:: তাহসিন আহমেদ ::
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অবস্থিত ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে লাশ হলেন ৪৪ জন মানুষ। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাতী শাখার শিক্ষক লুৎফুন নাহার লাকি ও তার মেয়ে নিকিতা। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের মরদেহ আসে। এ সময় স্ত্রী-মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন গোলাম মহিউদ্দিন।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে ভবনটিতে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মরদেহ এই দুই হাসপাতালে আছে। এর বাইরে আরও মৃত ব্যক্তি থাকতে পারে।
এ ঘটনায় গুরুতর আহত ৮ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে এবং ১৪ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, তাঁদের সবার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালেও একজনের মরদেহ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন।
গতকাল রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন সাততলা। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া ওপরের তলাগুলোতেও রয়েছে আরও কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত এসব রেস্টুরেন্টে ক্রেতাদের ভিড় হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস হবার কারণে অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান। ফলে রেস্টুরেন্টগুলোতে ক্রেতাদের ভালো সমাগম ছিল।
দুই ঘণ্টা পর বেইলি রোডের আগুন নিয়ন্ত্রণে
রাজধানী বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে লাগা আগুন প্রায় দুই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে এই ভবনের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে লাগা আগুন ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নাগরিক নিউজকে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ভেতরে তল্লাশি করছি। আটকেপড়াদের জীবিত উদ্ধারে যতটুকু করা সম্ভব আমরা সেটা করার চেষ্টা করছি। বাকি পরিস্থিতি এখনো বলার সময় হয়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তারপরও ভেতরে ধোঁয়া আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। জীবিতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাচ্ছি।’
ইতালি প্রবাসী একজনের পরিবারের ৫ জন নিহত
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারকসহ (৪২) একই পরিবারের ৫ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বিষয়টি জানান মোবারকের চাচাতো ভাই সৈয়দ ফয়সাল।
তিনি বলেন, তারা রাত ৮টার দিকে সৈয়দ মোবারক তার স্ত্রী স্বপ্না (৩৮), মেয়ে সৈয়দা তাশফি (১৭), ছেলে সৈয়দা নূর (১৫) ও সৈয়দ আব্দুল্লাহকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন ‘কাচ্চি ভাইতে’ খাওয়ার জন্য। তারা সেখানে পৌঁছানোর পর এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তারা সবাই মারা যান।
সৈয়দ ফয়সাল বলেন, প্রবাসী মোবারকের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামে। তিনি ঢাকার মগবাজার এলাকায় থাকতেন। মোবারকের এক মাসের মধ্যে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আর যাওয়া হলো না।
আগুনে পুড়ে একটি একটি পরিবার শেষ
বেইলি রোডে আগুনে একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গের সামনে চিৎকার করছিলেন পীযুষ পোদ্দার। বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তাঁর বোন পপি, ভাগ্নে সান রায় (১০) ও ভাগ্নি সম্পূর্ণা রায় (১২)।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মর্গের সামনে কথা হয় পীযুষ পোদ্দারের সঙ্গে। তিনি জানান, ভাগ্নি সম্পূর্ণা পড়ত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর সান রায় পড়ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে।
পিযুষ পোদ্দার নাগরিক নিউজকে বলেন, রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে চলে যান। এসে দেখেন দাউ দাউ করে রেস্তোরাঁ জ্বলছে। কিন্তু কোথাও পপি, সম্পূর্ণ ও সানের খোঁজ পাননি। এরপর মধ্যরাতে ছুটে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। সম্পূর্ণা ও সানের মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু পপির কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
আগুনে নিহত ২০ জনের মরদেহ হস্তান্তর
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনে নিহত ২০ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রিফাতুল ইসলাম।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মরদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে জানান তিনি।
লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। রাতেই ঢাকা মেডিকেলে (ঢামেক) কলেজ হাসপাতালে নিহতদের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ। এরপর মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক (এএসআই) গোলাম হোসেন বলেন, নিহতদের স্বজনেরা যাদের শনাক্ত করেছেন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
আহতদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২২ জনের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
সাংবাদিকদের সামন্ত লাল সেন বলেন, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৩৩ জন এবং পাশের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে একজন মারা গেছেন। জরুরি বিভাগ ও বার্ন ইনস্টিটিউট এখনো আহত ২২ জন ভর্তি আছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটা ঘটনা। আমরা চেষ্টা করছি, যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের যেন সুস্থ করে তুলতে পারি। তবে আহত ২২ জনের সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক। অনেকের শরীরের বাইরের অংশে পোড়া নেই, কিন্তু ভেতরে পুড়ে গেছে।
‘আমরা এখনো মারা যাইনি, ছাদে আছি’
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আটকে পড়াদের মধ্যে রয়েছেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমরা এখনো মারা যাইনি, ছাদে আছি। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ। কল নয়, দোয়া করুন।’
বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন পোস্ট দেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভবনটির পাঁচতলা পর্যন্ত সব ফ্লোরে আগুন দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতরে অনেক লোক আটকা পড়েছে।
তারা আরও জানান, দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগার পর তা উপরের তলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত লোকজন উপরের দিকে উঠে যান। এ সময় ভবন থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে কয়েকজন আহত হন।
ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড (নিচতলা) থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। তবে শর্টসার্কিট না গ্যাসের কারণে হয়েছে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, আগুনের ঘটনায় মরদেহের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষার করা হবে। এই ঘটনায় কারো যদি দায়িত্বে অবহেলা থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিঁড়িজুড়ে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় মানুষ নিচে নামতে পারেনি
কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট যে ভবনে অবস্থিত সেই গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের অন্য ফ্লোরেও রেস্টুরেন্ট ছিল। যেগুলোর গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল সিঁড়িতে। আগুন লাগার পর এগুলো বিস্ফোরিত হওয়ায় মানুষ নিচে নামতে পারেনি।
রাত দেড়টার দিকে সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
আগুনে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে বেশিরভাগ মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে জানান তিনি।
ভবনে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘দ্বিতীয় তলা ছাড়া ভবনটার প্রতিটি ফ্লোরের সিঁড়িতে ছিল সিলিন্ডার। যেটা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ, আগুন লাগলে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়, যা ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। ভবনটা মনে হয়েছে অনেকটা আগুনের চুল্লির মতো।
তিনি আরও বলেন, আমরা তদন্ত করে দেখছি ভবনটা অত্যন্ত বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
বেইলি রোডে গিয়ে কেউ নিখোঁজ হলে ঢামেকে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের আগুনের ঘটনায় কেউ নিখোঁজ থাকলে, তাঁদের স্বজনদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
বৃহস্পতিবার রাতে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী নিখোঁজদের স্বজনদের উদ্দেশে এ অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, ভবনটি থেকে সবাইকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। স্বজনেরা সেখানে গেলেই সবার বিষয় তথ্য পাবেন।
ভবনটিতে একাধিক রেস্টুরেন্ট, তৈরি পোশাক এবং মোবাইল ফোনের দোকান ছিল। সাত তলা ভবনের প্রতিটি তলা আগুনে পুড়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে নাগরিক নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাজাহান শিকদার।
কমিটির সভাপতি করা হয়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে, তিনি ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স শাখার পরিচালক। সদস্য সচিব হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগ উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিনকে। সদস্য হিসেবে থাকবেন সংশ্লিষ্ট জোনের ডিএডি, সিনিয়র স্টেশন অফিসার এবং ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর।