:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
বুধবার (১ মে) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সন্ধ্যায় মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ব্রিফিংয়ে ডিবিপ্রধান জানান, মিল্টন সমাদ্দারের সংস্থার অপারেশন থিয়েটারের লাইসেন্স ছিল না। সেখানে অবৈধভাবে অপারেশন করা হত।
তিনি বলেন, বরিশালের উজিরপুরের মিল্টন সমাদ্দারের উত্থান নিজ পিতাকে পিটিয়ে। এই অপরাধে এলাকাবাসী তাকে বাড়িছাড়া করেন। এরপর ঢাকার শাহবাগে এসে একটি ফার্সেমিতে কাজ শুরু করেন তিনি। ওষুধ বিক্রির টাকা চুরি করায় সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি মিল্টন। এরপর মিঠু হালদার নামের এক নার্সকে বিয়ে করেন তিনি।
হারুন অর রশীদ আরও বলেন, বিয়ের পর ওল্ড এন্ড চাইল্ড নামের একটি কেয়ার সেন্টার স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন তারা। পরবর্তীতে মিরপুর এলাকায় চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামের একটি কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেন। তিনি খুঁজে গরীব বৃদ্ধ এবং বাচ্চা শিশুদের সেখানে নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় সে জানিয়েছে, তার কেয়ার সেন্টারে অপারেশন থিয়েটার আছে এবং সেখানে সে মানুষের সেবা প্রদান করেন। অপারেশন থিয়েটার থাকতে তো লাইসেন্স থাকতে হবে। তার লাইসেন্স ছিল না।
তিনি বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে আমরা অজস্র অভিযোগ পেয়েছি। সে বলেছে তার দুইটা আশ্রম রয়েছে। সাভারের আশ্রমে ৫ থেকে ৭ শত লোক রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই। আমরা তাকে নিয়ে এসেছি। কিছু অভিযোগকারী রয়েছে তারাও মামলার রুজু করবে।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, আমরা মিল্টনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করব- কত সংখ্যক মানুষ কাছে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। কত সংখ্যক মানুষ মারা গেল। তার আশ্রমে যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কিনা সেটাও তদন্ত করা হবে।
হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দার নিজেই কেন ডেথ সার্টিফিকেট নিজের স্বাক্ষরে তৈরি করেছেন এবং সেখানে ডাক্তারের কোনো সিগনেচার কেন নেননাই সেগুলো খুঁজে বের করা হবে। আমরা সবকিছু তদন্ত করে পরবর্তীতে আপনাদেরকে (সাংবাদিক) জানাব। আমরা তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পেয়েছি সেগুলো তদন্ত করে তাকে রিমান্ডে নিয়ে পরবর্তী বিষয়গুলো জানাব।
২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর মিল্টন সমাদ্দার চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পেশায় একজন নার্স।
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে দাফনের আগে মরদেহ কাটাছেড়া, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তুলে নেওয়া, ৮০০ জনকে দাফন ও দুস্থ মানুষদের সহায়তার নামে তোলা টাকার নয়ছয় নিয়ে সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশ করে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যম। অভিযোগের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি মিল্টন সমাদ্দার।
এছাড়া জাল মৃত্যু সনদ তৈরি এবং জমি দখলের মতো গুরুতর সব অভিযোগ এখন চাউর হচ্ছে। অসহায়-দুস্থ মানুষের সেবার কথা বলে গড়ে তোলা ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম ঘিরে তার অপকর্মের ফিরিস্তি এখন নেটদুনিয়ায় ভাইরাল।
মিল্টনের ভয়ংকর সব অপকর্মের অভিযোগের বিষয় আমলে নেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। জনস্বার্থে এ বিষয়ে কমিশন অভিযোগও গ্রহণ করেছে। ২৮ এপ্রিল মানবাধিকার কমিশন থেকে মিল্টনের অভিযোগের বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদন্ত করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও দ্রুত কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে বলা হয়।
একই সঙ্গে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে বলা হয়। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে ৩০ মে প্রতিবেদন দেওয়ার দিন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
মিল্টন সমাদ্দার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম আলোচনায় আসেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ার মাধ্যমে। রাস্তা থেকে অসুস্থ ও ভবঘুরেদের কুড়িয়ে ওই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দেন তিনি ও তার দল।
জনসেবামূলক এসব কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি নানা পুরস্কারও। সামাজিকমাধ্যমে মিল্টন সমাদ্দারের এসব কর্মকাণ্ডের রয়েছে ব্যাপক প্রচারণা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় মিল্টন সমাদ্দারের সেবামূলক কর্মকাণ্ডের রয়েছে ব্যাপক প্রচারণা। অসহায়-দুস্থ মানুষের সেবায় তিনি গড়ে তুলেছেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম। রাস্তা থেকে অসুস্থ ও ভবঘুরেদের কুড়িয়ে ওই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দেন তিনি। জনসেবামূলক এসব কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি নানা পুরস্কারও। তবে অভিযোগ রয়েছে, মিল্টন সমাদ্দার যতটুকু ভালো কাজ করেছেন, প্রচার করেছেন তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।
অনুসন্ধানে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
মিল্টন সমাদ্দারের দাবি, আশ্রমে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, তার আশ্রমে চিকিৎসার খরচ বাবদ প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়; যা অস্বাভাবিক।
আশ্রমের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মরদেহ দাফন করা হয়েছে বলে দাবি করেন মিল্টন। এসব মরদেহ রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি তার।
তবে অনুসন্ধানে উঠে আসে মিল্টনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সব মিলিয়ে ৫০টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে। এ ছাড়া রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫টির মতো মরদেহ দাফনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আজিমপুর কবরস্থানে ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কোনো মরদেহের দাফন হয়নি। তবে মিল্টন সমাদ্দারের দাবি অনুযায়ী ৯০০ মরদেহ দাফন করা হলে বাকি ৮৩৫টি মরদেহ কোথায় দাফন করা হয়েছে, তার কোনো সুদুত্তর পাওয়া যায়নি।