রিজার্ভ কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ আরও কমে ১৯.৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। এর মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের আমদানি বিল বাবদ ১২১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক মঙ্গলবার রাতে জানান, আকুর দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে এখনো দেনা সমন্বয় করার ভাউচার পাওয়া যায়নি। যে কারণে রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ জানা যাচ্ছে না। তবে আকুর দেনা বাবদ যে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে, তা বাদ যাবে। একই সঙ্গে রিজার্ভে আরও কিছু ডলার যোগ হয়েছে, সেগুলোসহ আজ রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। 

আকুর সদস্য ৮টি দেশ দুই মাসের বাকিতে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করে। প্রতি দুই মাস পর এর মাধ্যমে দেনা-পাওনা সমন্বয় করা হয়। বাংলাদেশ আকুর সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে আমদানি বেশি করে, রপ্তানি করে কম। যে কারণে প্রতি কিস্তিতেই বাংলাদেশকে মোটা অঙ্কের দেনা একসঙ্গে পরিশোধ করতে হয়। এতে রিজার্ভ কমে যায়। 

আকুর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা দুই মাসের বাকিতে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে। 

আকু একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। তবে এখন আকুর সদস্য পদ নেই শ্রীলঙ্কার। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দীর্ঘদিন যাবত আমদানি ব্যয় পরিশোধের বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির আকু সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন গ্রস রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর শর্ত অনুযায়ী বিপিএম-৬ ম্যাথোডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫.৭৬ বিলিয়ন ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন। এখান থেকে আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।

মঙ্গলবার সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের আমদানির দেনা বাবদ ১১৭ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ দেনা পরিশোধ করার আগে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৫১ কোটি ডলার। দেনা পরিশোধ করার পর রিজার্ভ ২ হাজার ৫৩৪ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৭৫ কেটি ডলার থেকে কমে ১ হাজার ৯৫৮ কোটি ডলারে নেমেছে। 

রিজার্ভের চূড়ান্ত হিসাব করা হলে এর পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে। কারণ, এর মধ্যে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের আরও কিছু ডলার রিজার্ভে যোগ হবে। এতে রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বাড়বে। তবে নিট হিসাবে খুব একটা বাড়বে না। কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমদানির দায় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। 

গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এসব ডলার দিয়ে ব্যাংকগুলো আমদানির দায় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে। তবে এখন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে ব্যাংকগুলো এলসির দায় ও বৈদেশিক ঋণ শোধে হিমশিম খাচ্ছে। 

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বলা হচ্ছে ডলারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজস্ব উৎস থেকে ডলার সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য। এখন ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের বিপরীতে বাড়তি টাকা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। এতে কিছু ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ১৩ জুলাই থেকে বিপিএম-৬ নিয়মে রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বিপিএম-৬ অনুযায়ী, দেশে রিজার্ভ ছিল ২৩.৫৬ বিলিয়ন (২ হাজার ৩৫৬ কোটি) ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে রিজার্ভের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, ২ নভেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০.৬৬ বিলিয়ন (২ হাজার ৬৬ কোটি) ডলার। তার মানে, সাড়ে তিন মাসে রিজার্ভ কমেছে ২৯০ কোটি ডলার। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নেমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হল বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। এই শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারে রাখার কথা ছিল। কিন্তু পরে এসব শর্ত শিথিল করেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর থেকে রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩.৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলারে উঠে। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *