:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুরে গ্রেফতার হওয়ার কিছুক্ষণ পরই মুক্তি পেয়েছেন। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন আদালত চত্বর ছেড়েছেন তিনি।
এর আগে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রেফতার করা হয়। সাবেক পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্কের ঘটনা ধামাচাপা দিতে গোপনে অর্থ দেওয়ার মামলায় দুপুর সোয়া ১টার দিকে ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির কার্যালয়ে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। সেখানে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে তিনি ম্যানহাটনের আদালতে বিচারক জন মারচেন এর সামনে হাজির হন। দেশটির ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টকে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হতে হয়।
গতকাল দুপুরে আদালত ভবনের অনতিদূরে ট্রাম্প টাওয়ার থেকে বের হয়ে আদালতের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। আদালতে পৌঁছে বাইরে থাকা সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন তিনি। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে ট্রাম্প সমর্থক ও বিরোধী, গণমাধ্যমকর্মী এবং উৎসুক জনতার ব্যাপক ভিড় দেখা যায়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়াও পুরো নিউইয়র্ক শহরে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির কার্যালয়ে পৌঁছার পর হাতকড়া পরানো না হলেও তার আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। আদালতকক্ষে যাওয়ার আগে এখানেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার হন। পরে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। এরপর অন্যান্য প্রক্রিয়া শুরু হয়। আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকার সময় ট্রাম্প কোনো গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলেননি। গ্রেফতার হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট দেন—‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এটা আমেরিকায় ঘটছে।’ এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রেফতার হওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ডেমোক্র্যাট সিনেটর চাক শুমার আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ট্রাম্প নিশ্চয়ই আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় বাইরের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। আর বিক্ষোভ, প্রতিবাদ মার্কিন জনগণের অধিকার। তবে অবশ্যই তা শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে।’ চাক শুমার দুই ডেমোক্র্যাট সিনেটরের একজন, যিনি নিউইয়র্ক রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অন্যদিকে হোয়াইট হাউস থেকে এ মামলার বিষয়ে আগের মতোই কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
আদালতে উপস্থিত হতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য রিপাবলিকান মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে এগিয়ে থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার ফ্লোরিডার সমুদ্র সংলগ্ন বাড়ি থেকে নিউইয়র্কে পৌঁছেন। ফ্লোরিডার বাড়ির কাছের ওয়েস্ট পাম বিচ থেকে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিমান তাকে নিয়ে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর নিউইয়র্কের কুইন্সের লা গার্ডিয়া বিমানবন্দরে এসে নামে। নীল স্যুট ও লাল টাই পরা ট্রাম্প একাই বিমান থেকে নেমে একটি এসইউভিতে চড়ে ম্যানহাটনের ট্রাম্প টাওয়ারের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময় একটি গাড়িবহর তার এসইউভিকে অনুসরণ করে। ট্রাম্প টাওয়ারের সামনে নেমে ট্রাম্প উপস্থিত জনতার উদ্দেশে হাত নাড়লেও কোনো কথা না বলে হেঁটে ভেতরে চলে যান। সেখানে রাতযাপন করেন তিনি। তিনি উপস্থিত হওয়ার আগে থেকে সেখানে তার সমর্থকরা দলে দলে এসে জড়ো হতে থাকেন। তারা তার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। অন্যদিকে তার বিচারের দাবিতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেখানে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দেশ বিদেশের অনেক সাংবাদিক বিচার প্রক্রিয়ার খবর কাভার করার জন্য সেখানে উপস্থিত হন।
গত বৃহস্পতিবার ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড জুরি আদালত ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বা বর্তমান প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ট্রাম্প (৭৬) হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। স্টর্মি ড্যানিয়েলস নামে এক সাবেক পর্নো তারকা দাবি করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ২০০৬ সালে তার যৌন সম্পর্ক হয়েছিল। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে ট্রাম্প তাকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দেন। এ ঘটনায় ম্যানহাটনের আদালত সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করেন। ঘটনা অস্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন। ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এলভিন ব্র্যাগের দপ্তর জানিয়েছিল, নিয়ম অনুযায়ী ট্রাম্পকে আদালতে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে আর আদালতে হাজির না হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তার আত্মসমর্পণ ঘিরে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে আশঙ্কায় পুলিশ একদিন আগে থেকেই ম্যানহাটন আদালত ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়। ধাতব ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় ট্রাম্প টাওয়ার। বন্ধ করে দেওয়া হয় আদালত প্রাঙ্গণের সামনের রাস্তা।
আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ট্রাম্প নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডায় চলে আসেন। ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোয় নিজ সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি কড়া ভাষায় বিচারসংশ্লিষ্ট সবার সমালোচনা করেন।
ট্রাম্প তার বক্তব্য শুরু করেন এই বলে— ‘একমাত্র অপরাধ আমি যেটি করেছি, সেটি হলো, যারা আমাদের দেশকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের কাছ থেকে দেশকে নির্ভয়ে রক্ষা করেছি।’
এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় অভিসংশন করার বিষয়টিরও সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, একাধিক বিষয়ে তদন্ত করে তাকে আক্রমণ করা হয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, ‘শুরু থেকে ডেমোক্র্যাটসরা আমার ক্যাম্পেইনের ওপর নজরদারি চালিয়েছে। তারা আমার ওপর তদন্তের হামলা চালিয়েছে।’
এ ছাড়া ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি করে জো বাইডেন জয় পেয়েছেন বলে আবারও দাবি করেছেন তিনি।
এর পর নিউইয়র্কের ম্যানহাটন আদালতের জেলা অ্যাটর্নি আলভিন ব্রাগের কড়া সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। এই আলভিন ব্রাগই ট্রাম্পকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা করেছেন। অ্যাটর্নি ব্রাগকে উদ্দেশ্য করে ট্রাম্প বলেন, ‘আলভিন ব্রাগ একজন ক্রিমিনাল। তার বিচার হওয়া উচিত অথবা তার পদত্যাগ করা উচিত।’
ট্রাম্পের দাবি, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তথ্যগুলো মিডিয়ায় ফাঁস করেছেন ব্রাগ।
এ ছাড়া ট্রাম্প বলেন, ‘জেলা অ্যাটর্নির অফিসের একটি ওয়েবপেইজও ছিল। যারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এসব করেছে তারা সেখানে বৈঠক করত।’
এর পর ম্যানহাটন আদালতের বিচারক জুয়ান মার্চেনের সমালোচনা করেন ট্রাম্প। সাবেক প্রেসিডেন্টের দাবি, তার বিরুদ্ধে এমন একজন বিচারক বিচার করছেন, যার পুরো পরিবার ট্রাম্পবিরোধী। তিনি বলেন, ‘আমার একজন ট্রাম্প-ঘৃণাকারী বিচারক আছে, সঙ্গে আছে ট্রাম্প-ঘৃণাকারী স্ত্রী ও পরিবার।’
ট্রাম্পের দাবি, বিচারক জুয়ান মার্চেনের স্ত্রী তার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে টুইট করেছিলেন। অপরদিকে তার মেয়ে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের হয়ে কাজ করেছেন।
এর পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খারাপ। আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাশিয়া চীনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন? সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। যদি আমি আপনাদের প্রেসিডেন্ট থাকতাম তা হলে এর কিছুই হতো না।’
এ ছাড়া ট্রাম্প বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি দাবি করেন হান্টার বাইডেন নিজের ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ ঠিক করাতে দিয়ে সেটি নিতে ভুলে যান। এর পর ওই ল্যাপটপের ভেতর থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যেসব তথ্য থেকে জানা যায়, হান্টার তার পরিবারের পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চেয়েছিলেন। হান্টার ও জো বাইডেনসহ সবাইকে ‘ক্রিমিনাল পরিবার’ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।