:: মুজতবা খন্দকার ::
বর্তমান তৃতীয় বিশ্বে একজন রাজনীতিকের সাফল্য ব্যর্থতা মাপা হয় ক্ষমতায় দলকে নিতে পারলেন কি পারলেন না তার ওপর। একটি রাজনৈতিক দলের মহাসচিব কিংবা জেনারেল সেক্রেটারির পদ অনেকটা ইউরোপের ধনী ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজারের মত। সাফল্য না হলে তিনি যতবড়ই ম্যানেজার বা কোচ হননা কেন, তার দর্শন বাতিল। তাকে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হয়। তার অতীতের কোনো অবদানই তাঁর ক্লাব স্বীকার করতে চায় না। এটা হচ্ছে রুঢ় বাস্তবতা।
আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী যিনি একটি দলের মালিক, বার দু’য়েক নির্বাচনে হারার পর কর্মী, সমর্থকদের রাগ, অভিমান চাপা দিতে তাকেও বলতে হয়েছিলো, আমি দলের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালাম।
আর দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হচ্ছে জেনারেল সেক্রেটারী, কোনো কোনো দল সেটাকে বলে সেক্রেটারী জেনারেল। কথাটা যেভাবেই বলেন,ভূমিকা তার একই। লক্ষ্যটা হচ্ছে দলকে বিজয়ের বন্দরে নোঙ্গর করা। সরকারী দলের হলে তার প্রতি চাপটা একটু কম থাকে বিরোধী দলের মহাসচিব হলে তাকে নিত্য নানা গালমন্দ শুনতে হয়। দলের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট, ডেটিকেশন সব তখন বিধেয় হয়ে পড়ে। কেউ সেটা মনে রাখেনা। এটাই আজকের পৃথিবীর রাজনীতি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আমার সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে দেখা বিএনপির মহাসচিব যারা এই সময়ে ছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সজ্জন, নিপাট ভদ্রলোক। শিক্ষিত মার্জিত। বোধ করি বাংলাদেশের মত এত নোংরা পলিটিকসের জন্য তিনি বড্ড বেমানান। তবুও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, আর সবাইকে উপেক্ষা করে তাঁকেই মহাসচিব করেছিলেন ২০০৯ সালে। এটা তারেক রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার যেমন একটা উদাহরণ, তেমনি রাজনীতিতে সুস্থির পরিবেশ ফিরে আসুক সেটাও তার চাওয়া ছিলো বোধ করি। না হলে মির্জা ফখরুল বিএনপির রাজনীতিতে মহাসচিব হবার দৌঁড়ে কখনোও সামনের সারিতে ছিলেন না।
মির্জা ফখরুল ইসলামের বাবা একজন রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, এমএলএ হয়েছিলেন দু’দফায়। চাচা প্রয়াত মির্জা গোলাম হাফিজ ছিলেন বিএনপি নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের ৪র্থ স্পিকার। মির্জা হাফিজ ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারে ভূমিমন্ত্রী, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে স্পীকার এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু বিএনপিতে তাঁর ক্যারিয়ার অত সুবিদিত ছিলোনা।
যদিও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (অধুনা বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) একজন সদস্য এবং সংগঠনটির এস এম হল শাখার সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তিনি সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকত্তোর মির্জা ফখরুল বাহাত্তরে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন।
তবে ১৯৮৬ সালে পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মির্জা ফখরুল তার শিক্ষকতা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন এবং সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৮ সালের ঠাকুরগাঁও পৌরসভার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৮৮ সালে তিনি স্বৈরচার এরশাদের সামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যখন দেশব্যাপী আন্দোলন চলছে, তখন মির্জা ফখরুল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে মির্জা ফখরুল বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। একইসাথে তিনি জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তবে তাঁর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির হাতে খড়ি হয় বোধ করি ১৯৭৯ সালে।
জিয়াউর রহমানের তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী এস এ বারীর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়। ১৯৮২ সাল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর বারী পদত্যাগ করলে মির্জা ফখরুল। তাঁর শিক্ষকতা পেশায় পুনরায় ফিরে যান। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।
২০১৬ সালে মির্জা ফখরুল কাউন্সিলে মির্জা সাহেব মহাসচিব নির্বাচিত হলেও তার আগে থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে থাকেন। যে দায়িত্ব তাঁকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দিয়েছিলেন। খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর। সৌদিতে ওমরাহ পালেনে প্রাক্কালে।
মহাসচিব এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে এখনো তিনি তার পূর্বতন সতীর্থদের সময়কাল ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও একটা জায়গায় মির্জা ফখরুল সবার চেয়ে আলাদা। তিনি একমাত্র মহাসচিব যিনি পুরোটা সময় কাটাচ্ছেন বিরোধীদলে। বাকিরা সবাই মহাসচিব হয়েছিলেন সরকারী দলে থেকে। মহাসচিবের পাশাপাশি ছিলেন এলজিআরডি মন্ত্রী।
মির্জা ফখরুল ইসলাম সেই সৌভাগ্যবানদের একজন হতে পারেননি। তবে,বামপন্থি ছাত্রসংগঠন থেকে উঠে আসার কারনে, মাঝে মধ্যে তাকে একটু বিভ্রান্তিতে পেয়ে বসে বৈকি। কিন্তু তিনি সেটা পরক্ষণে শুধরে নেন। কিন্তু তার নিন্দুকেরা তাকে একচুলও ছাড়েনা। তাকে নানাভাবে দংশায়। তবে ওই যে বললাম তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতিকদের সফলতার মাপকাঠি হচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়া। কিন্ত সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন উন্নয়নের নামে যে ধরনের ফ্যাসিষ্ট সরকার ক্ষমতায়। যারা একটি মানবন্ধন ঠিকমত করতে দেয়না। যে সরকার হাজার হাজার গণতান্ত্রিক নেতাকর্মীকে প্রতিদিনই জেলে পুরছে। যেখানে খোদ ফখরুলের নামে গন্ডায় গন্ডায় মামলা।
সেই সরকারের বিরুদ্ধে মির্জা ফখরুল ইসলামের মত নেতা, বিএনপির মত একটা দলের একার কতটুকু কি করা সম্ভব? তার সাথে জিও পলিটিক্যাল নানা সমীকরণ তো আছেই। তাই দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবার, সব রাজনৈতিক দলের একমত হওয়াটা খুব জরুরী। সেই কনসেন্সাস কিংবা বোঝাপড়া আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল বলেন,কিংবা রাজনীতিকদের মধ্যে আদৌ কি আছে? অনেক রাজনৈতিক দলই তো আছে.. হালুয়া রুটির জন্য প্রতিদিনই সরকারের সাথে গাটচ্ছড়া বাধছে। অথবা বেঁধে আছে। তাহলে!
মির্জা ফখরুল ইসলামের আরেক চাচা উইং কমান্ডার এস আর মির্জা এপ্রিল ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যেটি মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত এই সরকার কর্তৃক ডাইরেক্টোরেট অব ইয়ুথ ক্যাম্পের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সুতরাং মির্জা পরিবারের এদেশের প্রতি কমিটমেন্ট আছে, আছে ভালোবাসা।
স্বাধীনতার স্বপ্ন, স্বাধীনতা কেন, কিসের জন্য সেটা তারচেয়ে আর কেউ বেশী বুঝে বলে আমি মনে করিনা। আর সেজন্যই বুঝি প্রেস ব্রিফিংয়ে সেটাই তিনি বার বার বলতে পছন্দ করেন। বিশাল সমুদ্রে যদি কোনো জাহাজ নিজের বন্দরের পথ হারিয়ে ফেলে,সেটা নানা কারনে হতে পারে। সেই নাবিকের অর্থাৎ ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপের কি পরিস্থিতি হয়, কেউ কি ভাবে,না সেই জাহাজের যাত্রি না অন্য কেউ।
মির্জা ফখরুল। এখন তেমন একজন। মহাকাব্যের বীরের মত একা, একজন। সবাই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া সাফল্য ভাগাভাগি করতে চায়! কিন্তু তারও যে কিছু কষ্ট আছে,বেদনা আছে সেটা কেউ বুঝতে চায়না। যাইহোক। জয় হোক আপনার মিষ্টার ফখরুল। তিমির রাত্রি পেরিয়ে একদিন আলোকজ্জ্বল সকাল হবেই.. এটাই আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, এনটিভি