অভিমানী হ্যাপি আখন্দ স্মরণে

:: ফজলে এলাহী ::

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পপসম্রাট গুরু আজম খান যখন তাঁর চার বন্ধুদের (ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাই ও ফেরদৌস ওয়াহিদ) নিয়ে বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। সেই নতুন ধারার শুরুর দিকে ১৫ বছর বয়সের এক গানপাগল কিশোর হাতের গীটারে ঝড় তুললেন আর নিজের কণ্ঠের গান দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে দিলেন। তখন ছেলেটিকে সেই সময়ের সিনিয়র সকলে আশীর্বাদ করলেন যে ‘এই ছেলেটি একদিন অনেক বড় হবে’। ছেলেটি বড় হওয়া শুরু করতেই হঠাৎ একদিন সবাইকে কাদিয়ে দিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিদায় নিলেন যা ছিল আমাদের সঙ্গীতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। আপনারা কেউ কি বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি? হ্যাঁ। আমাদের বাংলা পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা, কিংবদন্তী প্রয়াত হ্যাপি আখন্দ এর কথা বলছি।

১৯৬০ সালের ১২ই অক্টোবর জন্মগ্রহন করা হ্যাপি আখন্দ যার বড় ভাই আমাদের সঙ্গীতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রিয় লাকী আখন্দ। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল হ্যাপির প্রচণ্ড আগ্রহ। বড় ভাই লাকী যখন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে গীটার বাজিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করতো তখন কিশোর হ্যাপি চুপচাপ তাঁদের পাশে বসে তা মনযোগ দিয়ে দেখতো। কখনও কখনও লুকিয়ে ভাইয়ের গীটার নিয়ে নিজে ‘টুং টাং’ করে সুর তুলার চেষ্টা করতো। ছোট ভাইয়ের এই আগ্রহ দেখে বড় ভাই তাঁর সাথে হ্যাপিকে রাখতো এবং বড় ভাই ভাই লাকীর কাছ থেকে গীটারটাও শিখে ফেললো। ব্যস, শুরু হয়ে গেলো দুই ভাইয়ের সঙ্গীত জীবনে একসাথে পথচলা। হ্যাপি যতনা নিজে গাইতো তাঁর চেয়ে বেশী অন্যকে দিয়ে গাওয়াতো, অন্যর গানের সুর তুলতে সাহায্য করতো এবং অন্যদের তুলে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতো অর্থাৎ হ্যাপি নিজেকে সবসময় নিজে অবহেলা করতো। হ্যাপি ছিল একজন কণ্ঠশিল্পী,সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, একজন গিটারিস্ট এবং ব্যান্ডের একজন নিয়মিত সদস্য। এমন অনেক জনপ্রিয় গান আছে যেখানে সরাসরি হ্যাপি সঙ্গীত পরিচালনায় যুক্ত ছিল যেমন ফেরদৌস ওয়াহিদ এর ‘এমন একটা মা দে না’ কুমার বিশ্বজিৎ এর ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’ এর অন্যতম। ১৯৭৫ সালে দুর্গাপুর এক কনসার্টে অতিথি শিল্পী হিসেবে হ্যাপি সাতটি গান পরিবেশনা করে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। যে কনসার্টের প্রধান শিল্পীরা ছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার,কণ্ঠশিল্পী আর ডি বর্মণ এবং আরেক কিংবদন্তী আশা ভোঁসলে। সেই কনসার্টে হ্যাপি নিজের কণ্ঠের গানের সাথে হ্যাপি ও লাকী দুজনেই গীটার পরিবেশনা করেন।

হ্যাপির কিশোর বেলার অমর সৃষ্টি ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি তো আমাদের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একটি ইতিহাস হয়ে আছে। যে গানটি পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’(রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মোস্তফা) ছবিতে ব্যবহৃত হয়। হ্যাপির এই গানটি সম্পর্কে কিছু তথ্য না দিয়ে লোভ সামলাতে পারলাম না । ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটির গীতিকার এস এম হেদায়েত ও লাকী আখন্দ ১৯৭৫ সালের দিকে নওগাঁর জমিদার মামুনলাল চৌধুরীর বাড়ীতে যান মামুনলাল এর নিমন্ত্রণে। সেখানে যাওয়ার পর সারাদিন ঘরবন্দী থাকার পর জমিদার মামুনলাল কে বলে রিক্সায় ঘুরতে বের হোন। রিক্সা দিয়ে যাওয়ার সময় পথের দুধারে ধান ক্ষেত দেখতে পেলেন। যে ধান ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তা আর সেই রাস্তায় দুজনে রিক্সা করে যাচ্ছেন। এই অপরূপ দৃশ্য দেখে লাকী বন্ধু হেদায়েত কে একটি গান লিখতে অনুরোধ করে। হেদায়েত প্রথমে চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর লাকী কে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দুজনে’ লাইন দুটো শুনায়। লাইন দুটো শুনে লাকী শুরুতে তেমন পাত্তা দিলো না। এর কিছুক্ষণ পর ‘চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে মিশে গেছে’ লাইন দুটো শুনালে লাকীর মনে ধরে যায়। সেদিনই গানটি লিখে ফেলেন এস এম হেদায়েত।

নওগাঁ থেকে ঢাকায় ফিরে গানটির সুর করার কাজে বসে যান হেদায়েত ও লাকী। রক এন্ড রোল এর উপর গানটির সুর তৈরি করে ফেলেন লাকী। গানটি তৈরি করার সময় ছোট ভাই হ্যাপি পাশে ছিল। সে গানটি তুলে নেয় নিজের কণ্ঠে। লাকী ও হেদায়েত এর পছন্দ হয়ে যায়। ঠিক করেন গানটি হ্যাপিকে দিয়েই গাওয়াবেন।

তারপর কিছুদিন পর হঠাৎ করে হ্যাপি বাংলাদেশ টেলিভিশন এর নওয়াজিশ আলী খান একটি অনুষ্ঠানের জন্য তিনটি গান দরকার পড়লে লাকিকে না জানিয়েই পুরনো দুটি গান ( কে বাঁশি বাজায়রে ও এই পৃথিবীতে আসে যারা) এর সাথে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি রেকর্ড করিয়ে নেন। রেকর্ড করার সময় হ্যাপি রিদম প্যাটার্ন বদলে ফেলেন হ্যাপি। রেকর্ড করানোর পর লাকীকে জানিয়ে দেন ‘ভাইয়া টেলিভিশন এর অনুষ্ঠানের জন্য তিনটি গান দরকার হওয়ায় তোমার নতুন সুরের গানটাও দিয়ে দিয়েছিলাম’। এরপর রেকর্ড করা গানটি শুনেন লাকী। শুনেই মুগ্ধ হয়ে যান। না জানিয়ে রেকর্ড করা ও রিদম প্যাটার্ন বদলানোর রাগ ,অভিমান সব মুছে ফেলেন খুশীতে । পরবর্তীতে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির ‘ঘুড্ডি’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করা হয়। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। বাংলা ব্যান্ড ও পপ সঙ্গীতের সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় গানগুলোর তালিকায় স্থান পায় ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি ।

এছাড়াও হ্যাপির অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মাঝে ছিল ‘কে বাঁশি বাজায়রে’, ‘নীল নীল শাড়ি’, ‘কে ঐ যায়রে’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান তো লিখেছি’, ‘তুমি কি দেখেছো পাহাড়ি ঝর্না’,’ ‘পলাতক সময়ের হাত ধরে’, ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা’ এর মতো অসাধারন সব গান। বিশেষ করে ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা’ গানটি ছিল হ্যাপির নিজের ভেতর লুকানো এক কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। ১৯৮৭ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে অনেক অভিমান নিয়ে এই ক্ষণজন্মা সঙ্গীত প্রতিভা ও কিংবদন্তী চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

আজো সন্ধ্যা আসে, সন্ধ্যা ফিরে যায় কিন্তু আমাদের প্রিয় হ্যাপি ফিরে আসেনা ও আসবেও না কোনদিন । হ্যাপি বেঁচে থাকবেন চিরদিন তাঁর সৃষ্টিগুলোতে ।

হ্যাপির উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টি

কে বাঁশী বাজায় রে – https://app.box.com/s/a677d085e2e9ef0cbea4

নীল নীল শাড়ী পরে – https://app.box.com/s/381e0a20cc8a563b89fb

কে ঐ যায়রে – https://app.box.com/s/61adc598a36e782629a1

স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে – https://app.box.com/s/4c3749c693776154a6c0

তুমি কি দেখেছো পাহাড়ি ঝর্ণা – https://app.box.com/s/e14036b900ec3c9d9fc8

সম্পর্কিত লেখা:

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *