অর্পার চোখে জল

:: মোহাম্মাদ আমিনুল ::

অর্পার আজকে দ্বিতীয় বিয়ে। তার মা কিছুক্ষণ পর পর তাকে তাড়া দিচ্ছে তৈরি হওয়ার জন্য। কিন্তু তার ইচ্ছে করছে না। একবার ভেবেছিলো মা-কে বলবে  আমি এই বিয়ে করবো না।

অর্পা জানে এই কথা বললে বাসায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে। তার ভাই, ভাবী অনেকদিন ধরে তাকে বলছে বিয়ে করার জন্য।

তুমি কতদিন একা থাকবে? এইভাবে কি জীবন চলে নাকি? আমানের কি হবে? ওর ভবিষ্যতের কি হবে?

আমান অর্পার ছেলে। সাত বছর বয়স। ছেলেটা ভীষণ চুপচাপ। হয়তো এই বয়সেই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা আচ করতে পেরেছে। তাই আরো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ছেলের বয়স যখন তিন বছর অর্পার স্বামী হার্ট এটাকে মারা যায়। সুমন ছেলেকে অনেক ভালবাসতো। ছেলেকে আদর করে ডাকতো বাবু সোনা, চাঁদের কণা। বাবার বুকে আয়।

তিন বছর বয়স পর্যন্ত বাবার আদর পেয়েছে আমান। এখন মাঝে মধ্যে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। মা-কে জিজ্ঞেস করে মা বাবা কবে আসবে?

অর্পা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটা বাবার আদর ছাড়া বড় হচ্ছে। এই জীবনে তার আর বাবার আদর পাওয়া হবে না। ভাই, ভাবী প্রথমদিকে আদর করতো। তাদের ছেলে হওয়ার পর এখন সেই আদর আর নেই। বরং আমান যদি ভাইয়ের ছেলের খেলনাতে হাত দেয়, ভাবী খুব বিরক্ত হয়। অর্পাকে বলে একটু ছেলেটাকে দেখে রাখতে পারো না। আমার ছেলের খেলনা ধরে। আমার ছেলেটা কান্নাকাটি করে।

অর্পা ছেলেকে খুব শাসন করে। ছেলেটা আরো চুপ হয়ে যায়। আড়ালে গিয়ে অর্পা কান্না করে।

তার মা সব বুঝে। কিন্তু ছেলের ঘরে আশ্রিত মা কিছুই বলতে পারে না। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে  মা ধৈর্য ধর। স্রষ্টা নিশ্চয় একসময় মুখ তুলে তাকাবে।

তার খুব ইচ্ছে করে নিজে কিছু করতে। কিন্তু কেউই তাকে কিছু করতে দিবে না। সমাধান একটাই তুমি বিয়ে করো। তার মামা একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। ছেলে ভালো ব্যবসা করে। বিয়ের কয়েকদিন পর বউ ভেগে গিয়েছে। এরপর থেকে ছেলে একা। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আর কখনো বিয়ে করবে না। কিন্তু পরিবারের চাপে এইবার বিয়েতে রাজি হয়েছে।

মা আমরা চিন্তা করি আমার মেয়ের যদি কখনো বিয়ে হয় সেই পরিবার কি আমার নাতিকে মেনে নিবে? আমার নাতিতো মা ছাড়া থাকতে পারে না। তাহলে তোমার সন্তান কিভাবে তোমাকে ছাড়া থাকবে? তুমি যেমন আমার ছেলের বউ। তোমার সন্তান আমার নাতি। এই পরিবার যতটুকু আমার ততটুকু তোমার ততটুকু আমার নাতিরও। অর্পার চোখে জল। এই জল দুঃখের না। এই জল সুখের।

অর্পার মা, ভাই, ভাবী একবাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছে। তাদের একটাই কথা আজকালকার ছেলেরা এক বিয়ের পর আর বিয়ে করতে চায় না। সেই ক্ষেত্রে এই ছেলেতো সোনায় সোহাগা। টাকা পয়সা আছে, ভালো পরিবার। পরিবারে ছেলের মা আছে, বোন আছে। বোনটা ডিভোর্সি। তার একটা ছেলে আছে। আর কোন ঝামেলা নেই।

অর্পার মনে হচ্ছে পুরোটাই ঝামেলা। সে বিয়ে করে কি করবে? তার সবকিছুই তার ছেলেকে নিয়ে। ছেলে রাতে তাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। অনেক রাতে ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। যাকে বিয়ে করবে সে যদি তার ছেলেকে মেনে না নেয়? ওই পরিবারে এখনি কত মানুষ। ছেলের মা, বোন, বোনের ছেলে সবাই। ছেলে যদি একা হতো তবে হয়তো তাকে বুঝিয়ে সুঝায়ে আমানকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারতো। সারাদিন ছেলেকে সময় দিতে পারতো। ছেলেকে একা ঘুমানোর অভ্যাস করাতে পারতো। অর্পা প্রতিবাদ করে আমানতো আমাকে ছেড়ে ঘুমাতে পারে না। ও আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে?

তার ভাই বলে।

আরে পাগল নাকি। আগে তুই বিয়ে করে সেই বাড়ি যা কয়েকদিন পর আমানও যাবে। আর সারাজীবন কি ছেলে মায়ের কাছে ঘুমাবে নাকি? তার নিজে নিজে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে না?

ছেলে পক্ষ তার ছবি দেখে পছন্দ করেছে। ছেলের মামা এসেছিলো তাকে দেখতে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে ছেলেরা এইবার ঘটা করে দেখতে আসবে না। তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা খারাপ হওয়াতে তারা পুরো ব্যাপারটাই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে।

অর্পা একবার চেয়েছিলো বলতে মামা আমার ছেলে আছে। তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। কিন্তু এতজনের মাঝে সে কিছুই বলতে পারেনি। পাড়া প্রতিবেশীর কত ধরনের ফিসফাস।

এই ছেলে ভালো হবে না। যার বউ বিয়ের কয়েকদিন পর ভেগে গিয়েছে তার নিশ্চয় কোন সমস্যা আছে। শুধু কি তাই। তার বোনও ডিভোর্সি। এই পরিবার খারাপ পরিবার। অর্পারও তাই মনে হচ্ছে। এ কেমন পরিবার। মেয়ে দেখবে না। ছবি দেখেই বিয়েতে রাজি।

কিন্তু তার মা, ভাই, ভাবী এগুলো কিছুই শুনবে না। তারা যেন তাকে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। ভারমুক্ত হয়। এরপর হয়তো তার ছেলেকে কোন হোস্টেলে পাঠিয়ে দিবে। একেবারে ঝামেলা শেষ। তার ভীষণ কান্না পায়। স্রষ্টা তার ভাগ্যে এত দুঃখ কেন রেখেছে। তার ছেলের ভাগ্য কেন এত খারাপ। জীবনে কখনো আদর, ভালোবাসা কিছুই পেলো না।

ছেলেটা সকাল থেকে ঘুরঘুর করছে। তাকে বলছে মা তুমি আজকে কোথায় যাবে? আমাকে নিবে না? আমি রাতের বেলা ভয় পেলে কাকে জড়িয়ে ধরবো? আমাকে কে খাইয়ে দিবে? আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও মা। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

অর্পা বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে কান্না করে। ভাইয়ের বাসায় আশ্রিতা সে। তার কিছুই করার নেই মন শক্ত করা ছাড়া।

সে রেডি হয়। ছেলে পক্ষ থেকে বেশী লোকজন আসেনি। ছেলের মা এবং বোনকে অর্পাকে দেখে জড়িয়ে ধরে। বাহ মেয়ে আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ভারী মিষ্টি মেয়ে।

অর্পা এই প্রথম ছেলেকে দেখেছে। প্রফেসর টাইপ চেহারা। একটু আলাভোলা মনে হচ্ছে। অর্পার দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকায়নি। তারপর থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্পা আশেপাশে তাকায়। আমানকে দূরে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আহা ছেলেটা কি খেয়েছে? তাকে ভাবী এসে কিছুক্ষণ পর পর অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। সে যেতে চাচ্ছে না। জোর করে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। অর্পা দূরে বসেও ছেলের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। বলছে আমি আম্মুর সঙ্গে যাবো।

অর্পার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পাশ থেকে তার মা বলছে দেখ বিয়ের মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। কাল পরশু ছেলেকে পাঠিয়ে দিবো যদি ওদেরকে রাজি করানো যায়। কয়েকবার কেঁদে সব ভুলে যাবে। দরকার হলে আজকে ওকে খেলনা দিয়ে খেলতে দিবো।

ছেলের মা, বোন তাড়াহুড়া করছে। তাড়াতাড়ি করেন আমরা নতুন বউকে নিয়ে যাবো। তারা বিদায় নিয়ে আগেভাগে বাসায় চলে গিয়েছে। এইবার অর্পার বিদায়ের পালা। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। কারো জন্য তার খারাপ লাগছে না। এই বাসা, মা, ভাই, ভাবী, ভাতিজা কারো জন্য না। শুধুমাত্র নিজের সন্তানের জন্য তার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিভাবে সে পারবে তার আদরের ধনকে রেখে যেতে। কেউ হয়তো আমানকে আড়ালে নিয়ে গিয়েছে। অর্পা চারপাশে তাকিয়ে কোথাও আমানকে দেখতে পেলো না। তার মা পাশ থেকে বলছে মা কোন সিন তৈরি করিস না। এরা জানে তোর ছেলে আছে। কিন্তু এই ব্যাপারে এরা কিছু বলে নাই। ভালোয় ভালোয় আজকের দিন যাক। দুই একদিন পর এদেরকে বুঝিয়ে বলা যাবে।

অর্পা গাড়িতে উঠে হাউ মাউ করে কাঁদছে। পাশের প্রফেসর চেহারার জামাইয়ের কোন বিকার নেই। ভাবখানা এমন এমনতো হওয়ারই কথা। তার মা ছেলের হাত ধরে বলেছে বাবা আমার মেয়েটাকে দেখে রাইখো। কখনো কষ্ট দিও না।

ছেলে মাথা নেড়ে বলেছে জী জী।

তার একবার বলতে ইচ্ছে করেছিলো।

প্লিজ, আমি কি আমার ছেলেকে নিজের সঙ্গে নিতে পারি। কিন্তু মুখ দিয়ে তার কথা বের হচ্ছে না। গাড়ি চলছে। অর্পা পেছনে ঘুরে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও আমানকে দেখা যাচ্ছে না। ছেলে নিশ্চয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশে মেহেদি মোবাইলে গেম খেলায় মগ্ন। মেহেদি তার নতুন জামাইয়ের নাম।

ছেলেদের বাড়ি বেশি দূরে না। আধাঘণ্টার মধ্যেই তাদের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। ঘড়িতে রাত এগারোটা। আহা আমানের ঘুমের সময়। আজকে নিশ্চয় সে ঘুমাবে না, খাবে না। নতুবা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বে।

অর্পাকে সুন্দর করে ছেলের মা এবং বোন বরণ করে নিয়েছে। তাকে শরবত খেতে দিয়েছে, মিষ্টি খেতে দিয়েছে। তারপর তাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসিয়েছে।

হটাত ছেলের মা বলে উঠলো মা তোমার ছেলে কোথায়?

অর্পা চমকে উঠেছে। সে ভেবেছিলো এরা হয়তো কেউ এই বিষয়ে কথাই বলবে না। তার যে ছেলে আছে এরা সেটা তাকেই ভুলিয়ে দিবে। শাশুড়ির এই প্রশ্নে অর্পা নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি।

মা আমার ছেলেটাকে আমি ফেলে এসেছি। ও কোন রাতে আমাকে ছাড়া ঘুমায় না। আমাকে ছাড়া খায় না। মা আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে ছেলের জন্য। অর্পা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

আহা ছেলেকে আনোনি কেন? আমি এবং আমার মেয়ে তোমার এবং তোমার ছেলের জন্য কত খেলনা কিনে এনেছি। ওর জন্য রুম সাজিয়ে রেখেছি। ওতো এই পরিবারের অংশ। ও আমার নাতি। কালকে সকাল সকাল গিয়ে নিয়ে এসো। ও এবং আমার মেয়ের ঘরের নাতি দুইজন হবে বেষ্ট ফ্রেন্ড। সবসময় একসঙ্গে খেলবে। দুইজনের জন্য খেলনা কিনে নিয়ে এসেছি।

এই প্রথম প্রফেসর সাহেব মুখ খুললেন

আহা আম্মা তুমি শুনো নাই। ছেলে উনাকে ছাড়া ঘুমাতে পারেনা।

তাহলে কি করবি?

আমি এখনি গিয়ে নিয়ে আসছি।

অর্পা মুগ্ধ হয়ে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে আজ এত পানি কেন?

যা বাবা নিয়ে আয়।

রাত ১ টা।

অর্পা মুগ্ধ হয়ে মেহেদী এবং আমানকে দেখেছে। তাদের সঙ্গে ননদের ছেলেও আছে। তিনজন বেডরুমের টিভিতে গেম খেলছে।

শাশুড়ি তাড়া দিচ্ছে। এই তোদের না আজ বাসর রাত। তোরা গল্প কর।

বাদ দাওতো আম্মা। আমরা তিনজন গেইম খেলছি। খুব মজা লাগছে। অর্পা তুমিও আমাদের সঙ্গে খেলতে পারো।

মেহেদি আমানকে জিজ্ঞেস করছে  কি বাবা মজা লাগছে?

আমান লাজুক হাসি দিয়ে বলছে

হুম। অনেক মজা লাগছে।

অর্পা চোখ দিয়ে জল পড়ছে। পৃথিবীতে এমন পরিবার এখনো আছে? এটা কি স্বপ্ন না সে সত্যি দেখছে?

শাশুড়ি তার দিকে তাকিয়ে বলছে

মা আমরা চিন্তা করি আমার মেয়ের যদি কখনো বিয়ে হয় সেই পরিবার কি আমার নাতিকে মেনে নিবে? আমার নাতিতো মা ছাড়া থাকতে পারে না। তাহলে তোমার সন্তান কিভাবে তোমাকে ছাড়া থাকবে? তুমি যেমন আমার ছেলের বউ। তোমার সন্তান আমার নাতি। এই পরিবার যতটুকু আমার ততটুকু তোমার ততটুকু আমার নাতিরও।

অর্পার চোখে জল। এই জল দুঃখের না। এই জল সুখের।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *