:: সুমাইয়া তাসনিম ::
ইডেনে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। আমরাও আইডি কার্ড না নিয়ে গেলে ঢুকতে পারতাম না। সুতরাং সাধারণ মানুষের ইডেন সম্পর্কে কিছুটা জল্পনা কল্পনা থাকা অস্বাভাবিক না। কিন্তু বিবেক-বুদ্ধিওয়ালা মানুষ হয়েও আপনারা যদি এগুলো সাধারণ ছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন তাহলে খুবই দুঃখজনক। আমি অনার্স মাস্টার্স করেছি ইডেন থেকে। আপনার কি মনে হয় আমরা সার্টিফিকেটের জন্যে কারো বিছানায় গিয়েছি? বিভিন্ন ভাষায় ঘুরিয়ে পেচিয়ে আপনারা তো তাই বলছেন। এতে করে কত স্ট্রাগল করে পড়ার সুযোগ পাওয়া মেয়েদের আবার পড়ার সুযোগ হারাতে হবে ভেবেছেন? কত মেয়ের বিয়ে হয়েছে যাদের শ্বশুর বাড়িতে এ নিয়ে তীর্যক কথা শুনতে হবে, চারিত্রিক অপবাদ পেতে হবে ভেবেছেন? কত মেয়ের টিউশনি চলে যেতে পারেন ভেবেছেন? স্রেফ ইডেনের আইডি কার্ড গলায় থাকলে কত মেয়েকে রাস্তাঘাটে বাসে বেশ্যা শব্দটা শুনতে হবে জানেন? একটা দেড়শো বছরের পুরানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলায় মেয়েদের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেটায় রানিং স্টুডেন্ট থাকে ৩৫০০০+ তাদের মধ্যে কয়টা মেয়ে পলিটিক্সে ইনভলভ হয়? আমাদের ক্লাসে দেড়শোজনে একজনও ছিল না। অনেস্টলি বললাম। খুব অল্প কিছু স্টুডেন্ট ছাত্রফ্রন্ট আর ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। সেকেন্ড ইয়ারের দিকে ছাত্রফ্রন্ট আমার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল, পোলাইটলি রিফিউজ করেছি, আর জোরাজুরিও করেনাই৷ এদ্দুরই আমার ইডেনের সাত বছরের পলিটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স। কোনো র্যাগিং কখনো পাইনাই, করিওনাই
যথেষ্ট হেল্পফুল টিচার আর ল্যাব এ্যাসিস্ট্যান্ট আপু ও সেমিনার আপু ছাড়াও ডিপার্টমেন্টের মামা-খালাদেরও ভালো ব্যবহার পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার ডিপার্টমেন্টের হেড খুবই কাঠখোট্টা মানুষ হিসাবে পরিচিত। আসার পর থেকে ডিপার্টমেন্টকে উন্নতি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। টিচারদেরকে সাথে স্টুডেন্টদেরও খাটিয়ে মারেন। ক্যাম্পাসে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও খুব ভালো। আমার বিশ্বাস অন্যান্য সাধারণ ছাত্রীদেরও তাই।
ছাত্রলীগ একটা দল। যার চরিত্র সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। আর সেটা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই। তবে জোর করে মিছিলে, প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া, পা টেপানো, ব্ল্যাকমেইল করে ছবি তুলে রাখা এগুলো আমরাও কিছু কিছু শুনেছি। সেটাও যারা পলিটিক্যাল সিটে উঠে তাদের সাথে। হলের সাধারণ ছাত্রীদের সাথে না। আর যারা হলে থাকেনা তাদের সাথে কখনো র্যাগের ঘটনাও ঘটেনা। ইডেন হয়তো খুব উচ্চমানের পড়াশোনার রিসোর্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনা কিংবা রিসার্চার তৈরি করার ক্ষেত্রে ক্যাপেবল না, কিন্তু ইডেন খুবই সেইফ এবং পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ প্রোভাইড করে। বিশেষ করে ১৮ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা ইডেনের প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই প্রশান্তিদায়ক। কমন গ্রন্থাগার ছাড়াও প্রত্যেকটা হলে একাধিক রিডিং রুম আছে যেগুলো কখনো কেউ খালি দেখেনাই। সারাক্ষণ মেয়েরা পড়ছে। আমি তাইকোয়ান্ডো শিখেছি ইডেনের তাইকোয়ান্ডো ক্লাবে। আমার ফ্রেন্ডরা গান শিখেছে, ক্লাবিংসহ বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার কাজে ইনভলভ থেকেছে। এই দীর্ঘ সময়ে পলিটিক্যাল এসব ইস্যু কখনো লাউডলি কানেও আসেনাই।
ছাত্রলীগের কামড়াকামড়ি যে আজকে ইডেনের ৩৫ হাজারের বেশি রানিং স্টুডেন্টকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে এটার ক্ষেত্রে সচেতন মানুষদের ফ্যাক্ট চেক করে কথা বলা খুব দরকার। ইনফ্যাক্ট ইডেন এতটাই বড় একটা প্রতিষ্ঠান যে খুঁজলে সবার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই কেউ কেউ অবশ্যই থাকবে যে ইডেনে পড়েছে। নিজেরা ফেসবুকে গুজব না ছড়িয়ে তাদের জিজ্ঞেস করা যেতে পারে তারা এরকম কিছু ফেস করেছেন কিনা। খুব কষ্ট করে বহু দূর-দূরান্ত থেকে মেয়েরা এখানে পড়তে আসে এবং খুব কষ্ট করে দুইবেলা খেয়ে না খেয়ে পড়ে এমন প্রচুর মেয়ে আছে। খুব পড়ার ইচ্ছা এদের অধিকাংশেরই। অনেকের পরিবারে সেই প্রথম মেয়ে যে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এমনও আছে ঢাবিতে চান্স পেয়েছে কিন্তু কো-এডুকেশন বলে পরিবার এলাউ করেনি তাই ইডেনে ভর্তি হয়েছে। এখানে সব রকম মেয়ে পাবেন। এর মধ্যে নিজেরা শ্রম দিয়ে নিজের আর নিজের পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়, জীবনের কোনো পর্যায়ে কারো বোঝা হতে চায় না এমনই সবচেয়ে বেশি পাবেন। এই মেয়েদেরকে সম্মান করতে না পারেন, অসম্মান করবেন না। গুজব ছড়ায়েন না। চরিত্রের উপর এই ধরনের অসত্য অপবাদের দাগ সহ্য করা যেকোনো ভদ্র ঘরের মেয়ের জন্য খুব কঠিন।
লেখিকা: সাবেক ছাত্রী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ইডেন কলেজ