:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
দেশের বাজারে ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের বেশির ভাগের মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া গেছে। এসব তেল খাওয়ার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
দেশের ভোজ্যতেলে ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি নিয়ে প্রথমবারের মতো সমন্বিত গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেশের বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংগৃহীত নমুনার প্রায় ৬৭ শতাংশের মধ্যে সহনীয় হিসেবে স্বীকৃত মাত্রার (২ শতাংশ) চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। খোলা সয়াবিন তেলের নমুনার ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ২৫ শতাংশ। আর পাম তেলের কোনো নমুনায় সহনীয় মাত্রার বেশি ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়নি।
ট্রান্সফ্যাট নামে পরিচিত এই ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডের (টিএফএ) ক্ষতিকর মাত্রা পরিশোধন প্রক্রিয়ার কারণে হতে পারে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, উচ্চতাপে ভোজ্যতেল পরিশোধন করা হয় বলে ট্রান্সফ্যাট বেড়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট পাবলিক হেলথ স্কুল, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি) ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের (জিএআইএন) যৌথ গবেষণায় এসব চিত্র উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহিনের নেতৃত্বে ১৩ জন গবেষক দুই বছর ধরে এই গবেষণা চালিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশে প্রথম সমন্বিত গবেষণা বলে দাবি করছেন তাঁরা।
গবেষণা জার্নাল ফুড কেমিস্ট্রি অ্যাডভান্সেসে চলতি মাসেই প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়, পাম এবং সয়াবিন তেল বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস। বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের প্রায় ৭০ শতাংশ পাম তেল এবং ২০ শতাংশ আসে সয়াবিন তেল থেকে। বাংলাদেশ তেল উৎপাদনকারী দেশ না হওয়ায় সিংহভাগই আমদানি করা হয় অপরিশোধিত তেল হিসেবে। পরে এই তেল পরিশোধনের পর মানুষের ব্যবহার উপযোগী করা হয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ এবং জুন-আগস্টে দেশের ৮টি বিভাগ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এই গবেষণা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগের তিনটি করে বাজার (একটি শহর ও দুটি গ্রামের) থেকে সংগ্রহ করে ১ হাজার ৫২১টি তেলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। মোট ১০৬টি ‘কম্পোজিট বা গুচ্ছ’ নমুনার ভোজ্যতেল পরীক্ষা করা হয়।
এর মধ্যে ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের ১৮টি ‘কম্পোজিট’ নমুনা ও ৪৯টি খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে খোলা তেলের নমুনা রয়েছে। পাম তেলের ব্র্যান্ডের নমুনা নেওয়া হয় ১১টি (কম্পোজিট)। খোলা পাম তেলের নমুনা নেওয়া হয় ২৮টি (কম্পোজিট)। পরে পাঁচটি কারখানা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
সংগৃহীত নমুনা ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। গবেষণাটির ফলাফল নিয়ে ৭ জানুয়ারি ফুড কেমিস্ট্রি অ্যাডভান্সে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের ১৮টি ’কম্পোজিট’ নমুনার মধ্যে ১২টিতে সহনীয় মাত্রার বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। খোলা ড্রামজাত সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে ১২টি ‘কম্পোজিট’ নমুনায় মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। পাম তেলের কোনোটিতে মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায়নি।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা করে। তা ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। সেখানে খাদ্যে এর সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, সয়াবিন তেলের নমুনায় গড়ে সহনীয় মাত্রার দুই থেকে চার গুণ বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। গবেষকেরা তেল উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেননি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিএফএ স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর। কারণ, এটি ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বা এলডিএল বৃদ্ধি করে এবং ‘ভালো’ কোলেস্টেরল বা এইচডিএল হ্রাস করে। এইচডিএলের চেয়ে এলডিএল বাড়লে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। তাই ট্রান্সফ্যাট বেশি গ্রহণ করা হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
পরিশোধনের সময় তেলকে উচ্চ তাপমাত্রায় রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পলিমার রূপান্তরিত হয়ে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডে (টিএফএ) পরিণত হয়। গবেষকেরা বলছেন, শুধু কারখানায় পরিশোধনের গলদ নয়, খাবার ভাজার জন্য বারবার একই তেল (পোড়া তেল) ব্যবহার করলে ট্রান্সফ্যাট বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন তেল আমদানি হয়। আমদানি করা তেলের প্রায় ৭০ শতাংশ পাম ও বাকিটা সয়াবিন তেল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) থানা আয়-ব্যয় জরিপ বলছে, ২০২২ সালে মাথাপিছু ভোজ্যতেল গ্রহণের হার ছিল দিনে প্রায় ৩১ গ্রাম, যা ২০১৬ সালে ছিল প্রায় ২৭ গ্রাম। ফলে দেখা যাচ্ছে, ভোজ্যতেল গ্রহণ বাড়ছে।
বিবিএসের একটি জরিপের তথ্য বলছে, দেশে ২০২০ সালে প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক ও হাট ডিজিজ)। দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এই কারণে। আর ট্রান্সফ্যাট হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
হৃদরোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার পেছনে মানুষকে উচ্চ হারে ব্যয় করতে হয়। অনেক পরিবারকে স্বজনের হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সম্পদ বিক্রি করতে হয়। দরিদ্র পরিবারগুলো অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসাই করাতে পারে না।