কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করলো যুক্তরাষ্ট্র

ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডসের কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের নির্দেশনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পেন্টাগন।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে,বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে হওয়া এক হামলায় মারা যাওয়া বেশ কয়েকজনের মধ্যে কাসেম সোলেইমানি রয়েছেন।

ইরানের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি জেনারেল সোলেইমানি। তার কুদস বাহিনী সরাসরি দেশটির প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে রিপোর্ট করে।

আয়াতুল্লাহ খামেনির পর জেনারেল সোলেইমানিকে ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো।

ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, এই হামলার পেছনে থাকা ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ’ নেয়া হবে। জেনারেল সোলেইমানির মৃত্যুতে তিন দিনের জাতীয় শোকও ঘোষণা করেছেন তিনি।

মার্কিন কর্মকর্তারা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন ইরানের সাথে সম্পর্ক আছে, এমন লক্ষ্যবস্তুতে তারা হামলা চালিয়েছে, কিন্তু এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়নি।

মার্কিন হামলা বা কারো নিহত হওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া গ্রুপ পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস রয়টার্সকে জানিয়েছে, জেনারেল সুলেইমানি ও ইরাকি মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদি আল মুহান্দিস নিহত হয়েছেন।

এর আগের খবরে বলা হয় বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রকেট হামলায় অনেক মানুষ মারা গেছে।

এই হামলার পরপর বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রায় ৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইরানি শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি সবার কাছে যিনি হাজি কাসেম নামে পরিচিত। ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হবার খবর যখন ইরাক-ইরান সীমান্ত পেরিয়ে ইরানে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তখন ইরানি জনগণের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া।

ইরানিদের কাছে হাজি কাসেম শুধু একটি নাম ছিল না, ছিল একটি নক্ষত্র। যিনি অনেকের কাছে ‘শত্রুদের দুঃস্বপ্ন’ আর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি যাকে ‘জীবন্ত শহীদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরে ঘটিত ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বা আইআরজিসির প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন নিহত এই কমান্ডার সোলাইমানি। যিনি ধীরে ধীরে আল কুদসের শাখাগুলোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, ইরাকে নিজের ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটাতে ভূমিকা রেখেছিলেন বললে ভুল হবে না।

৬৩ বছর বয়সী জেনারেল সোলাইমানির চিন্তাশক্তি আর সামরিক কৌশলই মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক প্রভাবে ভূমিকা রেখেছিল।

লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামিক জিহাদ, ইয়েমেনের হুতি ইত্যাদি সংগঠনের কাছেও যার ছিল গ্রহণযোগ্যতা, যা পশ্চিমা বিশ্বকে এবং ইসরাইলকে ভাবিয়েছিল। এটাও অস্বীকার করার নই যে, ইসরাইলের মোসাদ আর যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এর হিট লিস্টে সোলাইমানি সর্বাগ্রেই ছিলেন।

এর সূত্র ধরেই কয়েকবার হামলার চিন্তা করেও কোনো কারণে এতটা সময় নিতে চেয়েছিল তারা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প সেই অপেক্ষার দিন শেষ করে নির্বাচনের আগেই জনগণের দৃষ্টি কাড়তে জেনারেল সোলাইমানিকে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দেন।

একজন প্রেসিডেন্ট যখন নিজ থেকে ঘোষণা দিয়ে অন্য একটি দেশের সামরিক প্রধানকে হত্যার নির্দেশ দেন তখন ভাবায় যায় জেনারেল কাসেমি শুধু একজন সামরিক প্রধান ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিরোধীদের ঘুম হারাম করা শত্রুদের দুঃস্বপ্ন।

১৯৭৯ সালে ইরান যখন কেবলমাত্র ইসলামী বিপ্লব এর মাধ্যমে নতুন ইরান গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করছে ঠিক সেই মুহূর্তে পশ্চিমারা এক বছরের মাথায় ১৯৮০ সালে ইসলামি বিপ্লবের নাজুক অবস্থাকে ব্যবহার করে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পেছন থেকে উজ্জীবিত করে।

এমন অবস্থায় ইরানের সে সময়ের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাকে শহীদ হওয়ার উন্মাদনা নিয়ে ইরাকি মেশিনগান আর মাটিতে মাইন পোঁতা এলাকা পেরিয়ে দলে দলে ইরানিরা ইরাকি অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে।

সর্বোচ্চ নেতার ডাকে ইরানিরা নিজেদের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে নিহত হন প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ইরানি।

এই মুহূর্তে সবার চোখ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির কুদস ব্রিগেডের নতুন প্রধান মেজর জেনারেল ইসমাইল কায়ানির দিকে। তাদের সিদ্ধান্তই বলে দিবে জেনারেল সোলাইমানির মতো নক্ষত্রের জবাব ইরান কিভাবে দিবে।

ইরানি কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছে লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ আন্দোলন।

এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ বলেন, বিশ্বজুড়ে সব প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাজ ও দায়িত্ব হচ্ছে এসব খুনি অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দেয়া।

এদিকে ইরানের আল-কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা উসকে দেবে বলে মন্তব্য করেছে রাশিয়া।

দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতে সংবাদ সংস্থা আরআইএ নভোস্টি ও তাস জানিয়েছে, সোলাইমানিকে হত্যা পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে।

এতে বলা হয়, পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে সোলাইমানি ইরানিদের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করেছেন। আমরা ইরানি জনগণের প্রতি গভীর শোক জানাচ্ছি।

ইরানি শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও ইরাকি কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিসকে হত্যায় মার্কিন হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহদি।

এই হামলাকে আগ্রাসন আখ্যা দিয়ে এতে বিপর্যয়কর যুদ্ধ লেগে যেতে পারে বলে জানান তিনি।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, একজন ইরাকি সামরিক কমান্ডারকে হত্যা ইরাকি সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন। এতে ইরাকি মাটিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতির শর্তের গর্হিত লঙ্ঘন ঘটেছে বলেও জানান ইরাকি প্রধানমন্ত্রী।

ইরাকি কমান্ডার মুহান্দিস ছিলেন আধা সামরিক বাহিনী হাশেদ আল-শাবির উপপ্রধান।

তার মৃত্যুতে ইরানে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এমন খবর দিয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *