কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে

:: ফজলে এলাহী ::

গত শতাব্দীর ৮০-৯০ দশক অর্থাৎ শেষ দুই দশকে বিটিভির দর্শকদের জন্য বিনোদন হয়ে এসেছিলো জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক ও এক পর্বের নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার -এর মতো দারুণ সব জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক যেমন আমরা দেখেছিলাম ঠিক তেমনি একদিন হটাৎ, কুসুম, নিমফুল, সবাই গেছে বনে, খাদক , প্যাকেজ সংবাদ, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড, গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড -এর মতো এক পর্বের জনপ্রিয় নাটকগুলোও দেখেছিলাম । যে নাটকগুলো আজও দেখার সুযোগ পেলে কেউ মিস করতে চায় না।

হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নাটকগুলোর মধ্য হাস্যরসের মাঝে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর হাসি কান্না, সুখ দুঃখ ও নিদারুন বাস্তবতা তুলে ধরতেন। কখনও কখনও তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে আমাদের সামাজিক কিছু বার্তাও দিতেন । তবে ৯০ দশকের মাঝামাঝির দিকে হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নাটকের মাধ্যমে দারুণ একটা কাজ করেছিলেন যার প্রভাবটা বেশ সাড়া ফেলেছিলো। তা ছিলো নাটকের মধ্যে তিনি সিলেটের হাসন রাজা , শাহ আব্দুল করিমদের গানগুলোকে নতুন করে দর্শকদের মাঝে তুলে ধরতেন যার ফলে বাজারে নতুন করে হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের লিখা আঞ্চলিক ভাষার বাউল গানগুলো শ্রোতামহলে বেশ আগ্রহ তৈরি করে। সত্যি কথা বলতে শাহ আব্দুল করিম জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেভাবে সারাদেশে নতুন করে পরিচিতি লাভ করেছিলেন তাঁর পেছনে হুমায়ুন আহমেদের ”আজ রবিবার” নাটকের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ” কুসুম” নাটকে রুদ্র মো শহিদুল্লাহর ” ভালো আছি ভালো থেকো ” গানটি নাটকে শংকর সাওজালের কন্ঠে গাইয়ে গানটিকে অন্য এক জনপ্রিয়তায় নিয়ে যান যা একটা ইতিহাস হয়ে আছে।

যতদূর মনে পড়ে দর্শকপ্রিয় ”আজ রবিবার” নাটকের এক পর্বে হিমুকে নকল করা তুহিন চরিত্রটিকে দিয়ে সেলিম চৌধুরীর কণ্ঠে শাহ আব্দুল করিমের ” আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি পরিবেশনা করান । নাটকের কল্যাণে খুব সহজেই সারাদেশের মানুষের কাছে শাহ আব্দুল করিমের গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, যারা আগে শুনেছে তাঁরা যেমন গানটির প্রশংসা করেছে ঠিক তেমনি যারা আগে কখনও শুনেনি তারাও শাহ আব্দুল করিমের এই গানটির মাধ্যমে শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে নতুন করে জানার চেষ্টা করেছে। একই নাটকে বেশ কয়েকবার হাছন রাজার কয়েকটা গান পরিবেশিত হয় যে গানগুলোও সব বয়সি সব শ্রেনীর মানুষের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যায়। হুমায়ুন আহমেদের লিখা এক পর্বের ”নিমফুল” নামের নাটকটি শেষ হয় হাছন রাজার একটি বিখ্যাত গান দিয়ে (খুব সম্ভবত ”মাটির পিঞ্জিরার মাঝে ”) । এমন করে সেইসময় হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নাটকগুলোতে আঞ্চলিক এসব গান যুক্ত করে দর্শকদের কছে তা পৌঁছে দিতেন।। অর্থাৎ হুমায়ুন আহমেদ জেনেবুঝেই ভাটি বাংলার বিখ্যাত দুই কবিয়ালকে শহুরে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুধু বিটিভি নয় ,হুমায়ুন আহমেদ এই কাজটি করেছিলেন এই শতকের শুরুর দিকে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভিতে ” উড়ে যায় বকপক্ষী” নামক নাটকেও। সেই নাটকেও একাধিক বাউল গান পরিবেশিত হয়েছিলো। হুমায়ুনের ”যমুনার জল দেখতে কালো” নাটকটিতেও তিনি নেত্রকোণা অঞ্চলের আঞ্চলিক গানকেও সামনে নিয়ে আসেন। হুমায়ুন আহমেদ কোন আদর্শের ধারক ছিলেন তা হয়তো আমরা নিশ্চিত নই তবে ”বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” আদর্শের ধারক নাহলে এমন কাজ কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে হৃদয়ে ধারন করতে না পারলে সবার্থহীন ভাবে বাংলাদেশকে কেউ এভাবে তুলে ধরেনা তা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস । হুমায়ুন আহমেদের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তর্ক বিতর্ক অন্য একদিন করা যাবে , আজ থাক ।

হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নাটকগুলোর মধ্য হাস্যরসের মাঝে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর হাসি কান্না, সুখ দুঃখ ও নিদারুন বাস্তবতা তুলে ধরতেন। কখনও কখনও তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে আমাদের সামাজিক কিছু বার্তাও দিতেন । তবে ৯০ দশকের মাঝামাঝির দিকে হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নাটকের মাধ্যমে দারুণ একটা কাজ করেছিলেন যার প্রভাবটা বেশ সাড়া ফেলেছিলো। তা ছিলো নাটকের মধ্যে তিনি সিলেটের হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমদের গানগুলোকে নতুন করে দর্শকদের মাঝে তুলে ধরতেন যার ফলে বাজারে নতুন করে হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের লিখা আঞ্চলিক ভাষার বাউল গানগুলো শ্রোতামহলে বেশ আগ্রহ তৈরি করে। সত্যি কথা বলতে শাহ আব্দুল করিম জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেভাবে সারাদেশে নতুন করে পরিচিতি লাভ করেছিলেন তাঁর পেছনে হুমায়ুন আহমেদের ”আজ রবিবার” নাটকের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ” কুসুম” নাটকে রুদ্র মো শহিদুল্লাহর ” ভালো আছি ভালো থেকো ” গানটি নাটকে শংকর সাওজালের কন্ঠে গাইয়ে গানটিকে অন্য এক জনপ্রিয়তায় নিয়ে যান যা একটা ইতিহাস হয়ে আছে।

এখানে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো ৮০র দশকের শেষ ভাগে ও ৯০ দশকের শুরুতে বিটিভিতে লোকসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক মোস্তফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপনায় লোক সঙ্গীত নিয়ে ”ভরা নদীর বাঁকে” নামের একটি অনুষ্ঠান পাক্ষিক হিসেবে প্রতিমাসে দুইবার প্রচারিত হতো। সেই অনুষ্ঠানে আব্বাসি সাহেব লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকা শাহ আব্দুল করিমের মতো জীবিত ও মৃত বাউল শিল্পিদের গান ও তাদের সম্পর্কে দর্শকদের জানাতেন। ভরা নদীর বাঁকে অনুষ্ঠানটি ছিলো একটা চমৎকার উদ্যোগ যা সবার কাছে প্রশংসিত ছিলো। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানটা ব্যক্তি শাহ আব্দুল করিমকে সামনে যতোটা আনতে পেরেছিলো তার চেয়েও বেশি ”আজ রবিবার” নাটকটি শাহ আব্দুল করিমকে সর্বমহলে পৌঁছে দিয়েছিলো । হুমায়ুন আহমেদ শুধুই একজন সাধারন জনপ্রিয় লেখক হতে চাননি,তিনি চেয়েছিলেন মানবিক গুণাবলী সম্বলিত সমাজের একজন আলোকিত মানুষ যিনি আঁধারে , অবহেলায় পড়ে থাকা মানুষগুলোকে তুলে আনতেন। সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা হুমায়ুন আহমেদের মতো আর কারো মাঝে দেখিনি।

৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বিটিভির সাথে সবে মাত্র বিদেশি চ্যানেলগুলো এদেশের শহুরের শিক্ষিত সমাজ দেখতে শুরু করেছিলেন সেইসময় সিলেট অঞ্চল ব্যতীত শাহ আব্দুল করিম ও হাছন রাজার বিখ্যাত আঞ্চলিক গানগুলো সারাদেশের মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজের কাছে এতো বেশি পরিচিত ছিলো না। সঙ্গীত ভুবনের মানুষ ব্যতীত সাধারন শ্রোতারা এসব গান সম্পর্কে খুব বেশি জানতো না। শুধু তাই নয়, শাহ আব্দুল করিমের মতো একজন ব্যক্তি এখনও জীবিত আছেন সেটা ছিলো অনেকেরই অজানা। কারণ তাঁকে আমাদের সুশিল শিক্ষিত সমাজ কখনও প্রচার করতে দেখিনি বা তাঁর কথা বলতে শুনিনি। একরকম প্রচারের বাহিরেই ছিলেন শাহ আব্দুল করিমের মতো একজন অসাধারন কবিয়াল যিনি হতে পারতেন বাংলাদেশের গর্ব। সেই প্রচারবিমুখতা থেকেই হুয়ামুন আহমেদের নাটকের কল্য্যানেই চারিদিকে সাড়া পড়ে যায় আব্দুল করিমকে নিয়ে। সেলিম চৌধুরী, দিলরুবা খান সহ অনেক শিল্পির অডিও অ্যালবাম প্রকাশ পেতে শুরু করে শুধুমাত্র আব্দুল করিমের গান নিয়ে। বলতে এমন এক সময় আব্দুল করিম প্রচারে এলেন যখন তাঁর আর এসব প্রয়োজন ছিলো না। কারণ সারাটাজীবন দারিদ্র্যর সাথে লড়াই করে যাওয়া ৮০ বছর বয়সের উর্ধে বৃদ্ধ আব্দুল করিম তখন অসুস্থ থাকতেন নিয়মিত। দারিদ্র্য সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় বহু আগে হারিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে সরলাকে যার দুঃখ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আব্দুল করিম ভুলতে পারেননি।

অনেক শিল্পী রেডিও টেলিভিশন ও অডিও অ্যালবামে আব্দুল করিমের গান গেয়েছেন কিন্তু কেউই সেই গানের স্রষ্টা আব্দুল করিমকে তাঁর প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দেননি যার ফলে আব্দুল করিমের গান গেয়ে অন্যরা হয়েছিলেন ধনী আর আব্দুল করিম রয়ে গেলেন চিরকাল গরীব হয়ে। আমরা কতটুকু অকৃতজ্ঞ জাতি সেটা হুমায়ুন আহমেদ আমাদের জানিয়ে দিলেন। শাহ আব্দুল করিমের মতো ব্যক্তিকে কখনও দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে হতো না যদি এই রাস্ট্র, এই সুশীল সমাজ , স্বার্থপর শিল্পী ও অসাধু ব্যবসায়ী সমাজ শাহ আব্দুল করিমকে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিতেন । আমাদের শিল্পী , সুশীল ও ব্যবসায়ী সমাজের এক অজানা নির্মম রূপটা প্রকাশ পেয়ে গেলো হুমায়ুন আহমেদের নাটকের কারণে। শাহ আব্দুল করিম তার জীবনের শেষ যে কয়টি বছর সারাদেশের ও বিদেশের মানুষের কাছে সম্মানিত হয়েছিলেন তার পেছনে হুমায়ুন আহমেদের অবদান অনেক যা কখনও কাউকে বলতে শুনিনি। আমরা সবাই শুধু হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়েই বলি কিন্তু এর বাহিরেও যে তিনি ছিলেন অনন্য এক মানুষ তা কেউ বলিনা। ৭৫তম জন্মবার্ষিকীতে কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *