‘জয় বাংলা’ জাতীয় শ্লোগান হিসেবে রুল জারি প্রসঙ্গে

:: আরিফুল হক ::

বাংলাদেশের হাইকোর্ট সম্প্রতি বিতর্কিত শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় শ্লোগান রুল জারি করে সকলের বলা বা উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।

হাইকোর্ট যে সমস্ত যুক্তিতে এটি করেছে , তা শতভাগ বিতর্কিত ও সঠিক নয়। যেমন বলা হয়েছে, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েই নাকি মুক্তিযোদ্ধারা রনাঙ্গনে যু্দ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এটা সর্বৈব্য ঠিক নয়।কারন, রনাঙ্গনে যারা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনী, কৃষক শ্রমিক, দিনমজুর, ছাত্র ও যুব শ্রেনীর মানুষ। এদের অধিকাশংই ছিলেন মুসলমান ঘরের সন্তান। সুতরাং একটি মরনপণ সংগ্রামে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মুসলমানের যার নাম স্মরনে আসা স্বাভাবিক, সেটা তার ‘রব’, ‘আল্লাহর’ নাম। কোন বিজাতীয় নাম নয়। সেই স্বাভাবিক ঘটনাই সেই সময়ে ঘটেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ‘আল্লাহুআকবার’ ধ্বনিতে শক্তি সঞ্চয় করেই শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়তো। এই ইতিহাসের কালের সাক্ষী আমাদের বয়সী যারা বেঁচে আছেন তাদের হৃদয়ে লেখা আছে, আর লেখা আছে তৎকালীন  সময়ের সাক্ষী কিছু লেখকদের লেখনীতে।

জয় বাংলা শ্লোগানটি আগাগোড়াই একটি বিতর্কিত শ্লোগান হিসাবে পরিচিত । প্রথমত জয় বাংলা কথাটি কোন দেশের জয়গাথা প্রকাশ করছে সেটি বোধগম্য নয় । বর্তমান পৃথিবীতে ‘বাংলা’ নামে কোন দেশ নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা ‘ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে। আমাদের দেশের নাম পরিষ্কার ভাবে  ‘বাংলাদেশ’। সুতরাং জয় বাংলাদেশ বললেও কিছুটা দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত। কিন্তু জয় বাংলা! এটা কোন দেশেরই শ্লোগান হতে পারেনা, কারন ঐ নামে কোন দেশের অস্তিত্বই পৃথিবীর মানচিত্রে নেই।


এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা নিয়মিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ শুনতেন, যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবনী শক্তির উৎস, তারাও সাক্ষী দেবেন যে, সেই রেডিও স্টেশন চালু হত কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে, আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে, শেষ করা হত ‘খোদা হাফেজ’ উচ্চারণ করে। রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্য ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নাশরুম মিনালআল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারীব’ প্রভৃতি আল্লাহর বানী একাধিকবার প্রচারিত হত।


মুক্তিযুদ্ধকালে সুচতুর ভারত বাংলাদেশের উপর নিজস্ব আধিপত্য দৃঢ় করার জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাউন্টার করার জন্য জেনারেল মানেকশের তত্ত্বাবধানে ‘ মুজিব বাহিনী’ নামক একটি ভারতপোষ্য বাহিনী সৃষ্টি করে । তাদের মুখেই ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি প্রচারিত হত। স্বাধীনতার পর এই মুজিব বাহিনী ও ভারতের সাথে ৭ দফা নামক পরাধীনতা চুক্তি সম্পাদনকারী আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আরোহণের পর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ৯০ভাগ মুসলমানের দেশ থেকে  ইসলামী নাম,বোধ ও বিশ্বাস এবং ইসলামি জীবনাচরণ দেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করার সুদূরপ্রসারি কার্যক্রম হাতে নেয়। যার পরিনতি এই ‘জয়বাংলা’ ধ্বনির রমরমা প্রচার। তারাই মুসলমানদের মুখ থেকে ‘আল্লাহু আকবর’  ‘আসসালামু আলাইকুম’, ‘খোদা হাফেজ’  প্রভৃতি বাক্যসম্ভার মুছে ফেলার নানাপ্রকার কৌশল প্রয়োগ করে।  তাদের সেই চেষ্টা আজও অব্যাহত আছে। আজও মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়ায় ইসলামী সম্ভাষনগুলো উচ্চারিত হয়না। এখনতো আর একটি অজুহাত যুক্ত হোল। এবার হয়ত জনগনকে আসসালামু আলাইকুম ,আল্লাহ হাফেজ বাদ দিয়ে জয়বাংলা বলে স্বাগত ও বিদায় জানাতে বাধ্য করা হবে।

আর একটি যুক্তি তারা দেখিয়েছেন। শেখ মুজিব নাকি ৭ই মার্চ ১৯৭১ তাঁর কথিত স্বাধীনতা ঘোষনার ভাষনটি শেষ করেছিলেন ‘ জয়বাংলা ‘ শ্লোগান দিয়ে । তাই (একই আদালত কর্তৃক জারিকৃত) ‘ জাতীর পিতা’ র সম্মান রক্ষার্থে ‘জয়বাংলা’কে জাতীয় শ্লোগান করা উচিত। এটাও একটা ভূল তথ্যভিত্তিক।

‘জয়’ শব্দটি একটি সংস্কৃত শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিজয় হলেও , জয় একটি ধর্মীয় পরিভাষা। আর্যরা মহাভারতের নাম দিয়েছিল ‘জয়’। কারন তারা বিশ্বাস করতো মহাভারত পাঠ করলে অবিদ্যাজনিত সকল সংস্কার জয় করা যায়। সুতরাং মহাভারতের অপর নাম জয়। ‘জয়’ শব্দটি ধর্মীয় পরিভাষা হওয়ায়, আর্যগন তাদের ঠাকুর দেবতা দেশ, স্থান সম্মানিত ব্যক্তির আগে জয় শব্দ ব্যবহার করে তাকে মহিমান্বিত করতো। যেমন ইদানীং সর্বজন আতঙ্কিত একটি শ্লোগান জয়শ্রীরাম । তারপর জয় মা কালী, জয়মা দূর্গা, শিবাজী কি জয়, জয় হিন্দ ইত্যাদি।


৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উদগ্রীব শ্রোতা হিসাবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। শেখ মুজিব সেদিন স্বাধীনতা ঘোষনা করাকে সুচতুরভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। উপরন্তু তিনি সেদিন শুধু জয়বাংলা বলে ভাষন শেষ করেননি। যতদূর মনে পড়ে ,তিনি ভাষন শেষ করতে গিয়ে বলেছিলেন – ‘জয় বাংলা’ ‘জয় পান্জাব’, ‘জয় সিন্ধ’ , ‘জয় বেলুচিস্তান’, ‘জয় ফন্ট্রিয়ার’ এবং শেষ করেছিলেন ‘জয় পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়ে। যেগুলো পরে সম্পাদনা কিংবা মুছে ফেলা হয়েছে। এখন যে ভাষনটি নিত্য প্রচারিত হচ্ছে সেটি বহু কাটছাঁটে জর্জরিত মুজিবের ভাষন। আওয়ামী লীগ নিজ স্বার্থে তাদের পিতৃইতিহাস বিকৃত করতেও যে ছাড়েনা,৭ই মার্চের ভাষনের বিকৃতি তারই একটি জলন্ত উদাহরণ।

‘জয় বাংলা’ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে ভাষন শেষ করা শেখ মুজিবের কাছে নতুন কিছু ছিলনা। ৩রা জানুয়ারি ১৯৭১ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যের শপথ পাঠ অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরও মনে থাকার কথা যে শেখ মুজিব উক্ত অনুষ্ঠানের ভাষনও শেষ করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় পাকিস্তান’ শ্লোগান উচ্চারণ করে! সেদিন ৪১৮জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে ছাপানো শপথনামাটি বিতরণ করা হয়েছিল সেখানেও লেখা ছিল জয়বাংলা, জয় পাকিস্তান শ্লোগানটি। সুতরাং ঐ ৪১৮জন আওয়ামী সাংসদও শেখ মুজিবের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে সমস্বরে উচ্চারণ করেছিলেন ‘জয়বাংলা’ ও ‘জয় পাকিস্তান’ শ্লোগান। যারা বিশদ জানতে চান, তারা আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটা পড়ে দেখতে পারেন।

জয় বাংলা শ্লোগানটি আগাগোড়াই একটি বিতর্কিত শ্লোগান হিসাবে পরিচিত । প্রথমত জয় বাংলা কথাটি কোন দেশের জয়গাথা প্রকাশ করছে সেটি বোধগম্য নয় । বর্তমান পৃথিবীতে ‘বাংলা’ নামে কোন দেশ নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা ‘ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে। আমাদের দেশের নাম পরিষ্কার ভাবে  ‘বাংলাদেশ’। সুতরাং জয় বাংলাদেশ বললেও কিছুটা দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত। কিন্তু জয় বাংলা ! এটা কোন দেশেরই শ্লোগান হতে পারেনা, কারন ঐ নামে কোন দেশের অস্তিত্বই পৃথিবীর মানচিত্রে নেই।

দ্বিতীয়ত ‘জয় বাংলা’ শব্দটি বাংলাদেশের ৯৭ভাগ মুসলমানের বোধ বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক।

‘জয়’ শব্দটি একটি সংস্কৃত শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিজয় হলেও , জয় একটি ধর্মীয় পরিভাষা। আর্যরা মহাভারতের নাম দিয়েছিল ‘জয়’। কারন তারা বিশ্বাস করতো মহাভারত পাঠ করলে অবিদ্যাজনিত সকল সংস্কার জয় করা যায়। সুতরাং মহাভারতের অপর নাম জয়। ‘জয়’ শব্দটি ধর্মীয় পরিভাষা হওয়ায়, আর্যগন তাদের ঠাকুর দেবতা দেশ, স্থান সম্মানিত ব্যক্তির আগে জয় শব্দ ব্যবহার করে তাকে মহিমান্বিত করতো। যেমন ইদানীং সর্বজন আতঙ্কিত একটি শ্লোগান জয়শ্রীরাম। তারপর জয় মা কালী, জয়মা দূর্গা, শিবাজী কি জয়, জয় হিন্দ ইত্যাদি।

বিশেষ একটি শ্রেনীর ধর্মীয় পরিভাষা হওয়ায় ভারতের মুসলমান এবং বৌদ্ধরা বরাবর জয় শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। ৭০দশকের শেষদিকে, দেশের টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের রামচেতনাধারীরা সুকৌশলে মহাভারতের সেই জয় শব্দটি, জয়হিন্দ শব্দের অনুকরণে বাংলার সাথে যুক্ত করে , ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের সৃষ্টি করে।

দেশের কিছু মানুষ অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করেই সেই শ্লোগান নিয়ে নাচানাচি শুরু করে দেয়। সচেতন মানুষ অবশ্য সেসময় থেকেই জয়বাংলা শব্দের প্রতিবাদ করে আসছিল। সম্প্রতি  মহামান্য কোর্ট সেটিকে ১৮কোটি মুসলমানের বুকে চিরস্থায়ী করে গেঁথে দিল।

সুপ্রিয় পাঠক! দেশের গৌরব জাতিকে উত্তাপ দেয়, ক্ষমতা যোগায়। দেশ নিয়ে গৌরববোধ যদি না থাকে, প্রত্যাশা যদি না থাকে, জীবন-ঐতিহ্য না থাকে, শুধুই কিছু কল্পিত নাম জপতে বাধ্য করা হয়, তাহলে জাতি অনুগত দাস হয়ে পড়ে। আমাদের নেতা-নেত্রী বুদ্ধিজীবী সমাজ বাংলাদেশকে সেই পথেই ঠেলে দিচ্ছে।

সবশেষে,  জনগনের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, দেশ আছে তাই আপনারা আছেন। দেশ নেই যাদের সেই কাশ্মীরবাসীদের দিকে তাকিয়ে শিক্ষা নিন। হাটুঁ গেড়ে বেঁচে থাকার চাইতে , দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ অনেক শ্রেয়।

লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *