পৃথিবীর বায়ুমন্ডল সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য

:: আল সাফি ফজল সিদ্দিক ::

আমাদের বায়ুমন্ডল আমাদের এই বাসযোগ্য পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বায়ুমন্ডল আমাদেরকে মহাবিশ্বের সকল ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে আসছে।

আসুন জেনে নেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য।

১) ২০১৩ সালে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেন যে, অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুগুলো মাটি থেকে প্রায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এদের শরীরের রাসায়নিক গঠনের মূলত অর্ধেক থাকে পৃথিবীর এবং অর্ধেক থাকে মহাশূন্যের। এরা এতটা উচ্চতায় ভাসতে থাকে এবং বিভিন্ন কেমিক্যাল খাবার এর জন্য উড়তে থাকে।

২) সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় সূর্য এবং এর চারপাশের কিছু অংশ আকাশ লাল দেখায়। এ দু’টি সময়ে সূর্য দিগন্তরেখার খুব কাছাকাছি অবস্থান করে বলে সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত ঘন ও পুরু বায়ুস্তর ভেদ করে আমাদের চোখে এসে পৌঁছে। সূর্যের সাদা আলোর মধ্যে সাতটি রং মিশে আছে। বায়ুস্তরের ভাসমান ধুলিকণা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষুদ্র কণার ওপর সূর্যরশ্মি পড়লে এর বিভিন্ন রং বিভিন্ন কোণে বিচ্ছুরিত হয়। যে রংয়ের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম তার বিচ্ছুরণ বা বিক্ষেপণ তত বেশি ঘটে এবং যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি তার বিচ্ছুরণ তত কম ঘটে। ফলে বায়ুমণ্ডলে ভাসমান ধূলিকণা, পানিকণা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সূর্যরশ্মির অপেক্ষাকৃত কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বেগুনি, নীল, আসমানি প্রভৃতি বর্ণের আলোর বিচ্ছুরণ সবচেয়ে বেশি ঘটে। পক্ষান্তরে, লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি বলে এর বিচ্ছুরণ কম ঘটে এবং এটি সরাসরি পৃথিবীতে চলে আসে। আর এ কারণেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সূর্য এবং এর চারপাশের আকাশ লাল দেখায়।

এখন প্রশ্ন হলো, সূর্যোদয় অপেক্ষা সূর্যাস্তের আকাশ বেশি লাল দেখায় কেন? হ্যাঁ, স্নিগ্ধ সকালের সামান্য লাল আকাশ যতটা মনোরম, সন্ধ্যার লাল আকাশ ঠিক ততটা নয়। সূর্যোদয়ের লাল আকাশটা বেশ মনোমুগ্ধকর মনে হলেও সূর্যাস্তের পশ্চিম দিগন্ত যেন একটু বেশি লাল এবং কিছুটা তীব্র । এর প্রধান কারণ হলো, বিকেলের বাতাসে ধূলিকণা ও অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ থাকে বেশি এবং সকালের বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ থাকে অপেক্ষাকৃত কম । সন্ধ্যা নামার পর রাত যখন গভীর হতে থাকে তখন আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আস্তে আস্তে শীতল হয়ে আসতে থাকে। এই শীতল পরিবেশে বাতাসে ভাসমান ধুলিকণা ও অন্যান্য গ্যাসীয় উপাদান থিতিয়ে নিচে নামতে থাকে। ফলে সকালের পরিবেশটা হয় নির্মল ও পরিচ্ছন্ন। আর এই নির্মল বাতাসে সূর্য রশ্মির কম বিচ্ছুরণ ঘটে বলে সকালের লাল রং কিছুটা হালকা দেখায়।

৩) স্কাই ডাইভার (যারা সাধারণত অনেক উচু থেকে লাফ দিয়ে থাকেন) Felix Baumgartner একটা অসাধারন রেকর্ড সৃস্টি করেন কিছুদিন আগে। তিনি মাটি থেকে প্রায় ২৩ মাইল বা ৩৭ কিলোমিটার উপর থেকে লাফ দেন। তিনি প্রায় ১৩ কিলোর মতন উচ্চতা ডাইরেক্ট পড়তে থাকেন বাতাসের কোন বাধা ছাড়া এবং এ সময় তার পড়ার গতি ছিলো প্রায় শব্দের গতির সমান। তিনি যখন আস্তে আস্তে আমাদের প্রথম স্তরে প্রবেশ করতে থাকেন তখন থেকে পড়ন্ত গতি কমতে থাকে বাতাসের ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে।

৪) আমরা অনেকেই অরোরা সম্পর্কে জানি না। এগুলো আমাদের মেরু অঞ্চলে ঘটে থাকে। আকাশে একধরনের রঙিন আলোর বিচ্ছুরন ঘটতে থাকে একটা বিশাল এলাকা জুরে। এটা সচরাচর আমরা টিভি বা ভিডিওতে দেখিনা কারন এটা যেসব অঞ্চলে ঘটে সেসব অঞ্চলে মানুষ বাস করতে পারে না এবং অত্যন্ত ঠান্ডা। উত্তর মেরুর ওই অরোরা কে বলা হয় Aurora Borealis এবং দক্ষিন মেরুরটাকে বলা হয় Aurora Australis। এই ঘটনাটা মুলত ঘটে আমার বায়ুমন্ডলের চতুর্থ স্তর থার্মোস্ফিয়ারে।যখন সুর্যথেকে আসা আলোর কনিকাগুলো মেরুর অঞ্চলের ঠান্ডা শীতল বায়ুমন্ডলের কনিকার সাথে আঘাত হানে তখন এই আলোর সৃস্টি হয়। এই আলোটা এতটাই উজ্জল এবং সুন্দর হয় যে সেটা ভুপৃষ্ঠ এবং মহাকাশ দুই দিক থেকেই দেখা যায়।

৫) যদিও আমরা প্রায়ই মনে করি বাতাস দক্ষিণ দিক দিয়ে আসে এবং উত্তর দিকে যায়। কিন্তু এটা আসলে তৈরি হয় পৃথিবীর ঠিক মাঝ বরাবর। মানে নিরক্ষরেখা বরাবর। কারণ সেখানেই সুর্য সবচেয়ে বেশি আলো ফেলে এবং সেখানটাতে বেশি গরম হয়। তাই সেখানে গরম বাতাস তৈরি হয়ে উপরে উঠে যায় এবং আস্তে আস্তে ঠান্ড হতে হতে উত্তর বা দক্ষিন দিকে যায় এবং মেরুঅঞ্চলের দিকে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে নিচে নেমে আসে এবং আবার আস্তে আস্তে নিরক্ষরেখার দিকে যেতে থাকে।

৬) আমরা সবসময়ই একটা ভুল ধারনা বাচ্চাদের দিয়ে থাকি যে, মেঘে মেঘে ঘর্ষণেই বাজ পড়ার শব্দের সৃস্টি হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকানো বা বাজ পড়া হচ্ছে পরিবেশের সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা। এটা এতটাই মারাত্মক যে একটা বাজ যেখানে পরবে সেখানের আশে পাশের বাতাসের তাপমাত্রা একসাথে মুহুর্তেই ৫৪,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌছায়। এই হঠাৎ তাপমাত্র পরিবর্তন সেখানে একটা শক ওয়েভের সৃস্টি করে যেটা শব্দে রুপান্তরিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে।

৭) যদিও বাতাসের চাপ উপরে গেলে কমে যায়। কিন্তু মাটিতেও এমন ঘটনা অহরহ ঘটে। মুলত যখন কোন এলাকায় সুর্যেপ তাপ প্রচন্ড পরিমানে থাকে তখন উক্ত এলাকার বাতাস গরম হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় আর এত সেখানে একটা শুন্যস্থানের সৃস্টি হয় ফলে উক্ত এলাকাতে একটা লো প্রেসার বা নিম্নচাপ এর সৃস্টি হয়। এজন্য যখন ওয়েদার রিপোর্ট টিভিতে দেখায় দেখবেন এক স্থানে লেখা থাকে H এবং অন্য স্থানে থাকে L। এর মানে হচ্ছে বাতাসের উচ্চচাপ এবং নিম্নচাপ।

৮) প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা হচ্ছে এসিড বৃস্টি। ইতিহাস ঘাটলে দেখাযায় অনেক বিশাল বন এবং লোকালয় সহ অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতিহসে অনেকবার এই ঘটনা ঘটেছে। এটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটা ঘটনা। আকাশে মেঘের মধ্যে এসিড এর সৃস্টি হয় সাধারনত সালফার ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড একই সাথে জলীয় বাস্পের সাথে একত্রিত হয়। সালফার ডাই অক্সাইড আসে মুলত ভয়াবহ সব আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে। আর নাইট্রোজেন ডাই অক্ষাইড আসে মেঘ জমার পরে বিদ্যুৎ চমকানোর মাধ্যমে।

০৯) আয়োনস্ফিয়ার ionospher নামকরণের মুল কারন হচ্ছে এই স্তরে আয়ন থাকে। যা মহাশুন্য থেকে আগত এবং সুর্য থেকে আগত রশ্মিগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ক্ষেত্র তৈরি করে। স্যাটেলাইট মহাকাশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই স্তর থেকেই রেডিও তরঙ্গ রিফ্লেকশন করানো হতো।

১০) আমাদের পরিচিত ওজোন স্তর। অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু একসাথে মিলিত হবার ফলে এই ওজোন স্তর গঠিত হয়। এই মিলিত তিন পরমাণুর অক্সিজেন অথবা ওজোন গ্যাস অথবা ওজোন স্তর সূর্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর অতি বেগুনী রশ্মি অথবা সৌর বিকিরন শোষণ করে তা থেকে আমাদের রক্ষা করে। ওজোন স্তর হচ্ছে সেই স্তর যেখানে তুলনামুলকভাবে বেশী মাত্রায় ওজোন গ্যাস সমুহ থাকে এবং এই স্তরের পুরুত্ব স্থানভেদে এবং মৌসুমভেদে কমবেশী হয়

১১) ২০১০ সালে ক্যারিবীয় উপুকলে বয়ে যাওয়া ঘুর্নিঝর Hurricane Karl এর কিছু বাতাসের স্যাম্পল বিজ্ঞানীরা গবেষনাগারে এনেছিলেন পরীক্ষা করার জন্য। তারা অবাক হয়ে আবিস্কার করেছেন সেই বাতাসে প্রায় ২৫ % জীবাণুর সাথে মানুষ এবং প্রানীর মল এর জীবাণুর সাথে মিলে যায়। বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন এই জীবাণুগুলো বৃস্টির পানির মাধ্যমে আকাশে যায়। এবং সেখান থেকেই ঘুর্নিঝড়ের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তারা আরো গবেষণা করে দেখেছেন অনেক বড় বড় ভাইরাসের আক্রমনের জন্য এই জীবাণুগুলো দায়ী।

১২) আমাদের বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন ধরনের গ্যাসের উপস্থিতির জন্যই মুলত পৃথিবী অনেক গরম রয়েছে। অন্যথায় পৃথিবী হচ্ছে প্রচন্ড ঠান্ডা একটা স্থান। যেটা আমাদের অস্বিত্ব রক্ষার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অনান্য বায়ুমন্ডলীয় গ্যাসগুলো সূর্যের তাপ আটকে নিজেদের মধ্যে শোষন করে নেয় এবং আবহাওয়া গরম করে ফেলে। আমরা অনেকেই জানি এটি গ্রীন হাউজ ইফেক্ট নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা যেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত তা হচ্ছে যদি এই গ্যাসের পরিমান বায়ুমন্ডলে বেড়ে যায় তবে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি তাপমাত্রা বায়ুমন্ডলে আটকে যাবে ফলে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে যাবে। এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পরবে। এই মুলত গ্রীনহাউস ইফেক্ট।

১৩) বিশ্বাস করুন আর নাই করুন আমাদের পৃথিবী বেশি কয়েকবার সম্পূর্ণ বায়ুমন্ডল হারিয়ে ফেলেছিলো। প্রথমবার হারিয়েছিলো যখন পুরো পৃথিবীর উপরিভাগে মাটির বদলে ম্যাগমা বা লাভা দ্বারা আবৃত ছিলো তখন। আবার যখন ছোট একটা গ্রহাণু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিলো তখন পুরো বায়ুমন্ডল ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। এই ধরনের একটা ঘটনাতেই চাঁদের সৃস্টি হয়েছিলো। সম্ভবত এই কারনেি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এত বিচিত্রতা এসেছে।

১৪) স্ট্রাটস্ফিয়ার হচ্ছে এমন একটি স্তর যেখানে সবচেয়ে বেশী জেট প্লেন এবং আবহাওয়া বেলুন উড়ে। আমাদের যাত্রীবাহী প্লেন গুলো তখনই খুব দ্রুত উড়তে পারে যখন পৃথিবীর অভিকর্ষ বল আকর্ষণ বল এর জোর কমে যায় এবং বাতাসের সাথে ঘর্ষণ করে যায়। এবং এই দুইটাই এই স্তরে ঘটে। এই স্তরের তাপমাত্রা মেরু অঞ্চলের চেয়ে প্রায় ৪০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড নিচে। ইউরোপে ৫৫ ডিগ্রি সেঃ এবং বিষুবীয় অন্ঝলে ৮০ ডিগ্রী সেঃ। তাই সুর্যের ভয়ানক সব রশ্মি ওজোন স্তরের তাপমাত্রা বৃদ্বি করলেও আমাদের জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব পরে না।

১৫) আমাদের বাতাসের মূল প্রবাহটা শুরু হয় ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর এবং ২৩.৫ ডিগ্র দক্ষিণ মানে হচ্ছে পৃথিবীর একদম মধ্যভাগ থেকে। এ কারনে এখান থেকেই পৃথিবীর বেশিরভাগ মৌসুমি বাতাস এবং ঝড় এর বাতাসের উৎপত্তি হয়। কিন্তু এক ডিগ্রী পাশে যদি আপনি যা্ন সেখানে আর এই বাতাস বা কিছুই পাবেন না। আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে আদ্রবাতাস শুধুমাত্র সমুদ্র থেকেই প্রবাহিত হয়। এবং তার খুব কম পরিমানই ভু-ভাগে যায়। তাই অনেক স্থানে বাতাস এতটাই শুস্ক হয়ে যায় যে বিশাল সব মরুভুমির সৃস্টি হয়।

১৬) এবং সর্বশেষ হচ্ছে এক্সোস্ফিয়ার। এটি হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে দূরবর্তী স্তর,এক্সোবেস থেকে শুরু হয়ে ৭০০ কিলোমিটার উপরে বিস্তৃত এবং সমুদ্রতল হতে প্রায় চাঁদের দূরত্বের অর্ধেক পথ। এটি প্রধানত হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং কিছু ভারী অনুসমূহ যেমন নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে গঠিত। এই অণু ও পরমাণুসমূহ পরস্পর থেকে এত দূরে থাকে যে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না ফলে বায়ুমন্ডল আর গ্যাস হিসাবে আচরণ করে না। এখান থেকেই মুলত মহাকাশ শুরু হয়। এই স্তরের উচ্চতা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। যখন সুর্যে পৃষ্ঠতল বা উপরিভাগ শান্ত থাকে তখন এটি মাটি থেকে প্রায় ১০,০০০ কেলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায় আবার যখন সৌরঝড় শুরু হয় তখন এটি সংকুচিত হয়ে ১০০০ কিলোমিটার এর নিচে চলে আসে।

১৭) এর পরের স্তর হচ্ছে থার্মোস্ফিয়ার । প্রায় ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল;২৬০.০০০ ফুট) উপরে অবস্থিত এবং মেসোপজ থেকে থার্মোপজ পর্যন্ত এই স্তরের তাপমাত্রা উচ্চতা বৃদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে যা এক্সোস্ফিয়ারে প্রবেশ করলে উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুবক হয়।যেহেতু থার্মোপজ এক্সোস্ফিয়ার নিচে অবস্থিত তাই একে এক্সোবেসও বলা হয়।এর গড় উচ্চতা পৃথিবী থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সৌর ক্রিয়া ও ব্যাপ্তি সঙ্গে পরিবর্তিত হয় ৫০০ থেকে ১০০০ (৩১০-৬২০ মাইল; ১৬০০০০০-৩৩০০০০০ ফুট) কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই স্তরের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১,৫০০° সেলসিয়াস (২,৭০০° ফাঃ) পর্যন্ত হয়।আমাদের পৃথিবীর সমস্ত স্যাটেলাইট এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এর কক্ষপথ এই স্তরের ৩২০ থেকে ৩৮০ কিলোমিটারের (২০০ এবং ২৪০ মাইল) মধ্যে অবস্থিত। মেরুজ্যোতি যা উত্তর গোলার্ধে অরোরা বোরিয়ালিস (aurora borealis) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে অরোরা অস্ট্রালিস (aurora australis) নামে পরিচিত তা মাঝেমধ্যে থার্মোস্ফিয়ার এবং এক্সোস্ফিয়ার নীচের অংশ দেখা যায়।

১৮) এর পরের স্তর হচ্ছে মেসোস্ফিয়ার। মেসোস্ফিয়ার সমুদ্রপৃষ্ট হতে ৫০ কিলোমিটার (১৬০,০০০ ফিট ৩১ মাইল) উপরে স্ট্র্যাটোপজ থেকে শুরু হয়ে মেসোপজ পর্যন্ত প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ (৫০-৫৩ মাইল; ২৬০০০০-২৮০০০০ ফুট) কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। উল্কাপিন্ড সাধারণত ৭৬ কিমি থেকে ১০০ কিমি এর মধ্যে উচ্চতায় মেসোস্ফিয়ার পর্যন্ত এসে ধ্বংস হয়ে যায়। মূলত মহাকাশ থেকে আগত বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উল্কাপিন্ড এখানে এসে ধ্বংস হয়ে যায়। মেসোস্ফিয়ারে উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্র আবার হ্রাস যায়। মেসোস্ফিয়ারের উপরে অবস্থিত মেসোপজে তাপমাত্রা এত হ্রাস পায় যে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান এবং ঐ স্থানের গড় তাপমাত্রা প্রায় -৮৫° সেলসিয়াস (-১২০° ফাঃ, ১৯০ কেলভিন)।এই উচ্চতায় তাপমাত্রা -১০০° সেলসিয়াস (-১৫০° ফাঃ; ১৭০ কেলভিন) পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। এই স্তরের ঠান্ডা তাপমাত্রার কারনে এখানে জলীয় বাষ্প জমাট বাঁধে।

১৯) এর পরের লেয়ার হচ্ছে স্ট্রটেস্ফিয়ার। এটা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১২ কিলোমিটার (৭.৫ মাইল, ৩৯,০০০ ফুট) উপরে ট্রপোপজ হতে শুরু হয়ে স্ট্র্যাটোপজ পর্যন্ত ৫০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার (৩১-৩৪ মাইল; ১৬০,০০০- ১৮০,০০০ ফুট) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।স্ট্রাটস্ফিয়ারে শীর্ষে বায়ুমন্ডলীয় চাপ সমুদ্র পৃষ্টের ১০০০ ভাগের এক। এখানেই মুলত রয়েছে ওজোন স্তর। এই লেয়ার দ্বারা সুর্য থেকে আগত মানব দেহের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ শোষণ করা হয়। তাই এখানে উচ্চতার বৃদ্ধির কারণে এই স্তরের তাপমাত্রা বাড়ে। ট্রপোপজে তাপমাত্রা যথেষ্ট কম, -৬০° সেলসিয়াস বা -৭৬° ফাঃ (২১০ কেলভিন)( বরফ শিতলের চেয়ে ঠান্ডা); কিন্তু স্ট্র্যাাটোস্ফিয়ার ধরে যত উপর দিকে ওঠা যায়, তত উষ্ণতা বাড়তে থাকে। স্ট্র্যাটোপজে পৌঁছে এই তাপমাত্রা তার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছয় – ০° সেলসিয়াস। স্ট্র্যাটোপজ বাস্তবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ও মেসোস্ফিয়ারের মধ্যবর্তী সবচেয়ে গরম অঞ্চল

২০) আমাদের বায়ুমন্ডল এর পাঁচটি স্তর আছে যা আমাদের জীবন ধারনের জন্য চমৎকার একটা পরিবেশ সৃস্টি করেছে।প্রথমটি হচ্ছে ট্রপোস্ফিয়ার। এটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ মাইল ( ১৭ কি.মি.) পর্যন্ত উপরে বিস্তৃত। আমাদের পৃথিবীর সমস্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত ঘটনাদি এই স্তরেই ঘটে যেমন টাইফুন, ঘুর্নিঝড়, টর্নেডো, বৃস্টিপাত, তুষারপাত সব কিছু। সাধারনত ট্রপোস্ফিয়ারের সর্ব নিম্ন অংশ গরম থাকে এবং উচ্চতা বৃদ্বির সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা হ্রাস পায় ঠান্ড হতে থাকে । মুলত সমস্ত আবাহাওয়ার উপাদান যেমন মেঘ ইত্যাদিসহ বেশির ভাগ উপাদান এই স্তরেই থাকে। ট্রপোস্ফিয়ার সমস্ত বায়ুমন্ডলের প্রায় ভরের ৮০% ধারন করে ।

২১) হয়ত খেয়াল করেছেন আকাশের অনেক উচু দিয়ে কিছু প্লেন এর পেছনে মেঘের একটা সাদা লাইন তৈরি হয়। অনেকের বাচ্চারাই প্রশ্ন করে এটা কেন হয়? আচ্ছা কখনো আপনি জানতে চয়েছেন এমনটা কেন হয়? আসলে এই ঘটনা ঘটে যখন প্লেন এর ইঞ্জিন থেকে বের হওয়া গরম হাওয়া যখন পেছনের প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে আসে তখন। বিষয়টা আরো ক্লিয়ার করছি। আমরা যখন শীতের দিনে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়ায় নিশ্বাস ফেলি বা মুখ দিয়ে ফু দেই তখন আমাদের মুখ দিয়ে ধোয়া বের হয় নিশ্চই। এটার কারন হচ্ছে আমাদের মুখের বাতাস গরম এবং বাইরে সেটা আসার সাথে সাথে ঠান্ডা হয়ে জমে যায়। এই প্লেনের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা ঘটে কিন্তু এখানে অনেক বেশি পরিমানে ঘটে।এই ঘটনাটা যখন দেখবেন তার মানে হচ্ছে বড় ধরনের বৃস্টি বা ঝড় আসার সম্ভাবনা বুঝে নেবেন।

২২) গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিরোধী অনেকেই বলে থাকেন কই আমাদের শহরতো মোটেই গরম হয়নি উল্টো আরো শীত বেরেছে। আসলে এটা একটা ব্যালেন্সড এর বিষয় যেটা আমাদের বায়ুমন্ডল চেস্টা করছে ঠিক করার জন্য। অন্যকোন স্থানের তাপমাত্রা কিন্তু অত্যন্ত বাড়তি এবং সেটাকে কভার করার জন্য বায়ুমন্ডল একটা ব্যালেন্স করার চেস্টা করে যেটা পৃথিবীর পরিবেশকে আরো ভয়ানক করে তুলছে। তথাপি আমাদের পুরো বায়ুমন্ডলের এভারেজ তাপমাত্রা আরো বাড়ছে।

২৩) বেশির ভাগ মানুষই এই প্রশ্নটার ভুল উত্তর দেয়। প্রশ্নটা হচ্ছে ,কোথায় সবচেয়ে বেশি পানি থাকে মেঘযুক্ত বায়ুমন্ডলে নাকি মেঘমুক্ত আকাশে। আপনি হয়ত ভাবছেন মেঘের মধ্যেই তো সব পানিগুলো থাকে যা বৃস্টি আকারে পরে। তাহলে সেখানেই তো বেশি পানি থাকার কথা। কিন্তু এটা ভুল আসলে উত্তরটা হচ্ছে মেঘমুক্ত আকাশে বেশি পানি থাকে। বলুন তো কিভাবে? আসলে আমাদের বায়ুমন্ডলে বেশিরভাগ পানি বাস্পিয় আকারে ঘুরে বেরায় যেটাকে আমরা আদ্র আবহাওয়া বলি। আদ্র আবহাওয়ায় আপনি গরম লাগলেই ঘামছেন কারন বাতাসে জলিয়বাস্প আপনাকে ঘামাচ্ছে। বিজ্ঞানিরা হিসেব করে দেখেন বাতাসে জলিয় বাস্পের পরিমান আকাশের জমা মেঘের পানির চেয়ে অনেক অনেক বেশি থাকে।

২৪) আমরা আমাদের সায়েন্স ক্লাসে জেনেছি যে, আমাদের বায়ুমন্ডলে ৭৮% নাইট্রোজেন, ২১% অক্সিজেন এবং খুব অল্প পরিমাণে এরগন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্যাস আছে। তবে আপনি এটা হয়ত জানেন না যে আমাদের বায়ুমন্ডল হচ্ছে মহাবিশ্বের একমাত্র আবিস্কৃত স্থান যেখানে অক্সিজেন ফ্রি ফর্ম বা স্বাধীন ভাবে পাওয়া যায়। অক্সিজেন সাধারন অত্যন্ত বিক্রিয়া মুলক গ্যাস তাই এটি মহাকাশের শুন্যে অন্যান্য সব ক্যামিকেলের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে এটি আলাদা থাকার কারনে এটি খুবই সহজে আমাদের জন্য বসবাস উপযোগী করে তুলেছে।

২৫) বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, বায়ুমন্ডলের রং কিন্তু রক্তবর্ণ লাল। কিন্তু যখনই সুর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে সাথে সাথে বায়ুমন্ডল, পানি, বাতাস এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো তা শোষন করা শুরু করে এবং বায়ুমন্ডলে তা আবার ছড়িয়ে দেয়। এখন যখন সুর্যের আলো পৃথিবীতে আসে তখন তার ওয়েভলেন্থ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যা থাকে তাতে তার রং থাকে লাল রক্ত বর্ণ। কিন্তু আমাদের বায়ুমন্ডল যে আলো বিচ্ছুরণ করে সেটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে আরো ছোট যার রং হয় বেগুনি। মজার বিষয় হচ্ছে আমদের চোখ বেগুনি রঙের সেই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য মোটেই ধরতে পারে না। এটা আমাদের চোখে নীল রং বেগুনি থেকে বেশি ক্যাচ করে তাই আমরা আকাশের রং নীল দেখি বেগুনি দেখার চেয়ে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *