বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক ভারসাম্যহীনতা

:: কানিজ ফাতেমা ::

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত তার নিজের প্রয়োজনেই বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিলো, আমাদেরও সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো তাই দু হাত বাড়িয়ে সাহায্য নিয়েছিলাম। যেই সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিলো পারস্পারিক স্বার্থ ও সাহায্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তা সবসময় অক্ষুন্ন থাকেনি। সব কিছুকে শুধু বন্ধুত্ব বলাটা যেমন ভুল তেমনি স্বার্থ না বলাটাও আত্নপ্রবঞ্চনা।

রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির ভুলগুলোর মধ্যে একটি হলো ভারতকে সম্পূর্নভাবে অগ্রাহ্য করে পূর্বমূখী কূটনীতি গ্রহন। যা মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া থেকে চীন পর্যন্ত বিস্মৃত ছিলো। বিএনপির এই নীতি ছিলো অভুতপূর্ব ও সেই সময়ের জন্য সফল। কিন্তু আপনি যতই অপছন্দ করেন না কেন প্রতিবেশীকে অগ্রাহ্য করে কোন নীতি গ্রহন করাটা দীর্ঘমেয়াদে কোন সুফল বয়ে আনে না এবং এক অর্থে চূড়ান্ত বোকামি যার মাসুল বিএনপি এখন হাড়ে হাড়ে দিচ্ছে।

ভারত চেয়ে চেয়ে এই অগ্রাহ্য, চীনের সাথে এত মাখামাখি সহ্য করেছে অথচ রৌমারী সীমান্তে বিডিয়ারের ব্যাপক বিজয়ের (১৬ জন বিএসএফ জোয়ানের মৃত্যু ও রৌমারী মুক্তি) পর আত্নবিশ্বাসী বিএনপি চাইলেই ভারতকে চেপে ধরতে পারতো। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতিসংঘে ফারাক্কা বাঁধের কুফল বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। ফারাক্কার কুফল নিয়ে ডকুমেন্টারীও প্রদর্শন করেন। সম্ভবত ২০০১-০৬ শাসনামলে তাঁর দলের তা মনে ছিলো না!

ট্রানজিট দিলেই, বন্দর ব্যবহার করতে দিলেই দেশ বিক্রি বা পরাধীন হয়ে যায় না; স্রেফ ফালতু কথা বরং সঠিক ভাবে ব্যবস্থাপনা করলে আমরাই আর্থিকভাবে প্রচূর লাভবান হতাম।

বিএনপিকে নিয়ে ভারতের আরেকটি উদ্বেগের কারন ছিলো সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী জুড়ে বাংলা ভাই তথা জংগীবাদের উত্থান! বিএনপি পুরো জংগীবাদের বিষয়টাকে দীর্ঘদিন ধরে স্রেফ অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছিল।

বিএনপির এই এত ভারত অগ্রাহ্যের পিছনে একটা বড় হাত ছিলো তাদের শরীক দল জামায়াতে ইসলামের। মওলানা মওদুদীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই দলের মুল এজেন্ডাই ভারত বিরোধিতা। স্বয়ং পাকিস্তানও এতটা ভারতবিরোধী নয় যতটা এই দলটি। ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে পাঁচ বছরে দলটির ভারত কূটনীতি সাফল্যশুন্য, প্রপাগান্ডাই সার; উপরন্তু বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতে ১০ ট্রাক অস্ত্র চালান মামলায় ফেঁসে গেছেন ওই দলেরই এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে ভারতের বন্ধুত্ব অথবা স্বার্থ ও নিরাপত্তার আস্থা অর্জন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিবেশি দেশটি যেকোন মূল্যে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় রাখতে চায়, আরেকটা ভাল বিকল্প না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত।

ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিটমহল বিনিময় তবে এটা যতটা না আমাদের কূটনতিক সাফল্য তারচেয়েও বেশী ভারতের উপহার। ভারত না চাইলে বাংলাদেশ কিছুই হাসিল করতে পারে না যেভাবে পারেনি অভিন্ন নদীর পানি বন্টন সমস্যার সমাধান করতে। সীমান্তে মৃত্যু থামাতে, শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেতে। ৩০ বছর মেয়াদী তিস্তা চুক্তি যেন কাজীর গরু কিতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই। সম্ভবত এখন আওয়ামীলীগও এই চুক্তির কথা ভুলে যেতে চায়।

ভারত যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে খুব ভালোবাসে তাও না,এটা পুরোপুরিই গিভ এন্ড টেকের খেলা এবং এটারও মেয়াদ আছে।

কোন বিশেষ দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং ভারতও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। সাবেক বিচারপতি এ এস কে সিনহার ষোড়শ সংশোধনীর ওই রায়ের পর কিছু কিছু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে সিনহার প্রংশসাকে অনেকেই তাঁকে নিয়ে ভারতের পরিকল্পনার প্রয়াস দেখতে পেয়েছিলেন। সরকার তাই দ্রুত সিনহা অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ভারতের আস্থা ফিরে পেতে আরও মরিয়া।

ভারত যদি আমাদের কর্নফুলী নদীর পানি বৈধ ভাবে দাবী করতো চট্টগ্রামের এমপিরা কি বাধা দেবার সাহস রাখতো? অথচ আমরা আমাদের তিস্তার পানির নায্য দাবী জানাই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। মমতাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। তাঁকে মহারানী বা নায়িকা বানিয়ে উপস্থাপন করি। পানির বদলে বিদ্যুতের আশ্বাস নিয়ে আসি অথচ পুরো ব্যপারটা একটা নাটক ছাড়া আর কিছুই না।

ভারত বড় শক্তির বড় দেশ। কূটনীতিতে দক্ষ এবং সবচেয়ে বড় কথা তাদের কূটনীতি দেশপ্রেমনির্ভর। ভূ-রাজনীতি আবেগ দিয়ে চলে না, যুক্তি দিয়ে চলে না। বন্ধুত্বতো স্রেফ বাজারি কথা। ভারত নিজ দেশ ও জনগনের স্বার্থ দেখবে এটাই স্বাভাবিক। ট্রানজিট চাইবে, সমুদ্র বন্দর চাইবে আমরা ও সুবিধা দিবো কিন্তু নিজেদের নায্যটাওতো আদায় করে নিতে হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশ কী কখনো ভারতে কাছে ফারাক্কা বাঁধ বা অভিন্ন নদ নদী নিয়ে তার দাবী জোরালো ভাবে তার কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছে? মওলানা ভাষানীর পর ক্ষমতার বাইরে থাকা আর কী কোন সোচ্চার নেতা আমরা পেয়েছি? ডান বাম সবই এক খোয়ারের গরু! সাধারন জনগনও এক ক্রিকেট ছাড়া আর অন্য কিছুতে ভারত বিষয়ে কখনোই একাট্টা হয়নি। তাই আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি সুন্দরবনের রামপাল প্রকল্প, কুমার,গড়াই, মধুমতী আর তিস্তার তিলে তিলে মৃ্ত্যু।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরে আমরা ভারতের সাথে সম্মান আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। ভারত নিয়ে সব ভুল নীতিই গ্রহন করেছি। কখনো নতজানু নীতি আবার কখনো পুরোপুরি উপেক্ষার নীতি বাংলাদেশকে কখনোই ভারতের কাছে তার দাবি দাওয়া দৃঢ়তার সংগে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে দেয়নি।

আর এখন ভারতেও যখন হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে,আসাম থেকে মুসলমান বিতারনের চেষ্টা চলছে, ভারতীয় সেনা প্রধান অসঙ্কোচে আপত্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন আপাতত এই অনাস্থার সম্পর্ক কাটিয়ে উঠার আশাও সুদূর পরাহত!

লেখিকাঃ বেসরকারি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *