:: সাইফ হাসনাত ::
বাজার ও ভোক্তাদের তথ্য-উপাত্তের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান স্টাটিসটার মতে বাংলাদেশে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলোর মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি ফোনের অপারেটিং সিস্টেম হলো অ্যান্ড্রয়েড।
অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ, যারা অ্যামটব নামে বেশি পরিচিত, তারা বলছে যে বাংলাদেশে মোট মোবাইল ফোন ব্যবহারকারির সংখ্যা ১৮০ মিলিয়নের বেশি। সরকারি হিসেবে জনসংখ্যা ১৬০ মিলিয়নের কিছু বেশি, কিন্তু মোবাইলের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি কেনো— আশা করি এই প্রশ্ন কেউ করবেন না; কারণ অনেকেরই তো একাধিক ফোন আছে।
যা হোক, এই ১৮০ মিলিয়ন ফোনের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ফোন, বা ১৭১ মিলিয়ন ফোনই চলে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে। এই বিপুল সংখ্যক অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার, হ্যা, মাত্র ৫০ হাজার ব্যবহারকারী তাদের ফোনে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জনাব মোস্তাফা জব্বারের বিজয় কি-বোর্ড ইন্সটল করেছেন (ব্যবহার করছেন কি না, তা আমি জানি না। আমি বলছি ইন্সটল করেছেন)।
৫০ হাজার মানে হলো ১৭১ মিলিয়নের মাত্র ০.০২ শতাংশ!
আচ্ছা, পরিমাণটা একটু বাড়তে পারে অন্য হিসেবে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বা বিটিআরসির ২০২১ সালের ডিসেম্বরের হিসেব মতে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যাবহারকারি ১১৩ মিলিয়নের কিছু বেশি। আমরা যদি ধরে নেই যে এদের শতভাগই অ্যান্ড্রয়েড, তাহলে এদের মাত্র ০.০৪ শতাংশ তাদের ফোনে বিজয় কিবোর্ড ইন্সটল করেছেন।
অর্থাৎ বাংলা লেখার টুল হিসেবে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারিদের কাছে বিজয় অত্যন্ত নিম্নমানের একটি টুল।
এখন দেখা যাক অ্যান্ড্রয়েডে বাংলা লেখার আর কী কী উপায় আছে।
গুগল প্লে স্টোরের ওয়েব সংস্করণে গিয়ে আপনি যদি Bangla Keyboard লিখে একটু খোঁজাখুঁজির চেষ্টা করেন তাহলে দেখবেন প্রথম পাতায় যে ফলাফলগুলো আসে সেখানে বিজয়ের নামই আসে না।
প্রথম নামটি হলো রিদমিক কিবোর্ডের। যার ব্যবহারকারির সংখ্যা ৫০ মিলিয়ন। যে হিসেবে বিজয়ের ব্যবহারকারির সংখ্যা মোট মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারির ০.০৪ শতাংশ হয়েছিলো, সেই হিসেবে রিদমিক ব্যবহারকারির পরিমাণ হলো ৪৪ শতাংশ!
অ্যান্ড্রয়েডে বাংলা লেখার জন্য রিদমিকের নাম যে লেখায় আছে, সেই লেখায় বিজয়ের নাম নেওয়াটাই অশোভন মনে হচ্ছে!
রিদমিক কি-বোর্ডটি তৈরি করেছে রিদমিক ল্যাবস। এই কিবোর্ডে একাধিক লেআউটে বাংলা লেখা যায়। একই প্রতিষ্ঠানের রিদমিক ক্লাসিক কিবোর্ড নামে আরো একটি কিবোর্ড প্লে স্টোরে আছে। সেটিও অন্তত ১০ মিলিয়ন অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে ইন্সটল করা আছে।
যা হোক, এই লেখার উদ্দেশ্য হলো এই রকম অজনপ্রিয় এবং ব্যবহারবান্ধব নয় এমন একটি কিবোর্ড প্রিইন্সটল করা বাংলাদেশে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস বাজারজারত করার শর্ত হতে পারে?
জনাব মোস্তাফা জব্বার বলেছেন বাংলাদেশিরা যাতে ফোন কেনার পরই বিনামূল্যে বাংলা লেখার একটি টুল পান তাই ব্যবস্থা।
কিন্তু বাংলা লেখার তো আরো অনেক ফ্রি টুল আছে! এমন কি স্বয়ং গুগলেরই বাংলা লেখার জন্য ফ্রি লেআউট আছে! তারপরও বিজয় থাকতেই হবে— এই বাধ্যবাধকতা আমদানিকারক ও উৎপদানকারিদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্দেশ্য কী?!
বিটিআরসি হয়তো নিয়ম-কানুনের ফাঁদে ফেলে আমদানিকারক ও উৎপদানকারিদের বাধ্য করতে পারে, কিন্তু তাতে কি বিজয়ের ব্যবহার বাড়বে? এইভাবে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রি করা যায়?
বিটিআরসির সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত বিরক্তিকর, এবং নিঃসন্দেহে একটি কর্তৃত্ববাদী সিদ্ধান্ত। এবং অতি অবশ্যই এটি একজন মন্ত্রীর ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার (এটা কি বলার দরকার ছিলো?)।
আজকেই কোথায় যেনো পড়ছিলাম যে, কোনো দেশে যখন কর্তৃত্ববাদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়, তখন কেবল শাসকরাই কর্তৃত্ববাদি হয় না, বরং ওই শাসকগোষ্ঠীর বলয়ে থাকা, শাসকগোষ্ঠীর সুবিধাভোগি প্রতিটি শ্রেণিই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে।
পাওয়ার অ্যাবিউসের অসংখ্য ঘটনা আছে পৃথিবীতে। সেই সব ঘটনার সবচেয়ে বিশ্রী ঘটনাগুলো ঘটে গেছে অনেক অনেক আগে। সে সব আমরা পড়েছি ইতিহাসে, মনে হতো অনেক আগে ওই সব ঘটে গেছে, ওই রকম কিছু আর হবে না, অন্তত মানবসভ্যতার এই চূড়ান্ত সময়ে তা সম্ভব না; কিন্তু আমরা আসলে কতো ভুল, তাই না?
লেখক: সাংবাদিক