:: মাজহারুল ইসলাম রনি ::
আমি ফিরে যেতে চাই আমার শৈশবে সেই আশির দশকে (১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন জীবনযাত্রা এত জটিল ছিল না। সকালে ঘুম ভাংগতো পাশের বাসার খালুর সুন্দর কন্ঠে পবিত্র কুরআন তেলোয়াতে। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধোতে ধোতেই হুজুর চলে আসতো। আরবি পড়া শেষে হুজুর চলে যাওয়ার পর গোসল করে নাস্তা খেয়ে আম্মার সাথে স্কুলে যেতাম ‘চাঁদপুর পুরান বাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’। আম্মা এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। স্কুলের এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে পিটি করা, জাতীয় সংগীত শেষ করে ক্লাস রুমে ফেরা। লেজার পিরিয়ডে(টিফিন ছুটিতে) বন্ধুদের সাথে চোর পুলিশ খেলা। ছুটির পরে স্কুল গেইটে রহিমউদ্দীন মামার আচার খেতে খেতে আম্মার সাথে রিকশায় করে বাসায় ফেরা। রিকশা ভাড়া ছিলো মাত্র ১টাকা যেদিন বৃষ্টি হতো সেদিন ২টাকা।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকত প্রতিবাদ। ‘অমুকের মুক্তি চাই’, ‘অমুক থেকে মুক্তি চাই’ এর লাল লাল কালিতে হলুদ আর সাদা দেয়ালগুলা হয়ে উঠত একেকটা পেইন্টিং। তীব্র প্রতিবাদী পেইন্টিং। সময়টা ছিল স্বৈরশাসনের।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন আশেপাশে ছিলো না বিশাল বিশাল কাঁচের প্রাণহীণ দালান। দোতলা বিল্ডিং ছিলো হাতেগোনা অল্প কিছু, বাকী সব ছিলো সেমি পাকা, টিনশেড ও বাঁশের বেড়ার ঘর। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে সকাল ও বিকালের রোদের আরাম আলো খেলা করত মুখে। রাস্তায় ছিলো না দামী দামী গাড়ি আর তাদের কুৎসিততম হর্ণ। রিকশাই ছিলো একমাত্র যানবাহন। আর মালামাল পরিবহনের জন্য ছিলো ঠেলা গাড়ি। কদাচিৎ হোন্ডা দেখা যেতো।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন বর্ষাকালে কাদামাখা মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়ার সেই আনন্দঘন মুহূর্ত আর শীতকালে লাড়কির চুলার আগুনের পাশে বসে বানানো পিঠা খাওয়ার মজা।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। মনে পড়ে তখন থাণ্ডার ক্যাটস, উডি উড পেকার, টিন এজ মিউটন লিনজা টারটেলস এর কথা। যখন ইন্টারনেট আর মোবাইল নামক ‘সব মুশকিল আসান’ কোন বস্তুর প্রভাবই ছিলো না। বাড়ির উঠোনে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা ছিলো নিত্যদিনের সংগীর মতো। আর শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা ছিলো মাস্ট। মাগরিবের আযান দেবার সাথে সাথেই খেলা বন্ধ করে হাত পা ধুয়ে ঘরে ফিরে পড়ার টেবিলে বসতে হতো।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন টেলিভিশনের প্রোগ্রাম শুরু হত বিকাল ৫ টায়। শুক্রবার শুরু হতো বিকাল ৩টায়। শুরুতেই প্রচার করা হত পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত। আর শুক্রবার পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের পর কোন দিন গীতা পাঠ, কোন দিন বাইবেল পাঠ আর কোন দিন ত্রিপিটক পাঠ। এরপর প্রোগ্রাম শুরু হতো। শুক্রবার বিকাল ৩.১৫ মিনিটে প্রচার হতো থান্ডার ক্যাটস আবার কোন শুক্রবার টিন এজ মিউটন লিনজা টারটেলস। এরপর শুরু হতো বাংলা ছায়াছবি। যেটা দেখার জন্য পুরো ঘর মানুষে ভরে যেতো কারন তখন পুরো বাড়িতে টেলিভিশন ছিলো মাত্র দুটো।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন রাত ৮.৩০ এর মধ্যে পড়া শেষ করে টিভি সেটের সামনে বসে যেতাম ‘এ সপ্তাহের নাটক’ বা ‘ধারাবাহিক নাটক’ দেখার জন্যে। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, সংশপ্তক, পাথর সময়সহ আরো অনেক বিখ্যাত নাটক। এরসাথে সপ্তাহে থাকতো বিখ্যাত ইংরেজি টিভি সিরিজ নাইট রাইডার, ম্যাকগাইভার ইত্যাদি। তখন ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে বসে টিভি দেখতাম। বাসায় কোন সোফা ছিলো না।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)।
যখন দিনে শুধু দুইবার সংবাদ প্রচার করা হত। রাত ৮টায় বাংলায় ‘৮টার সংবাদ’ আর ১০টায় ইংরেজীতে ‘news at 10’। সংবাদের ঠিক আগে আগে প্রচারিত হত জীবন বীমা কর্পোরেশন এর বিজ্ঞাপন। এক বৃদ্ধ দম্পতিকে নিয়ে বানানো। এখনো মনে আছে বৃদ্ধা হুইলচেয়ারে বসিয়ে বৃদ্ধকে বাগানে নিয়ে যাচ্ছেন। মনে পড়ে টিভির সেই বিখ্যাত সুন্দর সুন্দর বিজ্ঞাপনের কথা।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন টিভিতে দেশের লোকজ কাহিনী নিয়ে হীরামন নামে একটা অনুষ্ঠান হতো। আম্মা ও নানু এই হীরামন দেখতোই। ওনাদের পাশে বসে আমি ও আমার ছোট বোনও দেখতাম।
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)।
এখনকার মত তখন ইংলিশ লীগ, লা লীগা, বুন্দেশলীগা, চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ছিলো না। ছিলো না মেসি, রোনালদো, নেইমার, এমবাপ্পে, সালাহ, র্যামোসদের মত আন্তর্জাতিক তারকা। কিন্তু ছিলো প্রাণের আবাহনী আর মোহামেডান। ছিল সাব্বির, কায়সার হামিদ, আসলাম, মুন্না, কানন, মহসীন, রুপু, ওয়াসিম এর মত লোকাল হিরো। যাদের ভিউকার্ড বিক্রি হত দেদারসে। বাড়ি বাড়ির ছাদে ঝুলত আবাহনী আর মোহামেডান এর আকাশী নীল আর সাদাকালো পতাকা। অনেক সময় স্কুল ছুটি দিয়ে দিতো আগে আগে যেদিন আবাহনী আর মোহামেডান এর খেলা থাকত!
আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে(১৯৮৬ – ১৯৯০)। যখন মামার সাথে বসে পেপার, ম্যাগাজিন ও বিভিন্ন বই (গল্প, উপন্যাস, রাজনীতি) পড়তাম। মামা যখন প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় (৭.৩০) বিবিসির বাংলা সংবাদ শুনতো তখন লুকিয়ে পাশের রুম থেকে দরজায় পাশে দাড়িয়ে বিবিসির সংবাদ শুনতাম। এই সংবাদে একটা শব্দ বেশ মনে ধরেছিল সেটা হলো ‘স্নায়ুযুদ্ধ’, যেটার অর্থ পরে বড় হয়ে বুঝেছিলাম। ঐসময়ে(১৯৮৯) মামার সাথে পেপার পড়েই জানলাম পরকীয়া প্রেমের জের ধরে শহীদ সাংবাদিক কন্যা রীমা খুন হন তার স্বামী তৎকালীন ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির নেত্রীর ছেলে মুনির এর হাতে। সারা বাংলাদেশ তোলপাড় করে দেয়া সেই খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া মুনীর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েও ব্যর্থ হন।
জীবনযাত্রা এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারা দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয় ৬ ইঞ্চি সাইজের মোবাইল ফোনটায়। সামাজিকতায় ইঁদুড় দৌড় দেয়ার জন্যে এখন গাড়িতে চড়তে হয়।
ফেসবুকের কল্যাণে এখন বন্ধু হাজার হাজার। আমার সময় এত কম যে, কোন অনুষ্ঠান প্রথম ১ মিনিট দেখে ভালো না লাগলে আমি চলে যাই অন্য অনুষ্ঠানে। কারণ আমার টিভিতে এখন ৩০০ চ্যানেল, নেটফ্লিক্স, আম্যাজন প্রাইম, হইচই, চরকি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাকে এখন আর সিড়ি ভাংতে হয় না উপরে উঠার জন্য। বাটন টেপা লিফট আমাকে নিয়ে যায় উপরে আকাশের কাছে। কিন্তু আমার আকাশটা এখন আর সেই আগের মতো মুক্ত নেই। আমি ফিরে যেতে চাই আশির দশকে (১৯৮৬ – ১৯৯০), যখন মুখ তুললেই আমি মুক্ত আকাশ দেখতে পেতাম।
আমি আমার শৈশবের সেই মুক্ত আকাশের কাছে ফিরে যেতে চাই।