আদর্শের প্রকাশক মাহাবুব রহমানের কাছে প্রশ্ন

:: আবু বকর সিদ্দিক রাজু ::

পুরো বিষয়ে যেসব ব্যাপার দেখলাম, শুনলাম (নিউজ, রিপোর্ট, আপনার সাক্ষাৎকার এবং স্ট্যাটাস) তাতে আমার ভেতরে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। আমি কোনো ডিপ্লোমেসির ধার না ধরে বিনা প্রস্তুতিতে একটা লাইভ করেছি। বারবার স্ক্রিনে আপনার স্ট্যাটাস দেখে দেখে বলতে গিয়ে ব্যাপারটা ঠিক দর্শনীয়ও হয়নি। তাছাড়া মনে হচ্ছে লাইভে প্রশ্নগুলো যথেষ্ট অগোছালো। তাই এখানে জিজ্ঞাসা করছি।

আপনি বলেছেন- সময় প্রকাশনের সেলসম্যান থেকে আজ প্রকাশনা জগতের মাফিয়া।

আমার প্রশ্ন – ভাই, সেলসম্যান থেকে প্রকাশক এটা খুব পারসোনাল এটাক হয়ে গেল না? আপনার থেকে বেটার আশা করি। মোদি টি বয় থেকে পিএম হলে ঠিক আছে, সেলসম্যান থেকে কেউ প্রকাশক হলে ঠিক নেই, একজন বেস্ট সেলার সেল্প হেল্প বইয়ের প্রকাশকের থেকে কথাটা একপেশে হয়ে গেল না?

মাফিয়া শব্দটা নিয়ে যদি বলি, জেনে শুনে কেউ মাফিয়ার সাথে লাগতে যায় না। যদি না সে নিজে একজন পূর্ণ বা অন্তত আধা মাফিয়া হয়। এক্ষেত্রে আপনার অবস্থা কি?

আপনি বলেছেন- তখন সে তার স্ত্রীকে দিয়ে ‘অধ্যয়ন’ নামে একটি প্রকাশনী খুলে…

আমার প্রশ্ন – এটা তো নৈতিক বা আইনগত কোনোভাবেই অন্যায় বা অপরাধ নয়। সেক্ষেত্রে আপত্তি টা কোথায়। যতদূর জানি আপনার বড় ভাই এবং আপনার ভাগিনা তারাও প্রকাশনা ব্যবসার সাথে যুক্ত। আপনার নিজেরও একাধিক প্রকাশনীর ট্রেড লাইসেন্স আছে। আমার সক্ষমতা এবং প্রয়োজন হলে আমি নিজেও হয়তো খুলবো। কিংবা খুলেছিও। এই পয়েন্টে আপনার আপত্তি কেন? উত্তর আশা করি।

আপনি বলেছেন – বইমেলায় তাম্রলিপির প্যাভিলিয়নেই বিক্রি হয় অধ্যয়নের বই। তারা ছোট ছোট প্রকাশনীর বেস্টসেলার লেখকদের এই বলে উদ্বুদ্ধ করে যে, ছোট স্টলে বই দিবেন কেন, আমাদের তো প্যাভিলিয়ন, আপনার বই প্যাভিলিয়নে বিক্রি হবে এবং আমাদের প্যাভিলিয়নে আপনার ছবি থাকবে।

আমার প্রশ্ন – এর ঠিক কোন জায়গাতে আপনার আপত্তি? এটা তো সিম্পল অ্যান্ড ক্লিয়ার বিজনেস। এটা অনেকেই করে। বা বলা যায় সবাই করে। আপনি বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন করেন না? এ যাবৎ করেন নাই? বা ভবিষ্যতে করবেন না?

আপনি বলেছেন – বাজারে প্রচলিত রয়্যালটির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রয়্যালটি অফার করে। এমনকি কোনো কোনো লেখককে তারা প্রফিটের ৫০% শেয়ারও অফার করে।

আমার প্রশ্ন – আপত্তির জায়গা স্পষ্ট নয়। অনেক সিনেমাতে আমরা দেখি অক্ষয় কুমার নিজে লাভের এত% না পেলে মুভি সাইন করেন না। কোনো লেখক যদি এই সম্মান পান, আমি এপ্রিশিয়েট করি। আপনার পয়েন্ট টা কি? একেক প্রকাশক একেক কারণে কাজ করেন। কারও স্রেফ নান্দনিক প্যাভিলিয়ন এর পুরস্কারটা দরকার। কেউ অনেক টাকা কামানোর পরে ইজ্জত কামাতে চান, কিংবা কেউ আপনার মতো বই পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে চান। রিডিং বেজড সোসাইটির স্বপ্ন দেখেন। আপত্তি টা কোথায়?

আমি নিজে বিক্রি অতি দুর্বল কিন্তু নামে ভারি এমন লেখক/লেখিকার জন্মদিনে স্রেফ স্ট্যাটাস রাখতে প্রকাশকের স্পন্সরে ফাইভ স্টারে পার্টি থ্রো করতে দেখেছি।

আপনি বলেছেন – সরলমতি লেখকদের প্রলুব্দ করে…

আমার প্রশ্ন – ব্যাপারটা খুব চাইল্ডিশ হয়ে গেলো না? প্রাপ্তবয়স্ক লেখকেরা সবাই সরলমতি? তাঁদের প্রলুব্ধ করা এতই সহজ? আপনি যা বলেছেন নিজেই বিশ্বাস করেন?

আপনি বলেছেন – সেসব লেখক নগদে বিশ্বাসী, তারা সেসব লেখককে অস্বাভাবিক অ্যাডভান্স অফার করে।

আমার প্রশ্ন – সাইনিং মানি দুনিয়াজুড়ে বেস্টলেসার রাইটারদের ক্ষেত্রে একটা প্রচলিত রীতি। জে কে রাওলিং থেকে শুরু করে আমাদের হুমায়ুন আহমেদ বা বর্তমান ক্রেজ সাদাত হোসাইনও এর মাঝে আছেন। ওবামা, ক্লিনটন তো নিজের প্রেসিডেনশিয়াল স্যালারির থেকে বেশি বই লিখে কামিয়েছেন। লেখক রাজি থাকলে অন্য কারো, আমার বা আপনার আপত্তি কোথায় হতে পারে?

আপনি বলেছেন – এছাড়াও লেখকদের তারা অন্য যেসব উপায়ে প্রলোভন দেখায়, রুচিগত কারণেই তা আর উল্লেখ করলাম না।

আমার প্রশ্ন – আপনার অভিযোগ সত্যি হলে তাম্রলিপি যা করেছে সেটা খুবই ন্যাক্কারজনক। আপনি যেভাবে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন, তাম্রলিপির উচিত নিজের অবস্থা স্পষ্ট করে বিবৃতি দেওয়া। যদি না দিয়ে থাকে সেটা এক প্রকারে অভিযোগ মেনে নেওাই হয়। সেক্ষেত্রেও আপনার অভিযোগ অইনগত না হলেও নৈতিক ভিত্তি পায়। তবে অলরেডি ব্যাপারটা রুচির মাত্রা অতিক্রম করেছে বলেই আমার ধারণা। সেক্ষেত্রে আপনি রুচির ধার না ধেরে উচিত কথাটা/কথাগুলো বলে ফেলতে পারেন কি না?

আপনি বলেছেন – তার কারণে কিছুটা হলেও আমি বুঝতে পারলাম ব্যবসায়িক লাভের জন্য এসব কাজ করা উচিত না। এবারও তাম্রলিপির একজন লেখকের সাথে আমার কমিউনিকেশন টিম যোগাযোগ করেছিল। সে আদর্শকে পাণ্ডুলিপি দিতেও রাজি হয়েছিল। কিন্তু আমি সেটা শোনার পর টিমকে আর আগাতে নিষেধ করে দিয়েছি। আমি বলে দিয়েছি কোনো প্রকাশনীর লেখকদের আদর্শ থেকে সাথে যোগাযোগ না করতে।

আমার প্রশ্ন – রিয়েলি? আপনি এমনটা করেন না বলতে চাচ্ছেন? আমি তো করি। খুব অল্প হলেও করি এবং লেখক যখন বলেন যে তিনি কোনো প্রকাশকের প্রতি কমিটেড তখন তাঁকে আর বিরক্ত করি না। অন্তত কমিটমেন্ট দেওয়া প্রোজেক্ট নিয়ে না। আমি যতদূর জানি আপনিও করেন। খুব আগ্রাসী এবং প্রবলভাবেই করেন। কমিটমেন্টের ধার না ধেরেই করেন। ভুল বললাম কি?

এবং এমন অভিযোগও আছে আপনি এই কাজে দেশের সেরা একটা বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের অসাধু কয়েকজনকে ব্যবহার করেন অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে। এই অভিযোগ নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

আমার আরও কিছু প্রশ্ন –

তাম্রলিপির বই আপনার বাঁধাইখানায় বাঁধাই করা হয় বলে জানা গেছে। এমনকি যখন এই বিষয়ে প্রকাশনা জগতে বেশ আলোচনা চলছে এবং আপনি নিজেও সরাসরি অভিযোগ করছেন তখনো বাধাইয়ের কাজ থেমে থাকেনি। এই নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে কি?

এস্টাবলিশমেন্টের বিপক্ষে আপনার অবস্থানকে আমি সম্মান করি। কিন্তু গত তিন জন বাংলা একাডেমির ডিজি যখন দায়িত্বে ছিলেন, দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তাঁদের বই প্রকাশের ব্যাপার টা (যদিও তাতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না) কিছুটা পরস্পর বিরোধী হয়ে যায় কি না?

ফাহাম আব্দুস সালাম, জিয়া হাসান এবং ফায়েজ আহমেদ তৈয়ব তিন জনই নিজের বই বাদ দিয়ে আপনাকে মেলায় যেতে বলেছেন। আপনি লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার থেকে এই তিন বই ছাড়া যেতে অস্বীকার করেন। আই স্যালুট দ্যাট। এবং তাতে আপনি যথেষ্ট কাভারেজ পেয়েছেন। আই এপ্রিশিয়েট। এটুকু আপনার প্রাপ্য। মেরুদণ্ডহীনদের দেশে আপনি যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তা আমি সাধুবাদ জানাই। আমি হলে পারতাম না হয়তো।

সেক্ষেত্রে আজকের রিপোর্ট অনুযায়ী আপনি বাংলা একাডেমির দাবি মেনে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ নিয়ে যেতে চান। সেক্ষেত্রে আপনার আগের দাবি কি মার্কেটিং স্ট্যান্ট ছিল কি না? এইক্ষেত্রে এই তিন জনের সরলতা (সাথে আরও অনেকেরও) আপনি ব্যবহার করলেন কি না? এই পয়েন্টে আপনার স্পষ্টতা আশা করি।

আপনার পক্ষে বিবৃতি দেওয়া এবং তাম্রলিপিকে বয়কটের ডাক দেওয়া একজন লেখক নিজে তাম্রলিপির নারী কর্মীর সাথে ইনবক্সে অসঙ্গত এবং ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করেছেন। এমন প্রমাণ পেলে আপনি কি তার বই উইথড্র করবেন? * এই প্রশ্নটা চলমান ডিবেটের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ না হলেও করলাম যেহেতু আপনার পক্ষে তার অবস্থান বেশ সরব এবং আপনি নিজেও সেই লেখকের স্ট্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যবহার করেছেন।

কোনো এক লেখক আদর্শ থেকে বই উইথড্র করার পরে সেটা তাম্রলিপি থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বই উইথড্র করার সময়ে লেখক আপনার কথামতো আপনার স্টকের সকল অবিক্রিত কপি নিজে কিনে নিয়েছিলেন। এর পরও অতি সম্প্রতি এক ইভেন্টে আদর্শের স্টলে সেই লেখকের বই বিক্রি হতে দেখা গেছে। অভিযোগটা কি সত্যি? যদি অভিযোগের পক্ষে তথ্য প্রমাণ থাকে, আপনার ডিফেন্স জানতে চাই।

আমার মনে হয় আপনার দুইটি ফেসবুক পোস্টে আপনি এমন সব অভিযোগ করেছেন যার বেশিরভাগই এক দৃষ্টিতে অভিযোগের কাতারে পড়ে না কিংবা আপনি নিজেও একই চর্চা করেন। এই চর্চার করার অভিযোগটা আমি করলাম। আপনার উত্তর জানতে চাই।

যদি এটা সত্য হয় যে লেখক ভাগিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ আপনি করেছেন, সেই একই অভিযোগ আপনার বিপক্ষে কেউ প্রমাণ সহকারে করলো, সেক্ষেত্রে কি আপনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন কি না?

এবং দয়া করে এটা ভাবনে না আমার অভিযোগের নামে হলো আপনার স্টল নিষিদ্ধ করাকে আমি সমর্থন করি। মোটেই না।

আমি আপনার ব্যবসার পক্ষে, আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। আপনার বিপ্লবেরও পক্ষে। যদিও আমি নিজে বিপ্লবী নই। বরং বলতে পারেন সুবিধাবাদি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। তবে আমি যার বিপক্ষে, সেটা কেবল এবং একমাত্র ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের বিপক্ষে। আশা করি আপনিও।

পারসোনাল এটাকে আমি না যাওয়ার চেষ্টা করলাম। যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি ক্ষমা চাচ্ছি। তবে আমার কিছু পারসোনাল প্রশ্নও আছে। সেগুলো কিঞ্চিৎ আগ্রাসী বিধায় পাবলিক প্লেসে সেই চর্চা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। সামনাসামনি দেখা হলে করবো হয়তো। একই সাথে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর চাচ্ছি।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চায় সকলে উদার হোক। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

** বাংলা একাডেমি এবং তাদের কাজ ও সিদ্ধান্ত আমার ধর্তব্য নয়। রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান বিধায় তাঁদের কাছে আমার প্রত্যাশা অতি সামান্য বা নেই বললেই চলে। তবে একটা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান যা আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনে ক্ষেত্রে দীর্ঘসময়জুড়ে দারুন ভূমিকা রেখেছে, বইমেলা আয়োজন নিয়ে এমন একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে পরিণত হতে দেখা চোখের, মনের ও মননের জন্য পীড়াদায়ক।

লেখক: প্রকাশক,  স্বরে ‘অ’ প্রকাশনী

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *