বেগম নুন ও ভিকারুননিসা নুন স্কুল

।। তাহসিন আহমেদ ।।
জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান মহিলা ভিকারুননিসা নুন। পূর্ববর্তী নাম ভিক্টোরিয়া। ১৯৪৫ সালে ফিরোজ খান নুনের সাথে বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ভিক্টোরিয়া নাম পরিবর্তন করে ভিকারুননিসা নুন নাম গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের (বর্তমানে বাংলাদেশ) গভর্নর স্যার ফিরোজ খান নুনের সহধর্মিনী ভিকারুননিসা নুন ঢাকায় মেয়েদের জন্য মানসম্পন্ন ও আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ভিকারুননিসা স্কুল।

স্কুলটি প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক সময়ে শিক্ষা বিস্তার ও প্রসারে অবদান হিসেবে নুন পরিবার একটি তহবিল গঠন করেন যা থেকে উচ্চশিক্ষা লাভে আগ্রহী তৎকালীন পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে গমনের জন্য বৃত্তিসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দান করা হত। অবশ্য এই তহবিল ভিকারুননিসা নুন স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না।

ভারতীয় রাজনীতিতে তার স্বামীর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা থাকার কারণে বেগম নুনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জনমত খুব ঘনিষ্ঠভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ ছিল। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনা করেন এবং পাঞ্জাব প্রাদেশিক মহিলা উপকমিশনারের সদস্য হন। তিনি ছাত্রী এবং অন্যান্য নারীর স্বেচ্ছাসেবকদের একটি গোষ্ঠীকে সংগঠিত করেন এবং মুসলিম লীগের প্রচারের জন্য অন্যান্য জেলা ভ্রমণ করেন।

পাঞ্জাবের আইন অমান্য করার আন্দোলনে বেগম নূন ছিলেন নেতৃস্থানীয় মহিলা নেত্রীদের অন্যতম। তিনি ব্রিটিশদের দ্বারা পরিচালিত খিজার মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে সফলভাবে মিছিল ও বিক্ষোভের আয়োজন করে তিনবার গ্রেফতার হয়।

দেশ বিভাজনের পর তিনি বিভিন্ন শরণার্থী কমিটি এবং ক্যাম্পে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে রেডক্রসের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

দীর্ঘ অসুস্থতার পর বেগম ভিকারুননিসা নুন ২০০০ সালের ১৬ জানুয়ারি ইসলামাবাদে ইন্তেকাল করেন।

ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজ ১৯৪৭ সালে প্রিপারেটরি স্কুল নামে একটি স্কুল ঢাকার রমনার জিমখানায় স্থাপিত হয়। ১৯৫০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফিরোজ খান নুন এর স্ত্রী ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলটি পরিদর্শনে এসে এর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হন এবং তারই উদ্যোগে ১৯৫২ সালের ১৪ জানুয়ারি স্কুলটি ভিকারুননিসা নুন স্কুল নামে ঢাকার বেইলী রোডে বৃহৎ কলেবরে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাত্র কয়েকটি শিশু নিয়ে একটি প্রিপারেটরি স্কুল হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে।

প্রাথমিক বিদ্যায়তনটি দ্রুত হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৫৬ সালে সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রস্তুতি শুরু করে। পাবলিক পরীক্ষাসমূহে অত্যন্ত ভাল ফলাফল এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের জন্য স্কুলটি খ্যাতি লাভ করে।

১৯৭৮ সালে এই স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে কলেজ শাখা চালু করে।

১৯৮৬ সালে মূল শাখায় একটি দিবা শাখা খোলা হয়। পরবর্তী সময়ে ধানমন্ডি, বসুন্ধরা ও আজিমপুরে আরও তিনটি শাখা স্থাপন করা হয়। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির চাপে স্কুলটি পর্যায়ক্রমে একাধিক সেকশন ও বৈকালিক শিফট চালু করে।

১৯৯৫ সালে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমেও পাঠদান শুরু হয়। ব্যবসায় শিক্ষা শাখা ব্যতীত বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমে মানবিক ও বিজ্ঞান শাখার পাঠক্রম চালু রয়েছে।

এই স্কুলের মূল ক্যাম্পাস প্রায় ছয় একর জমির উপর বিস্তৃত। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়ার স্কুল সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে।

বর্তমানে ভিকারুন্নেসা স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা মোট ১৭,৯৮৫। এর মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ১৫,৪৫০ এবং কলেজ শিক্ষার্থী ২,৫৩৫ জন। স্কুল সেকশনে নিয়মিত শিক্ষক সংখ্যা ৩৩৫ এবং খন্ডকালীন ৯৭ জন। কলেজ সেকশনে নিয়মিত শিক্ষক সংখ্যা ৫১ এবং খন্ডকালীন ১৯ জন। এছাড়া এ প্রতিষ্ঠানে ১৫০ জন কর্মচারী রয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *