:: কানিজ ফাতেমা ::
ছোটবেলায় বেশ পড়ুয়া ছিলাম, পড়তে গিয়েই একজনের ব্যক্তিত্ব আমার ছোট্ট মনে ভীষন দাগ কাটে এমনকি আজ এত বছরেও নরমে, গরমে, সততা আর দৃঢ়তায় তাঁর মত ‘আশ্চর্য’ ব্যক্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাইনি। আমি এমনিতেই ভাব প্রকাশে ভীষণ দূর্বল উপরন্ত তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা প্রকাশের বেলায় তা আরও কষ্টসাধ্য। সব ঘটনাই সবার জানা তবুও ইচ্ছে হলো হযরত উমর ফারুক (রা) নিয়ে লেখার।
হযরত উমর ফারুক (রা) জীবনে অর্ধেক দুনিয়ার খলীফা ছিলেন। কিন্তু যতদিন রাসূল (সা) ও আবু বকর (রা) বেঁচে ছিলেন তাঁর মত ছেলেমানুষ সাহাবী আর দ্বিতীয়টি ছিল না। একবারের ঘটনা বলি। ইসলামের প্রথম হিজরত ছিলো আফ্রিকার আবিসিনিয়ায় বা বর্তমান ইথিওপিয়ায়। রাসূল (সা) মক্কায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে আবিসিনিয়ার হিজরতকারীরা সব মদীনায় ফিরে আসে।
উমর (রা) একদিন সুন্দর করে আবিসিনিয়া ফেরত জাফর ইবনে আবু তালিবের স্ত্রী সাহাবী আসমার (রা) বাসায় যেয়ে বলে আসলেন ,’আমরা আপনাদের আগে হিজরত করেছি , তাই আমরা (যারা মদীনায় হিজরত করেছে) আপনাদের থেকে রাসূল (সা)র উপর বেশী হকদার।’
আসমা (রা)র এই কথা মোটেও পছন্দ হল না। উনি তৎক্ষণাৎ মুখের উপর বলে দিলেন, মোটেও না, আপনারা রাসূলের সাথে ছিলেন, বিপদে আপদে তাঁকে কাছে পেয়েছেন, শিক্ষা পেয়েছেন আর আমরা কত দূরদেশে, অপ্রিয় রাজ্যে তাঁকে ছাড়া।দাঁড়ান আমি এখনই রাসূল (সা) এর কাছে যেয়ে সব বলছি।
রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন , ‘তুমি কী উত্তর দিয়েছো?’ আসমা (রা) যা উমরকে (রা) যা শুনিয়ে এসেছেন তাই বললেন।রাসূল (সা) সব শুনে বললেন তুমি যা বলেছো ঠিকই বলেছো, আমার উপর তোমাদের হক আর উমরের হক সমান বরং তোমারা পাবে দুটি হিজরতের পুরষ্কার আর তারা পাবে একটি হিজরতের পুরস্কার। এই কথা শুনে আসমা (রা) খুশী মনে বাড়ি ফিরে আসলেন আর সবাইকে এই সুসংবাদ বলে বেড়াতে লাগলেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই কথা সমস্ত মদীনায় ছড়িয়ে গেলো, আবিসিনিয়া থেকে ফেরত আসাদের আনন্দ আর ধরে না, বহুদিন পর্যন্ত তারা আসমা (রা)র কাছে এসে বলতেন ,’ওই হাদীসটা শোনান না’ আর আসমা (রা) বারবার বলতেন। বলা হয়ে থাকে এই হাদীস তাঁদের কাছে গোটা দুনিয়ার চেয়ে বেশী প্রিয় ছিলো।
এই মহান কাহিনী পড়ার ফাঁকে আমি শুধু উমর (রা)র কথা ভাবি, তাঁর প্রিয় রাসুল (সা)র এই কথা শুনে উনার অবস্থাটা কেমন হয়েছিলো, আহা, কেন যে সেইদিন কথাটা বলতে গিয়েছিলেন।
এক কুরআনি নারীর গল্প
যতবার কোরানের সূরা মুজদালাহর/মুজাদিলাহ প্রথম চার আয়াত পড়ি, আমার ঠোঁটে হাসি লেগেই থাকে, আশেপাশে কেউ থাকলে জিজ্ঞেস করে ‘আরে, হাসো কেন’, হাসির কারন প্রিয় তিনজন মানুষ; রাসূল (সাঃ), উমর (রাঃ) ও এক কুরআনি নারীর লম্বা কাহিনী!
এই সূরা এক নারীর নামে নাযিল হয়েছে, খাওলা বিনতে সা’বালা, আউস ইবনে আল-সামিত (রাঃ)র স্ত্রী, একমাত্র মহিলা সাহাবী যার নাম কোন নবী পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়েও কোরানে এসেছে; তাও আবার এমন কোন তথাকথিত নারীসুলভ মহৎ কর্মের বা উতসর্গের জন্য নয় বরং রাসুল (সা)র ফয়সালা পছন্দ না হয়ে তাঁর সাথে তর্কাতর্কি করে আল্লাহর কাছে বিচার দেবার জন্য।জিবরাঈল (আ) ওহী নিয়ে না আসা পর্যন্ত উনি বলেই যাচ্ছিলেন অবশেষে আল্লাহর ফয়সালা পেয়েই উনি ক্ষান্ত ও সন্তুষ্ট দুইই হলেন।
সাহাবী আউস ইবনে আল-সামিত (রাঃ) একদিন স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাগের মাথায় খাওলা (রাঃ)র পেছনকে থেকে মায়ের মত লাগে বলে বেরিয়ে গেলেন (এককালে বাংলাদেশের পুরূষরাও এই করতো,এখনও চায় কিন্তু কঠোর আইনের কারনে করতে পারে না)।
এরপর বন্ধুস্থানীয় লোকদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, ঘুরে ফিরে এসে উনার মাথাও ঠান্ডাও হলো, উনি বুঝতেও পারলেন যে কী কান্ড ঘটিয়েছেন।তিনি অনুতপ্ত হয়ে আবার খাওলার সাথে একসাথে থাকতে চাইলেন কিন্তু খাওলা সাফ মানা করে দিলেন এই বলে যে কথা শোনার পর তার আর কোন অধিকার নেই তাঁর সাথে থাকার।সোজা কথায় কাজ না হওয়ায় হুমকি দিলেন, জোর করলেন কিন্তু খাওলার উপর জোর খাটানো যেতো না। উপায় না দেখে অবশেষে সামিত (রা) দাওয়ায় বসেই কান্নাকাটি শুরু করলেন। অবস্থা এই দেখে খাওলা রাসূল (সা)র কাছে ফয়সালা চাইতে চলে গেলেন ,তাঁর সামনে বসে বিস্তারিত সব খুলে বললেন। সব শুনে রাসূল (সা) বললেন,আমার মনে হয় প্রথা তোমাদের তালাক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু খাওলা (রাঃ) মানলে তো,তিনি বলতেই থাকলেন,না কেন তালাক হবে,উনি বদমেজাজি মানুষ,এখনতো ভুল বুঝতে পেরেছেন,আমি আমার যৌবন তাকে দিয়েছি,তার সন্তান ধারন করেছি,এখন আমি কোথায় যাবো,উনি বৃদ্ধ মানুষ,আমি চলে গেলে তাঁকে কে দেখবে আর বলতেই থাকলেন।
রাসূল (সা)ও নিরুপায়,তিনি আর কিইবা বলতে পারতেন তবে উনি তাঁকে তাড়িয়েওতো দেননি,সারাজীবন তিনি সাহাবীদের অভাব-অভিযোগ,পরামর্শ শুনেছেন,চেয়েছেন এইবারও তাই। শুধু বললেন খাওলা, তোমার বৃদ্ধ কাজিন (উনারা আত্নীয় সম্পর্কের ছিলেন)সামিতের ব্যপারে আল্লাহকে ভয় করো,তাকে ছেড়ে দাও। খাওলা (রাঃ) মানছিলেন না আর এর কিছুক্ষণ পরই নাযিল হলো সূরা মুজাদালাহর প্রথম চার আয়াত!
১) আল্লাহ অবশ্যই সে মহিলার কথা শুনছেন যে তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার কাছে কাকুতি মিনতি করেছে, এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ করছে৷ আল্লাহ তোমাদের দু’জনের কথা শুনছেন তিনি সবকিছু শুনেন ও দেখেন।
২) তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে “যিহার” করে তাদের স্ত্রীরা তাদের মা নয়৷ তাদের মা কেবল তারাই যারা তাদেরকে প্রসব করেছে ৷ এসব লোক একটা অতি অপছন্দনীয় ও মিথ্যা কথাই বলে থাকে ৷ প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহ মাফ করেন, তিনি অতীব ক্ষমাশীল৷
৩) যারা নিজের স্ত্রীর সাথে “যিহার” করে বসে এবং তারপর নিজের বলা সে কথা প্রত্যাহার করে এমতাবস্থায় তারা পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করতে হবে৷ এর দ্বারা তোমাদের উপদেশ দেয়া হচ্ছে৷ তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত৷
৪) যে মুক্ত করার জন্য কোন ক্রীতদাস পাবে না সে বিরতিহীনভাবে দুই মাস রোযা রাখবে- উভয়ে পরস্পরকে স্পর্শ করার পূর্বেই৷ যে তাও পারবে না সে ষাট জন মিসকীনকে খাবার দেবে৷ তোমাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এ জন্য যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান আনো৷ এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত ‘হদ’৷ কাফেরদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি৷
ঘটনা এখানেই শেষ হলে তাও কথা ছিলো,স্বামীকে ‘উদ্বার’ করার খাওলার কাজ যে এখনো বাকি!
রাসূল (সা)তাঁকে বললেন, ‘যাও তোমার কাজিনকে বলো একজন দাস মুক্ত করে দিতে, খাওলা বললেন,তাঁর মুক্ত করার মত দাস নেই,তাহলে তাঁকে একাধারে ষাটটা রোজা রাখতে বলো,খাওলা বললেন, উনি বৃদ্ধ মানুষ তার পক্ষে সম্ভব না,তাহলে তাকে ষাট জন মিসকীনকে পেট ভরে খাইয়ে দিতে বলো, খাওলা বললেন,উনার ওতো সামর্থ্য নেই।তাহলে তাকে বলো এক ফারাক খেঁজুর দান করে দিতে, খাওলা বললেন তাহলে আমিও আরেক ফারক খেঁজুর দিবো। রাসূল (সা) বললেন, যাও, ওর হয়ে দিয়ে দাও আর তোমার কাজিনের প্রতি সদয় আচরন করো (সদয় হতে এইজন্য বলেন যাতে স্বামীর সাথে একটু কম তর্ক করেন)।
খাওলা (রা) খুশী মনে বাড়ি ফিরে আসলেন। বাড়ি ফিরে বোধহয় ক্রন্দনরত স্বামীকে বলেছিলেন,এই উঠো,তোমাকে আর কাঁদতে হবে না আমি আল্লাহর রাসূল, জীবরাঈল (আ)কে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিন থেকে ফয়সালা করিয়ে এনেছি,আমরা একসাথে থাকতে পারবো,যাও এখন শুধু কাফফারা দাও। (আচ্ছা,এখানে সুযোগে একটা কথা বলে নিই,যেসব মেয়েরা খুব চিন্তিত থাকেন,আল্লাহকে নিষ্ঠুর ভেবে ফেলেন, যে আখিরাতে স্বামীকে অনেক হুরী-টুরি দেয়া হবে তারা ভাবেন, জান্নাতে বা দুনিয়ায়ও আল্লাহর কাছে এভাবে সাফ বলে দিবেন,আল্লাহ রব্বুল আলামীন কখনো নিজের বান্দীর সম্মান, যুক্তিপূর্ণ কথার উপরে কাউকে প্রাধান্য দেন না, সো চিয়ার্স!)
এখন বলি এই পুরো ঘটনায় উমর (রা) কোথা থেকে আসলো। কুরানের তাফসীরতো বড় হয়ে পড়েছি কিন্তু এই মহাসম্মান্নিত নারী সম্পর্কে জানতে পারি উমর (রা)র জীবনী থেকেই। খাওলা (রা)সম্পর্কে জানতে গেলে উমর (রা)আসবেই আর উমর (রা)কে জানতে গেলে খাওলা।মোট দুটো ঘটনা আছে ।
উমর (রা) তখন আমিরুল মুমেনীন, একদিন মসজিদের বাইরে খাওলা (রা)র সাথে তাঁর দেখা, সেদিনের কথা বলছি যখন মহিলা সাহাবীরা মসজিদেই নামায পড়তেন। উমর (রা) তাঁকে সম্মানের সাথে সালাম জানালেন, কুশল জিজ্ঞেসা করলেন। খাওলা (রা)র ততদিনে বয়স হয়েছে কিন্তু উনার প্রগলভতা কমেনি এতটুকু। তিনি উমর (রা)কে বললেন, ‘হে উমর তোমাকে আমি তখন থেকে চিনি যখন তুমি উকাজের মেলার বাইরে হাতে ছড়ি নিয়ে ভেড়া চড়াতে, তাই খলীফা হিসেবে আল্লাহকে ভয় করো যখন তুমি মানুষের দেখভালের দায়িত্ব এখন তোমার উপর এবং জেনে রেখো যে আখিরাতের শাস্তিকে ভয় করে সে যেন বুঝতে পারে সেইদিন বেশী দূরে না;আর যে মৃত্যুকে ভয় করে সে এই দুনিয়ার অনেক সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়’ । সাহাবী আল জারদ আল আবদি উমর (রা)র পাশেই ছিলেন,উমর (রা) তখন রাষ্ট্রপ্রধান, একেতো বড় পদ তার উপর উমর (রা)র আপাত কঠোর সুলভ ব্যক্তিত্ব,লোকে তাঁকে খুব ভয় পেত,সেখানে এক বৃদ্ধা এভাবে কথা বলছে দেখে তিনি অবাক হয়ে বলেই ফেললেন, ‘এই যে মহিলা, আপনি কিন্তু ভীষন রুক্ষভাবে আমিরুল মুমেনীনের সাথে কথা বলছেন!’
জবাবে উমর (রা), ‘তাঁকে বলতে দাও,যাননা উনি খাওলা,যার কথা স্বয়ং আল্লাহ সাত আসমানের উপর থেকে শুনে? সেই মোতাবেক উমর বাধ্য তাঁর কথা শুনতে’!
অন্য ঘটনাটা হলো, একবার খাওলা দেখা করতে গেলেন উমরের সাথে আর উনি উনার যা স্বভাব কথা চালিয়ে যেতেই থাকলেন,এখনতো বৃদ্ধ হয়েছেন কথা বরং আরো বেড়েছে আর উমর (রা)র কত দায়িত্ব তখন কত বেশী কিন্তু তিনি শুনতেই থাকলেন। ইতোমধ্যে কুরাইশের এক শীর্ষস্থানীয় গণ্যমান্য লোক ফিরে গেলন,এক লোক জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া আমিরুল মুমেনীন আপনি কুরাইশের লোক ফিরিয়ে দিলেন এক মহিলার কথা শুনতে গিয়ে! উমর জবাব দিলেন, ‘তোমার উপর দূর্গতি! তুমি জানো এই মহিলা কে?’ লোকটি উত্তর দিলো, ‘না’। উনি বললেন, ‘উনি হলেন খাওলা বিনতে সা’বালা,যার কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সাত আসমানের উপর থেকে শুনেন,খোদার কসম যদি না সে আমাকে রাত নেমে আসার আগ পর্যন্ত না ছাড়ে, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে যেতে বলব না,যদি না নামাযের সময় হয়ে যায় এবং আমাকে নামায পড়তে যেতে হয় তবে আমি নামায পড়ে আবার তাঁর কাছেই ফিরে আসবো যতক্ষণ না যে কাজে সে আমার কাছে এসেছে তা পূরণ হয়!’
মাঝে মাঝে মনে হয় এত উত্তম কথা,এত উত্তম ব্যবহার শুধু উমর (রা)র পক্ষেই সম্ভব।