:: দীপিকা চক্রবর্ত্তী ::
আমাদের প্রেমের বয়স তখন ৬,বিয়ের বয়স ৪,আর আমাদের সন্তান অমিতের বয়স সবে দুই বছর।একদিন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বাবার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম বাচ্চাকে নিয়ে। বাচ্চার মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি,নিজের অসুস্থতা এবং তার ফলশ্রুতিতে বাবামায়ের নেতিবাচক কথাবার্তায় বিধ্বস্ত হয়ে ফিরলাম হুট করেই।সেদিন আমার ফিরে আসার কথা ছিলনা। ফিরে দরজায় তালা দেয়া নেই দেখে খানিকটা অবাক হলাম। আমার স্বামী আতিকের তো এই সময়ে বাসায় থাকার কথা নয়। তার তো অফিসে থাকার কথা।ব্যাগ থেকে চাবি বের করেছিলাম, তালা খুলবো বলে। চাবি হাতেই রয়ে গেল।কলিংবেল টিপছি ক্লান্ত ভঙ্গিতে।এক হাতে বাচ্চাকে কোলে নিয়েছি,অন্য হাতে কাপড়ের ব্যাগ।তার ই মধ্যে বারবার কলিংবেল টিপেও যখন দরজা খুলছিল না, তখন রাগে-কষ্টে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ফিরোজা ভাবী উঁকি দিলেন।
-আপনি ফিরেছেন ভাবী? খুব ভালো হয়েছে।ব্যাগ নামিয়ে রাখুন।এক গ্লাস পানি খেয়ে যান।দরজা খুলতে মনে হচ্ছে দেরি হবে।
এমন সময় খুঁট করে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় শব্দ হলো৷দরজা খুলে গেল। আতিকের মুখ দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।কিছুতেই চোখের জল আটকে রাখা গেল না।হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেলো।বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, অন্য হাতে আতিককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছি। একটু শান্ত হতেই চোখের কোণে ধরা পড়লো একটা নারীর অবয়ব। অবাক হবার পালা!
আমার ঘরে, আমার অবর্তমানে আরেকজন অপরিচিত নারী আমার স্বামীর সাথে! হতাশাজনক এবং চরমভাবে বিরক্তিকর ব্যাপার।
আমাকে সরিয়ে দিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ওই নারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আতিক,
-আমার কলিগ, তনু।অফিসের এসাইনমেন্ট আজ করছিলাম একই সাথে।
আমি শুনে গেলাম চুপ করে।কেন যেন মনে হচ্ছে আমার রিয়েকশন এ কারো কিছু যায় আসে না।মন খুব “কু” গাইছে।আমার ভালবাসা জানান দিচ্ছে,আতিক সত্য কথা ই বলছে।
আবার আমার বাস্তববুদ্ধি জানান দিচ্ছে,অফিসের এসাইনমেন্ট কেউ এভাবে করেনা।
সেদিন আমি চুপ করেছিলাম।কিন্তু কীভাবে যেন বুঝেও গিয়েছিলাম,আমাকে যেতে হবে অন্য কোথাও।আজ নয় কাল।তারপর কিছুদিন তালছাড়া,সুরছাড়া কেটে গিয়েছিল।আমি ছিলাম নিজের মতো।আতিক ছিল ওর মতো।বাসায় আর অফিস-এসাইনমেন্ট করতে হয়নি।কিন্তু অফিসের কর্মঘন্টা বেড়ে গেল। ফিরোজা ভাবীদের সাথে দেখা হলে, ভাবী যেন ইশারায় কিছু বলতে চান।আমি বুঝেও নাবুঝার ভান করি। আতিকের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয় মাঝেমধ্যেই। বাচ্চা এবং আমার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ সে দেয়না বলে আমার কষ্ট হতো। ও প্রথম দিকে এড়িয়ে যেতো।আমাকে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বলে খিল্লি করতো। পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন এর শিকার হিসেবে কাউন্সেলিং নিতে বলতো।তারপর,হাত তুলতে শুরু করলো।কানের পর্দা ফেটে গেলো।শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত আর ক্ষত নিয়েও চলতে লাগলাম এই সংসারে।ছোট বাচ্চা, চাকরি সামলে অন্য দিকে নজর দেবার সময় পেতাম না।নাক,মুখ গুঁজে সংসার করাই যেন নিয়তি আমার।
মাসকয়েক পর বিল্ডিং কমিটির সভা বসলো।আমাকে বিশেষ ভাবে ডাকা হলো সভায়।অনেকেই অভিযোগ করলেন,আমার অবর্তমানে গত সাত আট মাস থেকে আমার স্বামী আতিক,ওর ফিমেল কলিগ কে নিয়ে ফ্ল্যাটে অবস্থান করে।এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকবার আপত্তি জানিয়েছেন সরাসরি।কিন্তু আতিকের কোন হেলদোল না থাকায় আমাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
আমি শুনে আহত হই। সকলের সামনে থেকে মনে হয় যেন,মাটি ফুঁড়ে পাতালে ঢুকে যেতে পারলে সহজ হতো জীবন।অনন্যোপায় হয়ে সেদিনই বাচ্চা সহ বের হয়ে যাই,আজীবন করতে চাওয়া শতসহস্র প্রতিজ্ঞায় পূর্ণ সংসার থেকে। সে দেরি করেনি।ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দুমাসের মাথায় বিয়ে করে তার কলিগ কে নিয়ে আসে,বাচ্চা সহ।অথচ নিজের বাচ্চা, আমাদের অমিতের কথা ভাবার সময় হয়না তার।
বাবার বাসায় আদরে লালিত হবার অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ের পর আর হয়না। বাচ্চাসহ ডিভোর্সি মেয়ে যেন বিশাল এক বোঝা। তার উপর সেই মেয়ের যদি থাকে এক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু তাহলে তো কথাই নেই। মায়েদের জীবন কখনোই হয়না সরল। ক্লান্তি, বিষন্নতায় বাচ্চার উপরও বিরক্ত হই। নিষ্পাপ শিশুটাকে আঘাত করার অপরাধে নিজেকে আবার কষ্ট দেই। এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে, সীমাহীন যাতনায় শরীর,মন সবকিছু যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে আমার। প্রতিদিন বাচ্চার দুষ্টুমিতে বিরক্ত বাবা-মায়ের মুখ,তাদের বকুনি,শাসন, নেতিবাচক কথা সবকিছু যেন আমার দিকে ইঙ্গিত করেই বলে,
-তুমি একটা ভুল মানুষ কে বেছে নিয়েছিলে। আর তার শাস্তি দিচ্ছো আমাদের সবাইকে।
আমি,আমি একজন চিকিৎসক।একজন মা। যদিও আমার পরিস্থিতি অনুকূলে নেই, তবু একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াবার সংকল্প নিলাম।ফিরলাম কীভাবে?
বেসরকারি হাসপাতালের সীমিত বেতন দিয়ে,আলাদা বাসা ভাড়া করে বাচ্চাকে নিয়ে থাকার দুঃসাহস করে ফেললাম।প্রথম যে বাসায় উঠেছিলাম,তার ভাড়া ছিল দশ হাজার।ছোট একটা ঘর,একটা রান্নাঘর ;তাতে কোনক্রমে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারে।একটা বাথরুম, তাতে কাপড় ধুতে গেলেও বাইরে দাঁড়িয়ে ধুতে হয়…. এই নিয়েই আমার শুরু। নতুন শুরু বলা চলে।
বাচ্চাকে নিয়ে ডিউটিতে যেতাম প্রথম দিকে।সহকর্মীরা বিরক্ত হতেন।তারপর বাচ্চাকে বাসায় রেখেই বাইরে তালা দিয়ে, গ্যাস লাইন-বিদ্যুৎলাইন বন্ধ করে যেতাম।বাসাটা কর্মস্থলের পাশে হবার কারণে,কিছুক্ষণ পর পর বাচ্চাকে দেখে আসতাম।বুক ধুকপুক করতো সারাক্ষণ।কীভাবে পেরেছি, জানিনা, তবে পেরেছি।অমিত যখন তিন বছরের হলো,ততদিনে আমি খানিকটা সামলে নিয়েছি।বেতন বেড়ে তখন ২৫০০০ থেকে হয়েছে তিরিশ হাজার।মা-ছেলের তাতে হয়ে যেতো। তবে সমস্যা হলো অমিতের অটিজম ডেভেলপ করলো।আরেক দফা পরীক্ষা শুরু হলো, মাতৃত্বের।আত্মীয় পরিজনবিহীন, ডিভোর্সি এক মায়ের অটিস্টিক শিশুর থেরাপি,বাসা,চাকরি সব মিলিয়ে দিশেহারা হবার দশা। তবু দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছি। কাউকে কিছু বলিনি,কোন অভিযোগ করিনি কারো প্রতি,কোন আশা রাখিনি কারো কাছে। মনে মনে বলতাম,
“আমি নিজেও ডাক্তার।আমার বাচ্চার চিকিৎসা, দেখভাল আমি নিজেই করতে পারবো।”
নিজের সব জ্ঞান,অভিজ্ঞতা লাগিয়ে অমিতকে বড় করছিলাম। ৫ বছর বয়সে আমার অমিত টুকটাক কথা বলতে শিখলো। ৮ বছর বয়সে সে প্রথম বারের মতো মায়ের প্রশংসা করলো। একটা নীল শাড়ি পরেছিলাম সেদিন। অমিত অস্ফুট স্বরে বললো,
-মা,শাড়িতে তোমায় খুব মিষ্টি লাগছে।
সেদিন আনন্দে চোখে জল এসেছিল আমার।এতো আনন্দ এই জীবনে আমি কম ই পেয়েছি।
কিছুদিন আগে নজরে পড়লো,ছোট্ট একটা বাক্সে অমিত টাকা জমাচ্ছে।বললাম,
-বাবু, এটা কীসের টাকা??
লাজুক ছেলে একটু হেসে বললো,
-স্কুলে টিচার রা সবাই ঈদের সালামি দিয়েছেন।আর স্কুলে টিফিন খাবার জন্য যে টাকা দাও, তা থেকে কিছু জমেছে।আমি রেখেছি একজায়গায়।তোমাকে শাড়ি কিনে দেবো,মা।তুমি শাড়ি পরলে খুব সুন্দর লাগে।
আমি হেসে বললাম,
-ওরে, দুষ্টু ছেলে,আর এমনিতে সালোয়ার কামিজ পরলে বুঝি আমায় পচা দেখায়??
অমিত বললো,
-তোমাকে সবসময় মিষ্টি লাগে মা!
চোখের জল আড়াল করে আমি আমার অমিত কে দেখি।ওর বয়স এখন বারো।পড়াশোনায় পিছিয়েছে অনেক।এখন সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু এমন আদুরে ছেলেটাকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য দুনিয়ার সব সম্পর্ক কে পেছনে ফেলে আসার সিদ্ধান্ত আমার ভুল ছিল না তাহলে।
থাকুক আমার এক ঘরের সংসার,এক চিলতে রান্নাঘর,আর থাকুক মায়ের সীমিত সাধ্য। সন্তান কে নিয়ে মায়ের লড়াই টা কখনোই ছোট নয়। সে তো একটা বিশ্বযুদ্ধের সমান।
পুনশ্চ: একটা বাস্তব আশ্রিত গল্প। তবে নিজের জীবনের গল্প নয়।