:: মুজতবা খন্দকার ::
আমার সাংবাদিকতায় আসার পেছনে অনুঘটকের মতো কাজ করেছিলো বিবিসি বাংলা। নষ্টালিকজিক স্মৃতি। বিবিসিতে এক সময় যার খবর,বিশ্লেষন শুনে রোমাঞ্চিত হতাম, তিনি আতাউস সামাদ। পরবর্তীকালে আমার শিক্ষক। আরো পরে তিনি আমার সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক এখন এ আমি ছিলাম, মূলত: একমাত্র রিপোর্টার। যদিও আমার পদবি ছিলো বিশেষ সংবাদদাতা, কিন্তু স্যার আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতেন প্রায় সব কাজ। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমার কাভার স্টোরি থাকতো এখন- এ। স্যারের পরামর্শ আর নির্দেশনায় মুলত আমি স্টোরি লিখতাম।
এটা অন্য প্রসঙ্গ। মূল কথা হচ্ছে বিবিসি বাংলা বন্ধ হয়ে গেলো। অথচ আশির মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত এই বিবিসি ছিলো আমাদের প্রিয় গণমাধ্যম। এরশাদে জমানায় বিবিসির সাড়ে সাতটার খবর শুনতে আমরা সবাই বসে পড়তাম। যেদিন এরশাদের পতন হলো.. সেদিন কি আয়োজন ছিলো আমাদের। বোঝাতে পারবোনা। তখন তো গণমাধ্যমের এত বাড় বাড়ন্ত ছিলোনা। সত্যিই খবর জানতে সবার ভরসা ছিলো ওই একটা বিবিসি রেডিও।
বাংলাদেশের খ্যতনামা অনেকেই বিবিসি রেডিওতে চাকরী করেছেন।খবর পড়েছেন,লিখেছেন,বিশ্লেষন করেছেন। কে নাই? সৈয়দ শামসুল হক, শফিক রেহমান, তালেয়া রহমান আরো বহু সাংবাদিক খ্যাতি পেযেছেন বিবিসিতে যোগ দিয়ে।
১৯৪১ সালে বিবিসি রেডিও বাংলা সম্প্রচার শুরু করে। ট্রান্সমিশন টানা ৮১ বছর চলার পর আজ ৩১ শে ডিসেম্বর ২০২২ রাতের অনুষ্ঠানের পরে বন্ধ হয়ে গেলো বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার।
শতবছর পূর্ন করতে পারলোনা বিবিসি বাংলা রেডিও। অথচ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবিসি সব সময় পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছিলো। ভয়েস অব আমেরিকাও অনেক সময় গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবার প্রবনতা দেখিয়েছিলো। কিন্ত বিবিসি কখনো আপোষ করেনি। সত্তর,আশি নব্বই এমনকি একবিংশ শতাব্দিতে এসেও বিবিসির খবর ছিলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরম আরাধ্যের বিষয়।আমার বাবা তো বিবিসির প্রবাহ কোনো একদিন মিস করলে,উশখুশ করতেন। মনে হতো কিইনা যেন তিনি মিস করেছেন! বৃটিশ পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। রিটায়ার্ড করার পর,তার রেডিয়ো ছিলো একমাত্র ভরসা। তার মধ্যে বিবিসির খবর আর প্রবাহ এবং প্রীতি নিন,প্রোগ্রামটা ছিলো আমার প্রযাত বাবার ভীষন পছন্দের।
নিজের বাবার কথা কি বলবো। নব্বই সালে আমি তখন গ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছি। নভেম্বর মাস, সেদিন ডাক্তার মিলন স্বৈরচারী এরশাদের পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো। বাসে আসছি। দৌলতদিয়া ঘাটে। ফেরির জন্য অপেক্ষা করছি। সব বাস ফেরিতে উঠলো,আমাদের বাস ড্রাইভারের খবর নেই। অনেক খোজখবরের পর বাসের হেল্পার জানালেন,ড্রাইভার বিবিসির সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার খবর শুনতে চার দোকানে আছে!
এমন জনপ্রিয় গণমাধ্যম হঠাৎ করে, কেন তার শ্রোতা হারালো?
এর পেছনে কাজ করেছে কিছু ভুল নীতি।আর অযোগ্য, দলকানাদের বিবিসি বাংলার শীর্ষ পদে বসানো। বিবিসির বাংলা বিভাগে ছিলেন সিরাজুর রহমান। যুগের পর যুগ। ছিলেন নাজির আহমদ,নুরুল ইসলাম,মানসি বড়ুয়া, কামাল আহমেদের মতন সাংবাদিক কিম্বা সংবাদ পাঠক কিম্বা সংবাদ বিশ্লেষক। অথচ ২০১০ সালের পর থেকে বিবিসি কাদের নিয়েছে। সাবির মুস্তফা বিবিসি প্রধান হবার আগে ছিলেন বিবিসির অনেক সংবাদকর্মীর মতো একজন। কিন্ত তিনি দায়িত্ব নেবার পর বিবিসি রেডিয়ো কেন গাডাডায় পড়লো?কেন শ্রোতাপ্রিয় একটি রেডিয়োকে কেন বর্জন করলো মানুষ।সাবির মুস্তাফার বাবা কেজি মুস্তাফা। দেশের স্বনামধন্য সাংবাদিক সম্পাদক ছিলেন। সর্বশেষ তিনি অস্থায়ী সস্পাদক ছিলেন সংবাদে। তার সস্পাদনায় প্রথম বেক্সিমকো মিডিয়ার ঘরে মুক্তকন্ঠ বেরিয়েছিলো। কিন্ত তিনি সফল হয়েছিলেন! হননি। কারন,তিনি প্রফেশনালিজমের চেয়ে বড় করে দেখেছিলেন হাসিনাকে ক্ষমতায় আনায়নে।
আতাউস সামাদ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিএনপি ৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম থেকে পার্লামেন্টারি ডেসোক্রেসিতে ফিরে আসে। এই জন্য সংবিধান পরিবর্তন হয়। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। আর যে দিন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। সেই শপথ পড়ার পররপরই বিবিসির পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার একটা ইন্টারভ্যু করেন আতাউস সামাদ। আমার প্রিয় স্যার।
একবার আমি ড. কামালের হোসেনের একটা ইন্টারভ্যু করেছিলাম। সেই ইন্টারভ্যু এডিট করার সময় স্যার আমাকে বলেছিলেন,খালেদা জিয়াকে কিভাবে ইন্টারভ্যু করতে রাজী করেছিলেন.. তার নেপথ্যের ঘটনা।স্যার হাসতে হাসতে বলছিলেন, শোনো মুজতবা! আমি খালেদা জিয়ার ইন্টারভ্যু একাধিকবার করেছি,সেসব ছিলো টেলিফোনে এরশাধবিরোধী আন্দোলনে।একানব্বই সালে আমি যখন,খালেদা জিয়ার ইন্টারভ্যু নিতে আগ্রহী হই। তিনি তখন আমাকে চিনেননা। কারন,এতদিন তো টেলিফোনে কথা বলেছি,উনি তো আমাকে চোখে দেখেননি! কিন্তু তাঁর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আমি বেশ অনুরাগি ছিলাম। আমার প্রস্তাব তার কাছে গেলে,তিনি প্রথমেই নাকচ করে দেন। বলেন, আমি আতাউস সামাদকে চিনিনা। লন্ডন থেকে কেউ এলে দেখা যাবে।আমি পড়লাম মহবিপদে। সিরাজ ভাই (সিরাজুর রহমান) আমাকে তাগাদা দিচ্ছেন.. কি করি! এক প্রকার বঙ্গভবনের দরবার হলের সামনে চলে গেলাম, বললাম আমি আতাউস সামাদ। কি জানি,কি ভেবে.. তিনি হাসি দিয়ে বললেন.. বিবিসির! হ্যা সূচক মাথা নাড়াতেই! কাজ হলো!
এই হলো বিবিসি রেডিও।
অথচ সেই বিবিসি আজ বন্ধ হয়ে গেলো!
সাবির মুস্তফা ভুলে গিয়েছিলেন যে বিবিসি বাংলা ব্রিটিশ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত গণমাধ্যম; ব্যাংক-বীমা লুটের টাকায় পরিচালিত বাংলাদেশি গণমাধ্যম না। আমার বিশ্বাস যে শ্রোতাদের কাছে বিবিসি বাংলার বিশ্বস্ততা ৮১ বছরে মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন জনাব সাবির মুস্তফাও তা অস্বীকার করবেন না।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, এনটিভি