মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাই

:: ফজলে এলাহী ::

মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত আজিজ মোহাম্মদ ভাই ৮০-৯০-এর দশক থেকে চলচ্চিত্রের সাথে নেপথ্য জড়িত। আজিজ ভাইয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আসেন ভারতের মমতা কুলকার্নি, জয়াপ্রদা, আয়েশা জুলকা, ঋতুপর্না’র মতো অনেক সুন্দরীরা । সেই সময় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দাপট ছিল দুর্দান্ত। চলচ্চিত্রের নেপথ্য গডফাদার হিসেবে কাজ করতেন এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই। প্রায় সময় তিনি পত্রিকার শিরোনাম হতেন ভারতীয় সুন্দরী নায়িকাদের এদেশে এনে। বাংলাদেশের মডেলিং ও চলচ্চিত্রসহ মিডিয়া জগত নীরবে নিয়ন্ত্রণ করতেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই।

এরশাদ সরকারের আমলে দুর্দান্ত প্রতাপশালী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দেয়া এক পার্টিতে পরিচয় হয় তৎকালীন নারী সংসদ সদস্য নীলা চৌধুরী’র [ সালমান শাহর মা] সাথে। এরপর নীলা চৌধুরীকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নীলা চৌধুরীর স্বামী মরহুম কমর উদিন দায়রা জজ হিসেবে খুবই সৎ ও নির্লোভ মানুষ হিসেবে পরিচিতজনদের কাছে খুবই সম্মানিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে আলোচিত হয়ে পত্রিকায় একাধিকবার নাম আসে নীলা চৌধুরীর। এরশাদের আরেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জিনাতের সাথে নীলা চৌধুরীর দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও সবকিছু সহজে মিটমাট করে ফেলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সহায়তায়। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে প্রতি সপ্তাহে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দেয়া পার্টিতে নিয়মিত অতিথি  ছিলেন এরশাদ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা। শুরু হয় নীলা চৌধুরীর উশৃঙ্খল জীবনযাপন। এরশাদ সরকারের পতনের পর এরশাদ জেলে গেলে সংবাদ মাধ্যম থেকে কয়েক বছরের জন্য হারিয়ে যান নীলা চৌধুরী। গোপনে সেই সময় বিএনপি সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সাথেও সখ্যতা গড়ে তুলে নিরাপদে থাকেন নীলা চৌধুরী। যার পেছনে সহয়তা করেছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই ।

এরই মধ্যে ১৯৯৩ সালে সুপারহিট কেয়ামত থেকে কেয়ামত চলচ্চিত্রে নীলা চৌধুরীর বড় পুত্র সালমান শাহ অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। শুরু থেকেই ছেলের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করেন নীলা চৌধুরী। নীলা চৌধুরী ও মৌসুমী মায়ের দ্বন্দ্বের কারণে অল্প দিনেই ভেঙ্গে যায় জনপ্রিয় সালমান – মৌসুমী জুটি। নীলা চৌধুরী ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের আরেক ঘনিষ্ঠজন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী লুসির মেয়ে সামিরার সাথে বিয়ে দেন সালমান শাহকে। শাশুড়ি ও পুত্রবধু’র নিয়মিত যাতায়াত চলতে থাকে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পার্টিতে যা নিয়ে সালমানের সাথে মা নীলা চৌধুরী ও স্ত্রী সামিরার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সামিরা সালমানকে শাবনুরের সাথে গোপন সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করতে থাকায় সেই দ্বন্দ্ব আরও চরমে উঠে। সামিরা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন ও সন্দেহের দাবানলে সালমান শাহ নীরবে জ্বলতে থাকেন যার শেষ পরিনতি হয় হয় সালমান শাহ’র মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যা ছিল সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ।

ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও মাফিয়া ডন হিসেবে খ্যাত আজিজ মোহাম্মদ ভাই হলেন অলিম্পিক গ্রুপ ও এমবি ফার্মার মালিক। আজিজ মোহাম্মদের পরিবারের আদি নিবাস ভারতের গুজরাটে। দেশভাগের পর বাবা মোহাম্মদ ভাই ব্যবসার জন্য ঢাকার আরমানিটোলায় থেকে যান এবং সেখানেই আজিজ মোহাম্মদের জন্ম। নামের শেষে ‘ভাই’ উপাধিটার কারণে অনেকেই তাঁকে মাফিয়া ডন হিসেবে চেনে। মূলত উপাধিটা তাঁর পারিবারিক ভাবেই পাওয়া। তবে তিনি আসলেই মাফিয়া ডন। অস্ত্র, মাদক ও সোনা চোরাচালানের সাথে যুক্ত তিনি। কারাগারে থাকা ইয়াবা সম্রাট আমিন হুদা হলেন আজিজ মোহাম্মদেরই ভাতিজা। আজিজ মোহাম্মদের বাংলাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দুবাই, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর , থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে তাঁর রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট। ৮০ এর দশকের প্রথম দিকে ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি মর্নিং সানের সম্পাদকের মেয়ে নওরিনকে জোর করে বিয়ে করে প্রথম আলোচনায় আসেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এরপর জড়িত হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের সাথে। প্রায় ৫০ টির মতো চলচ্চিত্রের পেছনে অর্থ লগ্নি করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই । তবে চলচ্চিত্রের প্রযোজনা যতটা না তাঁর চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা তাঁর চেয়েও বেশী ছিল কালো টাকাকে সাদা করা ও ফুর্তি করার জন্য।

এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে এরশাদের প্রেমিকা মেরীকে নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ এরশাদের সাথেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হোন। মেরি নিয়ে বিবাদ শুরু হলেও পরবর্তীতে আরও কয়েকজন নারী নিয়ে এরশাদ ও আজিজ মোহাম্মদের টানাটানি চলতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো এরশাদকে শিক্ষা দেয়ার জন্য ১৯৮৫ সালের একদিনের জন্য তৎকালীন সময়ের বোম্বের হট নায়িকা রেখাকে আজিজ মোহাম্মদ ঢাকায় নিয়ে আসেন। রেখা’কে আজিজ মোহাম্মদ ভাই উড়িয়ে নিয়ে আসলেও তাঁর সাথে কে রাত কাটাবেন- তা নিয়ে হাতাহাতির মত ঘটনা ঘটে যায়। এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ভিন্ন একটি গাড়ি নিয়ে রাতে হোটেল সোনারগাঁওয়ে ঢুকে পড়লেই ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। তবুও ভিতরে ভিতরে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে এরশাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। আজিজ মোহাম্মদের নৈশ পার্টিতে নিয়মিতই এরশাদ ও তাঁর অনেক প্রেমিকাকে পাওয়া যেতো যাদের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদেরও সম্পর্ক গড়ে উঠে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নাটক ও মডেলিং জগতের সকল সুন্দরী নায়িকাদের আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের কাছে যাওয়া আসা ছিল নিয়মে পরিণত হয়।

আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে পরবর্তীতে সালমানের স্ত্রী ও শাশুড়ির সম্পর্ক গড়ে উঠে। সোনারগাঁওয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের এক পার্টিতে সামিরার ব্যাগে অনেক টাকা সালমান হাতেনাতে পেয়ে যায়। সেই পার্টিতে সামিরাকে চুমু দিতে চাইলে সালমান আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে চড় মেরেছিলেন। এছাড়া সামিরার অবাধ যৌনাচার ও পরকীয়ার ফলে সালমানের সাথে সামিরার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারন করে। মৃত্যুর আগের দিন সালমান সামিরাকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন যা আর দেয়া হয়নি, সামিরা ও আজিজ মোহাম্মদ গংদের হাতে সেই রাতেই সালমানের মৃত্যু হয়।

সালমান শাহ হত্যার পরেও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম আসে ১৯৯৮ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যায়। সোহেল চৌধুরীর সাথে গুলশানের ট্র্যামস ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলামের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ট্র্যামস ক্লাব দখল ও স্যাটেলাইট ব্যবসা নিয়ে। ট্র্যামস ক্লাব ছিল সোহেল চৌধুরীর বাসা থেকে ২৫ /৩০ গজ দূরে। সোহেল চৌধুরী নিজেও ব্যক্তিজীবনে ছিলেন উশৃঙ্খল।  সেই সুবাদে ট্র্যামস ক্লাবে নৈশ পার্টিতে নিয়মিত ছিল যাতায়াত। মৃত্যুর আগের দিন মদ্যপ অবস্থায় স্যাটেলাইট ব্যবসার অংশীদারত্ব নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। সোহেল চৌধুরীকে হত্যার জন্য মোটা অংকের টাকায় ভাড়া করেন লেদার লিটন, কিলার আব্বাস, ইমনসহ ঢাকা শহরের শীর্ষ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের দলনেতাদের। গোয়েন্দাদের মতে, কোন হত্যাকাণ্ডে একসাথে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের টপ টেররদের মিলিত অপারেশন ছিল বাংলাদেশে সেটাই প্রথম এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল। রাত ২ টার দিকে সোহেল চৌধুরী ও তাঁর বন্ধুরা ট্র্যামস ক্লাবে প্রবেশ করতে গেলে ট্রামস ক্লাবের এক কর্মচারী বাঁধা দিলে সেখানে তর্কাতর্কি শুরু হয় এবং সন্ত্রাসীরা এলোপাথাড়ি গুলি করে আতংক সৃষ্টি করে।  এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা খুব কাছ থেকেই সোহেল চৌধুরীর পেটে কয়েকটি গুলি করে পালিয়ে যায়, গুলিতে সোহেল চৌধুরী নিহত হোন। ২০০৪ সালে সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলাটা স্থগিত হয়ে যায়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই , বান্টি ইসলাম,বোতল চৌধুরী [আশিস রায়] , তারিক সাইদ মামুন, আদনান সিদ্দিকী, ফারুক আব্বাসী, সানজিদুল হাসান ওরফে ইমন, মো. সেলিম খান ও হারুনুর রশীদ লিটন ওরফে লেদার লিটন সবাই রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। পরবর্তীতে লেদার লিটন দেশের বাহিরে কিলার আব্বাস, ইমন বর্তমানে কারাগারে আছে।

উল্লেখিত আলোচিত সকল ঘটনার হোতা আজিজ মোহাম্মদ এখনও থাইল্যান্ডে বসবাস করছেন। মাঝে মধ্যে দেশে আসলেও থাইল্যান্ড থেকেই সকল ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের অনেকেই এখনও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন এবং থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের অনেক সুন্দরীরা এখনও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে থাকেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *