বেলায় পৌঁছায়ে দেখলাম তাবু টানানো হলো এবং বুঝলাম টেকনাফে কোন হোটেল ভাড়া করা হয়নি আমারা তাবুতেই বিশ্রাম নিব। বিষয়টা আমাদের কাছে দারুণ মনে হয়েছে। অন্য দিকে দেখলাম ইটের চুলা বসিয়ে নিকুঞ্জদা রান্না শুরু করলেন। আমারা নাফ নদীতে গোসল করি জেলেদের মাছ ধরা দেখি। তখন বিডিআর এর এত কড়াকড়ি ছিল না। তাছাড়া সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক বিডিআর কর্মকর্তা জসিম কাকার পরিচিত ছিল। আমারা দুপুরের খাবার খেয়ে কক্সবাজার চলে আসলাম। কক্সবাজারে সন্ধ্যায় ঘোরাঘুরির পর দেখলাম হোটেলে কিছু রুম নেয়া হলেও জসিম কাকাসহ বড়দের বেশীর ভাগই বাসে রাত কাটিয়েছিলেন খরচ কমানোর জন্য। আমাদেরকে হোটেলে থাকার সুযোগ দিলেও আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বাসের কাছেই বড়দের আড্ডায় ছিলাম। সেই রাতে আরেকটা মজার ঘটনা ঘটলো। বাসের অদুরে হোসেন কাকা দুর্শালার বলে চিৎকার করে বোকার মতো দাড়িয়ে আছেন আর পাশেই বাবুল ভাইয়া মাটিতে গড়িয়ে হাসতেছেন, এতটাই হাসতেছেন যে কথাই বলতে পারছেন না। জসিম কাকারা কার্ড খেলছিলেন, খেলা বন্ধ করে বাবুল ভাইয়ার কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে। বাবুল ভাইয়া যেটা বললো সেটা হলো কার্ড খেলার নেশায় হোসেন কাকা অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকায়ে ছিলেন, প্রসাব করতে বসে তাড়াহুড়া করে বসেন এবং অনেক সময় ধরে প্রসাব করেন, প্রসাব শেষে উঠে দাড়াতে গেলে থাস মতো শব্দ করে হোসেন কাকার পায়ের উপর কি যেন পড়ে। আসলে হোসেন কাকা সবটুকু পস্রাবই তার পরা নতুন লুঙ্গিতেই করেন।
এই নবারুন সংঘ এই বনভোজনের মোস্তফা কাকা, নিকুঞ্জদা আর জসিম কাকা তিনজনই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক দুরে, এতটাই দুরে যেখান থেকে আর কখনও ফিরে আসবেন না। দিন যত যাবে এই তালিকাও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে তবে, দূ:খ তারা চলে গেছেন স্বাভাবিক সময়েরও বহু আগে। পরম তাদেরকে শান্তিতে রাখুক।
সময়ের স্রোতে আমাদের মনমানসিকতা, চিন্তাচেতনা, জীবনধারা, নীতিবোধ বদলে গেছে – বদলে যায় কিন্তু, বদলায়না শুধু স্মৃতি। কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনের ফাঁকে দু-একদিনের জন্য বাড়ি গেলে স্মৃতিগুলো এমন করে হুল ফুটায় কাজে ফিরার পরও স্বাভাবিক হতে আমার সময় লেগে যায় অনেকদিন।