গত শতাব্দীর বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাস

।। ফজলে এলাহী ।।

‘ব্যান্ড সঙ্গীত’ বাংলাদেশের গানের ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ একটা অংশের নাম যাকে তারুণ্যর সঙ্গীতও বলা হয়।

বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের শুরু ও সমৃদ্ধ ইতিহাসটা গত ১৯ শতকের । নানা পথ পরিক্রমায় আজ বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীত প্রতিষ্ঠিত যার হয়েছিল গত শতকেই। আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতের কালজয়ী যত জনপ্রিয় গান ও কিংবদন্তী সবই গত শতকে পাওয়া যা নিয়ে সংক্ষিপ্তকারে কিছুটা ধারনা দেয়ার জন্যই আমার আজকের এই লিখাটা ।

৭০ ও ৮০ দশকের পর বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ সময়টা হলো ৯০ দশক। পুরো ৯০ দশকটা ছিল ব্যান্ড সঙ্গীত বিকশিত ও শ্রোতাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত পাওয়ার লড়াই যা সম্পূর্ণ সফল ।

স্বাধীনতার আগের ব্যান্ড সঙ্গীত
এই বাংলায় ব্যান্ড সঙ্গীতের শুরুটা ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সময়ে। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে পড়ুয়া ৫ কিশোর জনসন, ফজলে রব, আলমগীর [ বর্তমানে পাকিস্থানের জনপ্রি পপ সঙ্গীত শিল্পী], রফিক ও সাব্বির মিলে গঠন করে ‘আইওলাইটস’ নামের একটি ব্যান্ড যাকে বলা হয় বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রথম ব্যান্ড।

‘আইওলাইটস’ সেই সময়ে হোটেল শাগবাগ [বর্তমানে রূপসী বাংলা] ও ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত পরিবেশনা করতো। ১৯৬৫ সালে ব্যান্ডটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সর্বপ্রথম পরিবেশনাও করে যা ছিল টেলিভিশনে কোন ব্যান্ড দলের সর্বপ্রথম পরিবেশনা। ১৯৬৫ সালের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে আরেকটি ব্যান্ড গঠিত হয় যার নাম ‘জিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠী’। জিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল পারিবারিক ঘরনার অর্থাৎ যার সদস্যারা সবাই ছিলেন একই পরিবার থেকে উঠে আসা। ওমর খালেদ রুমি ছিলেন ‘জিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠী’র মূল শিল্পী যিনি পরবর্তীতে ব্যান্ড অন্য একটি ব্যান্ড গঠন করেন যার ফলে নাজমা জামান জিঙ্গার মূল কণ্ঠশিল্পীর দায়িত্ব পালন করেন ।সেইসময়ে ব্যান্ড শিল্পিরা ইংরেজি গানই করতো প্রধানত কিন্তু ওমর খালেদ রুমি বাংলা গান করতেন যার ফলে ওমর খালেদ রুমিকে বলা যায় বাংলায় প্রথম ব্যান্ড শিল্পী। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামে ফরিদ রশীদ, নিওম্যান্ডেজ, নোয়েল ও শাকিল গড়ে তোলেন ‘লাইটনিংস’ নামের আরও একটি ব্যান্ড। ঠিক একই সময়ে মাহমুদ, তোতা, চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল ও ফারুক মিলে ব্যান্ড গঠন করেন ‘র্যা ম্বলিং স্টোনস’ নামের আরেকটি ব্যান্ড। দুটো ব্যান্ডই সেই সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।এই ব্যান্ড দুটোর পাশাপাশি ঢাকায় ‘উইন্ডি সাইট অব কেয়ার’ নামে আরেকটি ব্যান্ডের জন্ম হয়। ১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আইওলাইটস, উইন্ডিসাইট অব কেয়ার, র্যা ম্বলিং স্টোনস ও লাইটনিংস একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড নির্বাচিত হয় ‘উইন্ডি সাইট অব কেয়ার’। এ ব্যান্ডগুলোর পাশাপাশি ১৯৬৬ সালে নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেওয়া ‘বকলম’ ব্যান্ডটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা পায় ফায়ার অ্যান্ড আইস ব্যান্ডটি। ১৯৬৯ সালে প্রথম ভাঙনের কবলে পড়ে ‘র্যা ম্বলিং স্টোনস’। এ ব্যান্ডের সদস্যরা আলাদা হয়ে গিয়ে তৈরি করে নতুন ব্যান্ড ‘টাইম গো মোশন’। এরপরই দেশের প্রথম ব্যান্ড আইওলাইটসের ভাঙন ধরে। ড্রামার সাব্বির এবং রিদম গিটারিস্ট রফিক ব্যান্ড ছেড়ে দেওয়ায় এটি ভেঙে যায়।[ উইকিপিডিয়া]

স্বাধীনতার পর বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত
স্বাধীনতা পূর্বে এইদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের যে শুরুটা হয়েছিল তার পরিপূর্ণ প্রাপ্তিটা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের মাধ্যমে। ৭০-৯০ দশক এই সময়ে বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে ব্যান্ড সঙ্গীত ছিল দারুন রোমাঞ্চকর কিছু ও উম্মাদনার নাম। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরদিনের জন্য ঠাই করে নেয়া সবগুলো ব্যান্ডের জন্ম, উত্তরন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঐ ৭০-৯০ দশকের মাঝেই।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ব্যান্ড কোনটি তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারও কারও মতে, ‘আন্ডার গ্রাউন্ড পিস লাভারস’ স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ব্যান্ড। দেশের প্রথম ব্যান্ড বিতর্কের পর, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ব্যান্ড বিতর্কের এ ব্যান্ডটির উদ্যোক্তা ওমর খালেদ রুমী। ব্যান্ডে তার সঙ্গী ছিলেন সালাউদ্দিন, সাজ্জাদসহ আরও বেশ ক’জন। অধিকসংখ্যকের মতের ভিত্তিতে আগলি ফেসেস ব্যান্ডকেই প্রথম ব্যান্ড ধরা হয়েছে। ঠিক একই সময়ে চট্টগ্রামের কিছু গানপাগল তরুণ সাজিদ উল আলম (গিটার), লুলু (গিটার) নেওয়াজ (পারকিউশন), রনি বড়ুয়া(ড্রামস) ও তাজুল (ভোকাল) মিলে একটি দল গঠন করে যার নাম ‘সোলস’। অনেকের মতে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘সোলস’ হলো প্রথম ব্যান্ড। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ব্যান্ডের স্বীকৃতি না পেলেও প্রথম কনসার্ট আয়োজন করে আন্ডার গ্রাউন্ড পিস লাভারস। ১৯৭২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে ব্যান্ডটি প্রথম টিকিট কনসার্ট করে। ১৯৭২-৭৩ সালের আগ পর্যন্ত ব্যান্ডগুলো ইংরেজি গান পরিবেশন করত। বাংলা গানে আগ্রহী হয়ে ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফিরোজ সাঁইসহ কয়েকজন বন্ধু মিলে গঠন করেন ‘স্পন্দন’ নামের একটি ব্যান্ড। ব্যান্ডের ‘এমন একটা মা দে না’ গানের সুবাদে তুমুল জনপ্রিয় হয় ব্যান্ডটি। এ সময় উচ্চারণ ব্যান্ড নিয়ে আবির্ভাব ঘটে পরবর্তীকালের গুরু খেতাব পাওয়া শিল্পী আজম খানের। ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’ নিয়ে আসেন ফকির আলমগীর। ১৯৭৩-৭৪ সালে ফেরদৌস ওয়াহিদের গানের পাশাপাশি আজম খানের ‘রেলাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’; ফিরোজ সাঁইর ‘ইশকুল খুইলাছে রে মওলা’ এবং ফকির আলমগীরের ‘ও সখিনা’ গানগুলো সারা বাংলায় আলোড়ন তোলে। পরবর্তীকালে এ চার শিল্পীর সঙ্গে পিলু মমতাজ যোগ দেন এবং পাঁচপীর নাম নিয়ে উচ্চারণ ব্যান্ডের সঙ্গে তারা পারফর্ম করতে থাকেন। কিন্তু পঞ্চশিল্পীর কাউকেই ব্যান্ড নিয়ে খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি।

এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে ধীরে ধীরে ব্যান্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা তরুণদের মাঝে পেতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে ‘ফিডব্যাক’ [১৯৭৬], ‘বালার্ক’ [১৯৭৬], ‘অ্যাবনরমাল থ্রি প্লাস’ [১৯৭৬], ‘মাইলস’ [১৯৭৯]-এর মতো ব্যান্ডগুলো বাংলা গানে পাশ্চাত্যের ছোঁয়া নতুন রূপরেখা তৈরি করে। ৮০র দশকে শুরুর দিকে ঢাকা চট্টগ্রামের পাশাপাশি খুলনা অঞ্চলের তরুণদের মাঝেও ব্যান্ডদল গঠনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। চাইম, অবসকিউর, ডিফরেন্ট টাচ, অরবিট, নোভা, ব্লুজ সহ অসংখ্য ব্যান্ড খুলনা থেকে উঠে আসে যার মধ্যে অনেক ব্যান্ডই ৯০ দশকে এসে ভেঙে যায়।

১৯৭২ এর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লুলু ব্যান্ড ত্যাগ করার পূর্বে নকীব খান নামের এক তরুণ দলে যোগ দেয় যিনি পরবর্তীতে আমাদের প্রিয় ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ড এর প্রতিষ্ঠাতা ও ভোকাল এবং বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন। নকীবের পথ অনুসরণ করে এরপর ব্যান্ড এ যোগ দিলেন নকীবের ছোট ভাই পীলু খান ও তপন চৌধুরী । এরই মধ্য ১৯৭৭ এ ব্যান্ড এ যোগ দেয় আরেক তরুণ নাসিম আলী খান এবং ১৯৭৮ এ যোগ দেন বাংলা ব্যান্ডের আরেক ‘ক্ষ্যাপা’ তরুণ আজকের কোটি কোটি স্রোতা ভক্তদের ‘বাচ্চু ভাই’ অর্থাৎ আইয়ুব বাচ্চু। শুরু হলো বাংলার সর্বকালের সেরা একটি ব্যান্ড দলের যাত্রা যেখান থেকে বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের আকাশে সমহিমায় ঠাই করে নিয়েছে একটি একটি নক্ষত্র। সেদিন তরুণ আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যান্ডের একজন গিটারিস্ট , ভোকাল, গীতিকার ও সুরকার। ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে যোগ দেয় বাংলা আধুনিক গানের আরেক দিকপাল কুমার বিশ্বজিৎ। ১৯৮০ সালে বের হয় ‘সোলস’ এর প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’ শিরোনামে যা ছিল বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের প্রথম কোন ব্যান্ডের অ্যালবাম। যেখানে পেয়েছিলাম বাংলা ব্যান্ড এর কালজয়ী চিরসবুজ ”মন শুধু মন ছুঁয়েছে” গানটি আরও পেয়েছিলাম ” তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে” ”ও পাগল মনরে” ”দরগায় মোম জ্বেলে কি হবে” ” প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত” চলো না হারিয়ে যাই” ” এই মুখরিত জীবন” এর মতো গানগুলি।

১৯৭৯ সালে ফরিদ, হ্যাপি আখন্দ, কমল, মুসা, ল্যারি, ইশতিয়াক ও রবিনকে নিয়ে ১৯৭৯ সালে গড়ে উঠে ব্যান্ড দল ‘মাইলস’। ঐ সালেই কিছু সদস্য ব্যান্ড ছেড়ে গেলে হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ মাইলসে যোগ দেন যারা এখন অবধি মাইলসের সাথেই আছেন। ১৯৮২ এবং ১৯৮৬ তে ‘Miles’ & ‘A Step Farther’ নামে দুটি ইংলিশ অ্যালবাম প্রকাশ করে। ‘Miles’ শিরোনামের অ্যালবামটি তিনটি মৌলিক গানসহ সাতটি কাভার সং এবং ‘A Step Farther’ অ্যালবামে থাকে সাতটি মৌলিক গান ও তিনটি কাভার সং। এরই মাঝে হ্যাপি আখন্দ ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে ১৯৮২ সালে কীবোর্ডিস্ট ও ব্যাক ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কীবোর্ড বাদক ও একজন সফল সুরকার মানাম আহমেদ। এবং ১৯৮৭ সালে রক-স্টারটার মাহবুব রশীদ মাইলসের ড্রামার হিসেব জয়েন করেন।

৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায় ‘ব্যান্ড শো’ অনুষ্ঠানটি। এই ব্যান্ড শোর মাধ্যমেই শ্রোতাদের কাছে খুব তাড়াতাড়ি পরিচিত ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তৎকালীন সময়ের সকল জনপ্রিয় ব্যান্ড। তখন আধুনিক গানে তপন, বিশ্বজিৎ, শেখ ইশতিয়াক আর সিনেমাতে এন্ডরু কিশোর এর স্বর্ণযুগ। আযম খান , হ্যাপি টাচ, সোলস,অবস্কিউর,চাইম, ফিডব্যাক, নোভা ছিল সব কিশোর তরুনের দল।৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত উইনিং, ফিলিংস, ডিফরেন্ট টাচ, মনিটর, অরবিট, প্রমিথিউস,সিম্ফনি, তীর্থক, সহ অসংখ্য ব্যান্ড গড়ে উঠে যাদের শ্রোতারা পায় ৯০ দশকের শুরুতে অডিও অ্যালবামের মাধ্যমে।

১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ফিলিংস’ এ যোগ দেন জেমস।তখন কুমার বিশ্বজিৎ বিহীন ‘ফিলিংস’এর ভোকাল ছিলেন আরেক অসাধারণ প্রতিভা ও কণ্ঠ পাবলো। সে সময় ঘর ছাড়া জেমস ও’ ফিলিংস’ ব্যান্ড যাদের অনুশীলন থেকে শুরু করে থাকা ,খাওয়া সব হতো সেই “আজিজ বোর্ডিং” এর এক কামরায়। সেই কামরায় তাঁদের কত বিনিদ্র রাত কেটেছে শুধু গান তৈরির নেশায়। ১৯৮৯ সালে বের হয় “ফিলিংস’ এর ১ম অ্যালবাম “স্টেশন রোড”। যেখানে সেই “অনন্যা জেমস” আবারো একইরকম অন্য কিছু ভালোলাগা নিয়ে হাজির হয়। সেই অ্যালবাম এর “ঝর্না থেকে নদী”, “স্টেশন রোড” “দুঃখ কেন কররে মন” “আমায় যেতে দাও” “রুপসাগরে ঝলক মারিয়া” “সত্যই সুন্দর” সহ সবগুলো গানই ছিল অপূর্ব।

১৯৮৪ সালে ঢাকা শহরের স্কুল পড়ুয়া গানপাগল কয়েকজন ক্ষ্যাপা কিশোর ‘ওয়ারফেইজ ‘ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করে। সেই কিশোরদের লাইনাপ ছিল এমন কমল- বেজগিটার , ড্রামস- হেলাল, মীর- লিড গিটার, নাইমুল- লিড গিটার, বাপ্পি- ভোকাল । পরবর্তীতে মির,হেলাল ও বাপ্পি ব্যক্তিগত কারনে ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে কমল লিড গিটারের দায়িত্ব নেয়, বাবনা বেজ গিটার ,টিপু ড্রামস ও রাসেদ ভোকাল এর দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ড এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে নাইমুল ও রাসেদ চলে গেলে রাসেল কিবোর্ড ও সাঞ্জয় ভোকাল এর দায়িত্ব নেয়। অবশ্য তাঁরা দুজন আসার আগে ইন ঢাকা ব্যান্ড এর মাসুক ও ফুয়াদ অথিতি হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। সেই কিশোররা (বাবনা,রাসেল,সাঞ্জয়,কমল টিপু) সবাই তখন স্কুলের ছাত্র। তারা অবসরে তাদের সেই ব্যান্ড নিয়ে অনুশীলন করতো। তখনো বাংলাদেশ এর মানুষরা তাদের চিনতো না। তারা প্রথম থেকেই সবসময় ইংরেজি গান গাইতো। তখন স্টেজ এর পারফর্ম বেশি চলতো। তাই যারা স্টেজ শো গুলো দেখত তাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো সেই কিশোর রা। এমন কি তখনকার নামিদামি ব্যান্ড ফিডব্যাক, সোলস, অবসকিউর সহ সবাইকে তারা চমকে দিয়েছিলো তাদের অসাধারণ পারফরমেন্স এর কারনে। এইভাবেই চলছিল কিশোরগুলোর ব্যান্ড ‘ওয়ারফেইজ’ যারা তখনো কোন বাংলা গান গাইতে জানতো না। ১৯৯০ সালের এক বিকেলে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত এর অন্যতম জনপ্রিয় কণ্ঠ মাকসুদুল হক একদিন মিরপুর পল্লবীতে সেই কিশোরদের নিয়ে বসলেন। আলচনার বিষয় ‘কেন সেই কিশোররা শুধু ইংরেজি গান গাইছে”? সেই কিশোরদের সাথে প্রিয় মাকসুদ ভাই টানা ৪ ঘণ্টা একা তর্কযুদ্ধ করে গেলেন। একসময় সেই কিশোররা বাংলা ব্যান্ড এর এই পুরাধার কথা মেনে নিয়ে রাজি হলো ইংরেজি গান বাদ দিয়ে পুরোপুরি বাংলা গান করার এবং পুরো বাংলায় একটি হার্ডরক অ্যালবাম বের করবে শ্রোতাদের জন্য। এভাবেই ইংরেজি হার্ড রক গান থেকে বাংলা হার্ড রক গানে ফিরে আসে ‘ওয়ারফেইজ’ যাদের প্রথম অডিও অ্যালবাম আমরা পাই ৯১ সালে। সেই থেকে আজ অবধি ওয়ারফেইজ বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের হার্ড রক গানে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

৭০ ও ৮০ দশকের পর বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ সময়টা হলো ৯০ দশক।পুরো ৯০ দশকটা ছিল ব্যান্ড সঙ্গীত বিকশিত ও শ্রোতাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত পাওয়ার লড়াই যা সম্পূর্ণ সফল । ৯০ দশকের শুরুতেই [৯১ সালে] ‘সোলস’ থেকে বের হয়ে আইয়ুব বাচ্চু ‘LRB’ নামের নতুন একটি ব্যান্ড গড়ে তুললেন। যার প্রথম অ্যালবাম ‘হকার ও একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে’ বাজারে আবার ঝড় তুলল। একসাথে দুইটি অ্যালবাম পেয়ে শ্রোতারাও খুশি হলেন।শুরু হলো “বাচ্চুর যুগ’। ঠিক এই সময়ে যারা এতদিন ইংলিশ গান গাইত মানে ‘মাইলস’ বাংলা গান নিয়ে নতুন করে হাজির হলো ‘চাঁদ তারা সূর্য’ গানটি নিয়ে। চারিদিকে তখন মাইলস’ এর গান সবার মুখে মুখে। এমন সময় জেমসের ‘ফিলিংস’তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘জেল থেকে বলছি’ নিয়ে হাজির হলো এবং মাইলস ও এল.আর.বি এর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসিয়ে দিলো অর্থাৎ আজকের ‘জেমস’ এর নতুন জন্ম হলো। মজার ব্যাপার হলো যে সবগুলি প্রকাশিত অ্যালবাম ছিল ‘সারগাম’ এর। একটু কল্পনা করুন যে ‘সারগাম’ বাজারে কি রকম আধিপত্য বজায় রেখেছিলো যা আজো কেউ পারেনি।

৯০ দশকের শুরুতেই আমরা উইনিং, প্রমিথিউস, রকস্টারটা,ওয়ারফেইজ এর মতো অসাধারন কিছু ব্যান্ডদলকে পাই যাদের মধ্যে রকস্টারটা আজ নেই। সেই সময়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড চাইম থেকে বের হয়ে আশিকুজ্জামান টুলু গঠন করেন ‘আর্ক’ নামের নতুন একটি ব্যান্ড যা পুরো ৯০ দশক জুড়েই জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ব্যান্ডগুলোর একটি হয়েছিল।

‘উইনিং’ ছিল সফট রক ও মেলোডি ধাঁচের দারুন একটি ব্যান্ড যার ভোকাল ছিলেন চন্দন। ১৯৮৩ সালে উইনিং ব্যান্ডটি গঠিত হয় যার সদস্য ছিলেন হায়দার হোসেন (গিটার ও ভোকাল),মিতুল(গিটার ও ভোকাল), রঞ্জন (ড্রামস ও ভোকাল,) শেলী (বেজ গিটার),রানা (কি-বোর্ড),ফাহিম (ইংরেজি গানের ভোকাল)। মাত্র দুটি অ্যালবাম দিয়েই ‘উইনিং’ ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে জনপ্রিয় ব্যান্ড হিসেবে ঠাই করে নিয়েছে। ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে উইনিং ব্যান্ড তাদের মূল ভোকালের খোঁজ শুরু করে। তখন বর্তমানে নগর বাউল ব্যান্ডের জেমসকে তারা কিছু সময়ের জন্য ব্যান্ডের সাথে অনুশীলনে রাখে।পরে ১৯৮৭ সালে চন্দন ব্যান্ডে যোগ দেয় গিটারিস্ট ও ভোকাল হিসেবে।

এভাবেই ধীরে ধীরে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত গত শতাব্দিতে পূর্ণতা পেয়েছে । পরিশেষে শুধু এইটুকু বলবো আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গর্ব স্বাধীনতার যুদ্ধ দেখতে পারিনি, কিন্তু বাংলাদেশের স্বৈরাচার আন্দোলন, বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগ এর মত তরুণদের দুইটি গর্বের পুরোটাই দেখেছি যা আমাকে অনেক বেশি আমার বাংলাদেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *