মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা

:: চৌধুরী খালেকুজ্জামান ::

Revolt of 8 East Bengal Regiment on 25 March 1971 and declaration of Independence : From the account of an eye witness.

কোন পরিস্থিতিতে জিয়া সেদিন বিদ্রোহ করলেন, তা উঠে এসেছে মেজর জিয়ার সহযোদ্ধা তৎকালীন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের লেখায়

আমি নিশ্চিত, অপারেশন সার্চলাইট নামে যে পরিকল্পনা চলছিল, তার সঙ্গে লে. কর্নেল জানজুয়া সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সবসময় আমাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছিলেন। …..ব্রিগেডিয়ার আনসারী তখন পোর্টে ছিলেন। পোর্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র খালাস করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নেয়া হচ্ছিল। আমি এবং মেজর জিয়া ২৫ মার্চ বিকালে পুরো চট্টগ্রাম শহর ঘুরে দেখে এলাম সার্বিক পরিস্থিতি কি। সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখলাম, তাতে মনে হলো আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। ….. তখন রাত ৮টারও বেশি বাজে। ট্রাকের পেছন দিক থেকে ঘুরে গিয়ে যখন আমি তাকে বিদায় জানাচ্ছিলাম তখন তিনি শুধু আমাকে বললেন, কোনো কিছু স্বচ্ছ মনে হচ্ছে না। কোনো তথ্য পেলে আমাকে তা জানাবে। সত্যি কথা বলতে কি তার এই একটি কথাই পরবর্তী সময়ে আমার জন্য বড় ধরনের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। মেজর জিয়াউর রহমান পোর্টের দিকে রওনা হলেন। তার সঙ্গে দু’জন অবাঙালি অফিসার ছিলেন। একজন লে. আজম, অন্যজন লে. হুমায়ুন। লে. হুমায়ুন ছিলেন ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমারের (ইউসুফ খান) চাচাত ভাই। লে. কর্নেল জানজুয়া তখন মেজর শওকতকে তার মেসে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তখন লাইন ডিউটিতে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। লে. শমসের মবিন ও লে. মাহফুজ দায়িত্ব পালন করছিলেন শহরে। আমি দৌড়ে ক্যাপ্টেন অলির কাছে গেলাম। বললাম সিরিয়াস কিছু একটা হচ্ছে। ক্যাপ্টেন অলিও আমার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, পরিস্থিতি তেমন একটা ভালো মনে হচ্ছে না। মেজর শওকত ততক্ষণে মেসে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ আবদুল কাদের নামে আমার এক আত্মীয় আমাকে ফোন করে বললেন, ইপিআরে গোলাগুলি শুরু হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ইপিআরকে অ্যাটাক করেছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তখন আমার মধ্যে বিদ্যুতের মতো একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। আসলে বয়স কম থাকলে যা হয় তাই। মেজর জিয়াউর রহমানের সেই কথা, কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানাবে—এটিই যেন বারবার আমার কানে বাজছিল। আমি তৎক্ষণাৎ ক্যাপ্টেন অলিকে বললাম, তুমি এখানটা দেখ, আমি আমাদের বসের কাছে গেলাম। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তিনিই নেবেন। অলিও আমাকে উৎসাহিত করল। আমি ছুটলাম। আমি তিনজন সৈন্য নিয়ে একটি পিকআপে করে ছুটলাম পোর্টের দিকে, মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আল্লাহর মেহেরবানি আমাকে পোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়নি। দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের কাছেই পেয়ে গেলাম জিয়াউর রহমানকে। ব্রিজটি ছিল ভাঙা। তাই জিয়াউর রহমান ট্রাকটি নিয়ে সেখানে থেমে ছিলেন। যেতে পারছিলেন না। ব্রিজের সামনে ব্যারিকেড ছিল। সৈন্যরা ব্যারিকেড সরানোর কাজ করছিল। আমি পিকআপ নিয়ে ঠিক ট্রাকটির পেছনে থামলাম। জিয়াউর রহমানের কাঁধে হাত রেখে তাকে একপাশে সরিয়ে নিলাম। এ সময় আমি ছিলাম অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। আমার ভেতর উত্তেজনাও কাজ করছিল। বললাম, স্যার ঢাকায় গোলাগুলি শুরু হয়েছে, ইপিআর ক্যাম্পে আর্মি আক্রমণ চালিয়েছে। বেশকিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। জিয়াউর রহমান আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম স্যার, উই আর উইথ ইউ। তিনি কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। তিনি উচ্চারন করেন. ‘উই রিভোল্ট’…। তিনি আমাকে ইউনিট লাইনে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সবকিছু অর্গানাইজ করতে বললেন। আমি কোয়ার্টার গার্ডে আমাদের যেসব সৈন্য ছিল তাদের প্রস্তুত থাকতে বললাম। একটু পরই মেজর জিয়াউর রহমান সঙ্গে লে. আজম ও লে. হুমায়ুনকে নিয়ে ফিরে এলেন। তাদের দু’জনকে কোয়ার্টার গার্ডে ঢোকানোর নির্দেশ দিলেন তিনি। আমি তাদের দু’জনের কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে কোয়ার্টার গার্ডে রাখলাম। কোয়ার্টার গার্ড আসলে বন্দিশালা। তারা কোনো প্রতিবাদ করেনি। এখানে একটি কথা বলা দরকার, মেজর জিয়াউর রহমান তখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন খুব দ্রুত। যেন ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার মতো। মেজর জিয়া আমাকে বললেন, আমাকে একটি জিপ দাও। মেজর জিয়া তিনজন সৈনিককে নিয়ে একটি জিপে করে সরাসরি গেলেন লে. কর্নেল জানজুয়ার বাসায়। মেজর জিয়াকে দেখে জানজুয়া রীতিমত অবাক। এটা কি করে সম্ভব? তাকে পাঠালাম পোর্টে আর সে এখানে কেন? জানজুয়াকে নিয়ে মেজর জিয়া ফিরে এলেন নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে। আসার পথে নিজে মেজর শওকতকে জাগিয়ে এলেন। জানজুয়া গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই মেজর জিয়া আমাকে বললেন, ধর এটাকে। তিনি একটি রাইফেল তাক করে বললেন, স্যার, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। আমাকে নির্দেশ দিলেন লে: কর্নেল জানজুয়াকে নিয়ে যেতে। আমি জানজুয়াকে কোয়ার্টার গার্ডে ঢুকিয়ে একটি চেয়ারে বসালাম। বললাম, কোনো কিছু করার চেষ্টা করবেন না। (পরে জানজুয়া সেখানে নিহত হয়)।


মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের নির্দেশ দিয়ে ওপরে গিয়ে চট্টগ্রামের ডিসি-এসপিসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আমরা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছি। আপনারা প্রস্তুত হোন। মেজর শওকত পরে সেখানে উপস্থিত হন। মেজর জিয়া শওকতের উদ্দেশে বলেন, আই হোপ ইউ উইল বি উইথ আস। মেজর শওকত তাৎক্ষণিক সম্মতি জানান। মেজর জিয়া তখন বললেন, ইট ইজ গুড ফর দ্য নেক্সট সিরিয়াস গেম। এরপর আমাদের ইউনিটের অফিসার এবং সৈন্যদের উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমান একটি বক্তৃতা করেন। বিদ্রোহের কারণসহ সবকিছু তিনি ব্যাখ্যা করেন। তিনি সবার কাছে জানতে চান, তোমরা আমার সঙ্গে আছ কিনা। এ সময় উপস্থিত সবাই স্লোগান দিয়ে তাদের সম্মতির কথা জানাল। আমরা তখন আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না। নাসিরাবাদে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। আমাদের হাতে তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না। ক্যান্টনমেন্ট থেকে মর্টার শেল করলে আমরা সবাই মারা পড়ব। তাই কালুরঘাট যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। ২৬ মার্চ ভোরে তখন ফজরের আজান হচ্ছিল, আমাদের যে অস্ত্রশস্ত্র ছিল তা নিয়ে আমরা কালুরঘাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আমাকে নির্দেশ দেয়া হলো কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে আমরা অবস্থান নেব। আমাকে পূর্বদিকে অবস্থান নিতে বলা হলো। আমার সৈন্যরা রেডিও স্টেশন পাহারা দেবে। আমার ডানদিকে সৈন্য নিয়ে থাকবে লে. মাহফুজ এবং বামদিকে থাকবে লে. শমসের। ক্যাপ্টেন অলি দায়িত্ব পালন করবেন মেজর জিয়ার স্টাফ অফিসার হিসেবে। আমরা সাড়ে ৬টার দিকে কালুরঘাট এলাকায় চলে এলাম এবং অবস্থান নিলাম।

আজ মনে পড়ছে, মেজর জিয়া সেদিন এভাবেই চলে এসেছিলেন। তিনি একবারের জন্যও বেগম জিয়ার খোঁজ করেননি। কালুরঘাট পৌঁছার পর তিনি আমাদের আবার ব্রিফ করলেন। তিনি বললেন, আমাদের বসে থাকলে চলবে না। ছোট ছোট অপারেশন অব্যাহত রাখতে হবে। এ সময় আরো কিছু বাঙালি অফিসার এবং সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। একটি কথা এখানে বলা দরকার, আমরা বিদ্রোহ করার পর মেজর জিয়াউর রহমান এ ঘটনাটি আওয়ামী লীগ নেতাদের জানানোর জন্য মেজর শওকতকে চট্টগ্রাম শহরে পাঠান। চট্টগ্রাম শহর মেজর শওকতের খুব পরিচিত ছিল। মেজর জিয়া ছিলেন প্রচণ্ড মুভমেন্টের মধ্যে। তখন তিনিই আমাদের নেতা। তিনি নির্দেশ দিচ্ছিলেন আর ছুটে যাচ্ছিলেন একস্থান থেকে অন্যস্থানে।


এতবড় ঘটনা ঘটানোর পর আমরা আসলে বুঝতে পারছিলাম না বাইরে কি হচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গলে অন্য কোথাও বিদ্রোহ হয়েছে কিনা, তাও আমরা জানি না। আমরা সারাদেশে কতটুকু সমর্থন পাচ্ছি তাও আমাদের জানা ছিল না। এজন্য মেজর জিয়া তখন সিদ্ধান্ত নিলেন এ ঘটনা দেশবাসী এবং বহির্বিশ্বকে জানাতে হবে। তিনি কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে চলে গেলেন। তিনি নিজেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। নিজের নামেই ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। প্রথমবার তিনি ইংরেজিতে নিজের তরফে বলেছেন, ‘I Major Ziaur Rahman, do hereby proclaim the Independence of Bangladesh.”


তাঁর এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের পক্ষে আন্তর্জাতিক সহায়তা চান। পরে তিনি এ ঘোষণা কিছুটা সংশোধন করে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি এখানে উল্লেখ করেন, ‘আওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিবুর রহমান ইজ উইথ আস।’ কারণ স্বাধীনতার এ ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারত। এভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হলো। মেজর জিয়া এ ঘোষণা বাংলায়ও দিয়েছিলেন। বাংলায় ছিল, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি…।’ পরবর্তী সময়ে লে. শমসের মবিন চৌধুরী মেজর জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচার করেন। মেজর জিয়াউর রহমানের এ ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি ঘুমন্ত মানুষ যেন হঠাৎ জেগে উঠল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বত্র তখন মানুষ জানতে পারল আমরা কোথায় আছি। বহির্বিশ্ব জানতে পারল বাংলাদেশ নামে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সে দেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান নামে এক সামরিক অফিসার স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। মেজর জিয়াউর রহমানের এ ঘোষণা ছিল বিরাট বিচক্ষণতার পরিচায়ক। ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দু’টি বিমান হামলা চালিয়ে বেতার কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়।

লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.), সাবেক রাষ্ট্রদূত ও মুক্তিযোদ্ধা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *