ভয়াবহ ও নৃশংস ‘ঠগি সম্প্রদায়’

ভারতের ইতিহাসে ভয়াবহ ও নৃশংস একটি গোষ্ঠীর নাম ‘ঠগি সম্প্রদায়’ (Thuggees)। তেরো থেকে উনিশ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এরা।

ইংরেজি ভাষায় শব্দ আছে ‘থাগ’ (thug)। অপরাধী এবং নৃশংস ব্যক্তিদের বোঝানোর ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটি ইংরেজি ভাষায় নেয়া হয়েছে হিন্দি শব্দ ‘ঠগ’ (thag) থেকে। আর এই শব্দটি ব্যবহার হতো ঠগিদের বোঝানোর জন্য। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা ‍নির্মম ছিল ঠগিরা।

এই ঠগিদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস ব্যক্তিটি ছিল ‘ঠগ বাহরাম’। সে ছিল ঠগিদের রাজা। বলা হয়, বাহরাম তার সময়ে একাই হত্যা করেছিল ৯১৩ জন মানুষকে। সে অবশ্য স্বীকার করেছে ১২৫ জনের কথা এবং অনুচরদের নিয়ে মোট ১৫০ জনকে হত্যার কথা।

বাংলা এবং উত্তর ভারতজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব ছিল ঠগিদের। ঠগিদের এই রাজত্ব ধ্বংস করে দেয় ব্রিটিশরা। ১৮৪০ সালে ঠগ বাহরামকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশরা। হত্যার অভিযোগে ৭৫ বছর বয়সে বাহরামকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সরকার। বিশ্বের ভয়াবহতম ঘাতক বলা হয় এই বাহরামকে।

এর আগেও অবশ্য ঠগিদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযান চালানো হয়। তবে তাতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। ১৩৫৬ সালে জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১২৯০ সালের দিকে সুলতানী শাসনামলে কিছু ঠগি ধরা পড়ে। কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার। গ্রেফতারের পর তাদের দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেননি। বরং তাদের নৌকায় তুলে লক্ষণাবতি পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন, যাতে তারা আর কোনোদিন দিল্লিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।

ঠগিরা সাধারণত বংশপরম্পরায় খুনোখুনির এই পেশা ধরে রাখতো তারা। একজন ঠগি বালকের বয়স ১৮ বছর হলে হত্যার অনুমতি পেত।

১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে। সে সময় একটি গণকবরে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। কেবল ১৮৩০ সালেই তারা প্রায় তিরিশ হাজার মানুষকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মৃতদেহ উৎসর্গ করত দেবী কালীকে।

ঠগিরা তাদের দেবীকে বাংলায় ভবানী নামে ডাকত। তারা সাধারণত বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগতভাবে যাত্রা করত রক্তের নেশায়! দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত তারা। তাদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবঙ্গের ‘কালীঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ‘ভবানী মন্দির’।

এরা হত্যাকাণ্ডের জন্য একটি হলুদ রঙের রুমাল ব্যবহার করত, যার বহর ছিল মাত্র ৩০ ইঞ্চি। রুমালটি ভাঁজ করে তার দুই মাথায় দুটি রুপার মুদ্রা বেঁধে দিত। একজনকে হত্যার জন্য হাত লাগাতো তিন ঠগি। এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি শিকারীর গলায় পেঁচিয়ে ধরত আর বাকিজন পা ধরে রাখতো।

ঠগিরা হত্যার পর লাশগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে অগ্রবর্তী দলটি তাদের হত্যা করত। তবে তারা সাধারণত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক আর কোনো নারীকে হত্যা করত না।

ঠগিরা প্রায় ২০ লাখ মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। আঠারো ও ঊনিশ শতকে তাদের খুনোখুনি তুঙ্গে উঠলেও তেরো শতক থেকেই উত্তর ভারতে ঠগিদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ঠগিরা আগে দিল্লির আশপাশে ছিল এবং ১২৯০ সালের পর বাংলায় আসে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *