:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার রেকর্ড হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি গত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে পৌনে তিনগুণ বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে শেষ মাস জুনে। ওই মাসে সরকারে নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল মাত্র ২৬ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটানোসহ বাজেট বাস্তবায়নের চাপে শেষ সময়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ শ্লথ গতির ছিল, অর্থবছরের শেষ সময়ে অর্থাৎ জুন মাসে ব্যাংক ঋণ অনেক বেড়েছে। কারণ সরকারের রাজস্ব আহরণ ও সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ কম এসেছে। যার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংক ঋণ বাড়ায় সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের মে পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা তাদের লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিবছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত। সাধারণত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ
নিলে বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয় ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। এতে বেসকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। তাই অর্থনীতিবিদরা বরাবরই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণের নিট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অর্থবছর শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যের নিচে থাকলেও বিগত কয়েক বছরের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৩০ জুন শেষে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষে যা ছিল ২ লাখ ২ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরজুড়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৭৪৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে ৪১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েও শেষ পর্যন্ত অনেক কম ঋণ নিয়েছিল। ওই অর্থবছরের পুরো সময়ে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ২৪ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। তবে তার আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে রেকর্ড ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার।
এদিকে চলতি অর্থবছরেও সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ বাজেটে মোট ঘাটতি অর্থায়নের ৪৩ শতাংশের বেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করা হবে। এবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৩৯ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি।
শুধু ব্যাংক ঋণই নয়, চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কিছুটা বাড়াতে চাইছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল।
বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতি মেটাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। যেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে মাত্র ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরে যে ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে তা আগের অর্থবছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
এদিকে শুধু গত জুনেই সরকার ৪৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আবার চলতি অর্থবছরেও ব্যাপক হারে ব্যাংক ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এদিকে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বাড়লে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ শ্লথ গতির ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক সেক্টর থেকে এই আগ্রাসী ঋণ নিয়েছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার বাজেটের প্রায় আড়াই লাখ কোটিই থাকছে ঘাটতি। এই ঘাটতি বিদেশি ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মেটাবে সরকার। চলতি অর্থবছরের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়া বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ, ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে সরকার। টাকার মান ও সুদ হার কমায় ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি নিন্মমুখী। তাই সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। গত চার অর্থবছরের বাজেটে দেশের ব্যাংক খাতে সরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। রাজস্ব আদায়ে কাংখিত গতি না এলে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা আরও বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বলা হচ্ছে, আমদানি ব্যয় মেটাতে অর্থের চাহিদা বাড়ছে। উন্নয়ন ব্যয় চালিয়ে যেতেও দরকার অর্থ। তবে, চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ আয় কম। তাই বৈদেশিক ঋণ এবং ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছে সরকার। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থ এলেও সুদ ব্যয় বাড়ায় তা অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার কঠিন হচ্ছে। কিছুদিন আগেও সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কম ছিল। উল্টো আগের নেয়া ধার পরিশোধ করেছে সরকার। তবে, সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে যে ঋণ নেয়া হয়েছে, তা গেল তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
গত ৩০ জুন শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষে যা ছিল ২ লাখ ২ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরজুড়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ ৭২ হাজার ৭৪৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ৪১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ার বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ মুহূর্তে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ তেমন সমস্যা না। অর্থবছরের শেষ দিকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে যায়। কারণ, বরাদ্দকৃত অর্থ সব ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি সুদের হার কমানোয় ও নানা কড়াকড়ি আরোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সেখান থেকে আর আগের মতো ঋণ পাচ্ছে না সরকার। এ জন্য সরকার এবার ব্যাংকঋণে ঝুঁকেছে।
এদিকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ঘোষিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। যেমন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগে ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধারের সুদ বা রেপো হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করে দিয়েছে। এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরও কমতে পারে। বেসরকারি বিনিয়োগই দেশের কর্মসংস্থানের বড় উৎস। এছাড়া নতুন অর্থবছরে ১ লাখ ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশে ছয় কোটির বেশি লোক কাজ করেন। এর মধ্যে মাত্র ২০ লাখের মতো সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী ও শিক্ষক আছেন। বাকি সব কর্মসংস্থান বেসরকারি খাতের। প্রতিবছর ১৪ থেকে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি বেসরকারি খাতে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ শ্লথ হলে কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের আয় কমবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে।