:: নাগরিক প্রতিবেদক ::
‘১০ বছর হয়ে গেছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবাকে খুঁজছি। কিন্তু আমি আমার বাবাকে পাই না। আমারও ইচ্ছে করে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে। আমার বন্ধুরা বাবার সাথে স্কুলে যায়। আমারও ইচ্ছে করে বাবার সাথে স্কুলে যেতে। আমি কেন পারি না! আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই।’
‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। অন্যদের মতো বাবার হাত ধরে আমিও হাঁটতে চাই। আমি বাবার ফিরে আসার পথ চেয়ে অপেক্ষায় আছি…’। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় আর কিছু বলতে পারেনি শিশু আরিয়ান। তার কথা কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ। ক্লাবের সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে বাবার সন্ধান চাইছে নিখোঁজ খালেদ হাসান সোহেলের ছোট্ট ছেলে।
শুধু বাবা হারানো ছোট্ট আরিয়ানই নয়, নিজেদের দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশ কয়েকজন স্বজন। তাদের কেউ বাবার খোঁজে, কেউ সন্তানের, কেউবা স্বামী অথবা ভাইয়ের খোঁজে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন। রাষ্ট্রের কাছে তাদের একটিই দাবি প্রিয়জনকে ফেরত দেওয়ার।
আজ শনিবার আন্তর্জাতিক গুম সপ্তাহ উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘মায়ের ডাক’র উদ্যোগে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়াসহ গুম বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই ও গুমের অভিযোগ তদন্তে সরকারকে নিরপেক্ষ কমিশন গঠনেরও দাবি জানানো হয়।
বাবাকে ফেরত চেয়ে কান্না করছিল ১১ বছরের শিশু লামিয়া আক্তার মিম। তার বাবার নাম কাউসার হোসেন। যিনি ১১ বছর আগে গুম হয়েছেন। তখন মিমের বয়স ছিল দেড় বছর। মিম বলেন, ‘১০ বছর হয়ে গেছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবাকে খুঁজছি। কিন্তু আমি আমার বাবাকে পাই না। আমারও ইচ্ছে করে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে। আমার বন্ধুরা বাবার সাথে স্কুলে যায়। আমারও ইচ্ছে করে বাবার সাথে স্কুলে যেতে। আমি কেন পারি না! আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই।’
কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন—নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা কমরেড সাইফুল হক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য তাবিথ আউয়াল, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, আলোকচিত্রশিল্পী, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী শহিদুল আলম, নারীনেত্রী ফরিদা আক্তার।
‘ফ্যাসিস্ট সরকার হিসেবে বিশ্বের কাছে বর্তমান সরকারের বদনাম হয়ে গেছে’ দাবি করে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য চেয়ে সরকারের কাছে একটি তালিকা দিয়েছে। এরপর থেকে সরকার র্যাবকে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে নিষেধ করেছিল। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটে চলছে।’
নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছোটবোন ও ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম জানান, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার থানায় সাধারণ ডায়েরি, মামলা ও অভিযোগ করেছে কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকার থেকে কোনো সহায়তা পায়নি। তাই তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সাহায্য চেয়েছে।
‘আমার ভাইদের যেখানে রাখা হয়েছে সেই গোপন ডিটেনশন সেলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা, আপনার শুনে রাখুন, আমরা আপনাদের চিনি। কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না,’ হুঁশিয়ারি করেন তিনি।
আরও বক্তব্য দেন—কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের গুম হওয়া সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া, গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছোট মেয়ে আরোয়া ইসলাম, ড্রাইভার কাউসারের মেয়ে লামিয়া আক্তার মিম, শিশু হৃদি, শিশু সাফা, মাহবুব হোসেন সুজনের ভাই সাকিল, বরিশালের গুম হওয়া ফিরোজ খান কালুর স্ত্রী আমিনা আক্তার বৃষ্টিসহ কয়েকজন।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই ও গুমের অভিযোগ তদন্তে সরকারকে নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানান মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি ন্যায় ও মানবাধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুমের মতো ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে গুমের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠে এসেছে।’
তিনি জানান, প্রায় ৬০০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৩০০ জন ফিরে এসেছেন।
‘আমরা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে সতর্ক করতে চাই। অবিলম্বে নির্যাতিতদের মুক্তি দিন। তা না হলে বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং দায়ী ব্যক্তিদের মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে,’ বলেন তিনি।
মানববন্ধনে সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো—গুমের ঘটনায় দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোকে অস্বীকার না করে এ ধরনের ঘটনার বিচার নিশ্চিতে বিদ্যমান আইন কাঠামোতে পরিবর্তন আনা। নিখোঁজদের খুঁজে বের করা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে শিগগিরই খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।