জাতীয় নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ

:: আরিফুল হক ::

বাংলাদেশের মূলধারার নাট্যাকাশে এই জ্যোতির্ময় পুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল, ১০ই মার্চ ১৯২৫ সালে। ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর থানার মাইজহাটি গ্রামে তাঁর জন্ম। মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ ছিল আসল নাম। লেখক হিসাবে তিনি আসকার ইবনে শাইখ ব্যবহার করতেন ।এবং এই নামটিতেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত গেলেন ।

তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ , ইতিহাসবিদ , গল্পকার, গীতিকার, প্রাবন্ধিক , সবার উপর তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শুধু নয়,বাংলা সাহিত্যের মূলধারার স্বনামধন্য নাট্যকার । তিনি বাংলা নাটকে বৃষ্টিধারা এনে বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সবুজ, সজীব, ফুলে ফলে সুশোভিত করে গেছেন । প্রায় দেড়’শ র মত নাটকের স্রষ্ঠা তিনি। তাঁর রচনার মধ্যে আছে , সামাজিক নাটক , ঐতিহাসিক নাটক, কাব্যনাটক , গীতিনাট্য, কিশোর নাট্য, অনুবাদ নাটক প্রভৃতি সর্বধারার নাটক । বাংলা সাহিত্যে এত সংখ্যক নাটক , আর কেউ লিখেছেন কিনা আমার জানা নেই ।

এই স্বল্প পরিসরে তাঁর সব নাটকের নাম করার অবকাশ নেই তবে তাঁর নাটকের নামই বলে দেয় কোন মাটি-মানুষের নাট্যকার তিনি । যে সময়টায় মুসলমানরা নাটক করতে গেলে বাবু নাট্যকারদের শরনাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা ,সেই সময়, অর্থাৎ সেই ১৯৪৭ সালে , তিনি প্রথম নাটক লিখলেন, ‘বিরোধ’ । ডঃ মুহাম্মদ শহীদউল্লাহর প্রস্তাব মত ১৯৪৭ সালেই ঢাকা ইউনিভার্সিটির কার্জন হলে নাটকটি মঞ্চস্থ হল ! এরপর আর তিনি থেমে থাকেননি । পদক্ষেপ(১৯৪৮) ,বিদ্রোহী পদ্মা ( ১৯৪৯) , দুরন্ত ঠেউ (১৯৫১) , শেষে অধ্যায় (১৯৫২), এইভাবে বিলবাওড়ের ঠেউ, লালন ফকির, তিতুমীর , অগ্নিগিরি , কর্ডোভার আগে , কিশোর নাটক দুটি ফুল, কন্যা ডালিম ফুলী , বাদুড় ।ছাড়াও ১৪টি নাটিকার সিরিজ ‘রাজ্য রাজা -রাজধানী’ । ১১টি নাটিকার সিরিজ ‘মেঘলা রাতের তারা’ ও ৩১ টি মুসলিম নারীচরিত্রভিত্তিক নাটিকা ‘কন্যা জায়া জননী ‘। যেগুলো একসময় জনপ্রিয় সিরিজ নাটক হিসাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে ।

আসকার ইবনে শাইখ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগেরই শিক্ষক ছিলেন , তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বহু নামী দামী নাট্যভিনেতার নাটকেরও শিক্ষক । সর্ব -জনাব ,আনোয়ার হোসেন , হাসান ইমাম , ফরিদ আলি , নজমুল হুদা বাচ্চু ,এটি এম শামসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ বহু গুনী শিল্পীই তাঁর কাছে ঋনী ।

মৃত্যুর মাত্র দু’বছর আগে তার সর্বশেষ নাট্য গ্রন্থ ‘স্বপ্ন সোনার গাঁও ‘ প্রকাশিত হয় । এ নাট্যগ্রন্থ সম্পর্কে তিনি ভূমিকায় বলেছেন ,’স্বপ্ন সোনার গাঁও’ একটা প্রতিকী নাম। এদেশের মানুষের চিরন্তন স্বাধীনতার স্বপ্নই এখানে স্বপ্ন , আর ‘সোনার গাঁও’ হল সোনার দেশ । অর্থাৎ বাংলাদেশের গণ মানুষের স্বপ্নই হল , একটি স্বাধীন সার্বভৌম সোনার দেশ গড়া । আসকার ইবনে শাইক সাহেবের সমগ্র রচনার ভিত্তিই হল তার দেশ , তাঁর পিতৃভূমি ।তাঁর নাট্য রচনার চৌহদ্দি ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন , সমাজ , ধর্ম ,সংস্কৃতি , ইতিহাস ও ঐতিহ্য ।

নাটককে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না । অর্থাৎ একটি থিয়েটার হলে বসে , মাত্র দু ঘন্টার মধ্যে , দেশের মানুষ , সমাজ, তাদের আচরণবিধি , সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য দেখে নেয়া যায়।

নাটক জনজীবনের রূপ প্রতিফলিত করে । সেই জীবন কোন ব্যক্তি জীবন নয় । বৃহত্তর সামাজিক জীবন । বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের কতগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে , যা কলকাতার বাংলা নাটক দিয়ে পূরণ হওয়ার নয় । বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ধর্মবোধ আছে, নিজস্ব রসবোধ আছে, নিজস্ব সাংস্কৃতিক জীবন আছে, যা সম্পূর্ণরূপে ধর্মের অনুসারী । বাংলাদেশে সাহিত্য সংস্কৃতি নাটক জনজীবনের বিশেষ এই বৈশিষ্টগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারেনা । এড়িয়ে গেলে তা জনমানুষের গ্রহনযোগ্য সাহিত্য হবেনা , সস্কৃতি হবেনা , নাটক ও হবেনা ।

আসকার ইবনে শাইখ একমাত্র ব্যতিক্রমী নাট্যকার যার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকর্মই বাংলাদেশের মসলিন সূতোয় বোনা ! তাঁর প্রতিটি নাটকই বাংলাদেশের মানুষের আশা আখাংঙ্কা,আনন্দ ইতিহাস জীবনকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। এজন্যই তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব নাট্যকার , বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যকার হওয়ার একমাত্র যোগ্যতম ব্যক্তি।

জাতীর প্রতীক তো তিনিই, যিনি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক জীবনধারা, এবং আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে আসকার ইবনে শাইখ ব্যতীত জাতীয় প্রতিনিধিত্ব করার মত আর কোন যোগ্যতম ব্যক্তি আছেন কি ? নেই । কাজেই আসকার ইবনে শাইকই বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যকার ।

তবে ,অন্য অনেক কিছুর মতই বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন ও কিছু অযোগ্য মতলববাজদের হাতে আটকা পড়ে আছে ।এদের কাছে যোগ্য মানুষের মর্য্যাদা নেই । ফলে গোটা জাতিটাই আজ মর্য্যাদাহীন হয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।

লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *