কবি কাইফি আজমি: আশার চিরন্তন শিখার প্রতীক

:: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ::

মহারাষ্ট্রের সাবেক কট্টরপন্থী মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিং উর্দু ভাষাকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করলে উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি ও গীতিকার কাইফি আজমি তাঁকে দেওয়া ভারতের রাষ্ট্রীয় “পদ্মশ্রী” পুরস্কার সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি এমন অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, মুখে যা উচ্চারণ করতেন, নিজের জীবনে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি জানি না, কখন আমার জন্ম হয়েছে এবং আমি এটাও জানি যে, কখন আমার মৃত্যু হবে। আমি শুধু এটুকু জানি যে, আমার জন্ম হয়েছিল পরাধীন হিন্দুস্থানে, স্বাধীন হিন্দুস্থানে আমি বড় হয়েছি এবংং আমি মৃত্যুবরণ করবো সমাজতান্ত্রিক হিন্দুস্থানে।”

কাইফি আজমি বাস করতেন নিজের স্বপ্নের মাঝে এবং হিন্দুস্থানের লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতেন তাঁর বিপ্লবী কবিতা, গান ও দার্শনিক লেখায়। তিনি মানুষের স্বপ্ন, আশা ও আকাংখা দ্বারা তাড়িত-পরিচালিত হতেন। তিনি তাঁর কবিতায় বলেছেন:

“আন্ধেরে ক্যয়া উজালা ক্যয়া,

না ইয়ে আপনে, না ও আপনে,

তেরে কাম আয়েঙ্গে পেয়ারে,

তেরে আরমান তেরে সপনে,”

(অন্ধকার হোক আলো হোক,

কোনোটাই আপন নয়,

যা তোমার কাজে আসবে তা হলো

তোমার আকাংখা ও তোমার স্বপ্ন।)

উপমহাদেশের খ্যাতিমান উর্দু কবি কাইফি আজমি ১৯১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি উত্তর প্রদেশের আজমগড় জিলার মিজওয়ান গ্রামে এক শিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম আতাহার হুসাইন রিজভি। তাঁর ভাইও কবি ছিলেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম গজল লিখে এক মুশায়রায় আবৃত্তি করে প্রশংসিত হন। কাইফি’র পিতার সন্দেহ হয় যে তাঁর পুত্র তাঁর বড় ভাইয়ের গজল নিজের বলে আবৃত্তি করেছেন। তাঁর বড় ভাই যখন অস্বীকার করেন যে এটা তাঁর লেখা গজল নয়, তখন তিনি ও তাঁর সহকর্মী পুত্রের কাব্যিক মেধা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে একটি কবিতার একটি মাত্র লাইন দিয়ে বলেন একই মাত্রা ও ছন্দে একটি গজল লেখার জন্য। কাইফি আজমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে গজলটির পরিপূর্ণ রূপ দেন।

‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন চলাকালে কাইফি আজমি ফারসি ও উর্দু শিক্ষা ত্যাগ করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করে ফুলটাইম মার্ক্সবাদীতে পরিণত হন। লক্ষ্মৌর প্রগতিশীল লেখকরা তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা ও কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে উৎসাহিত করেন। তিনি প্রগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়ার সদস্য হন। জমিদারের পুত্র হওয়া সত্বেও আরাম আয়েশের জীবন পরিহার করে চব্বিশ বছর বয়সে তিনি কানপুরের কারখানা এলাকায় কর্মতৎপরতা শুরু করেন এবং সেখান থেকে তাকে বোম্বেতে গিয়ে দলীয় কর্মকান্ড শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অধিকাংশ উর্দু কবির মতো কাইফি আজমি গজল দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলেও শিগগিরই তিনি সামাজিক সচেতনতামূলক কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর কবিতায় জনগণকে শোষণের কথা এবং বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে ন্যায়ভিত্তিক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বার্তা থাকতো। তবু তাঁর কবিতাকে রাজনৈতিক প্রচারণামূলক কবিতা বলা যাবে না। তাঁর কবিতায় সমাজের হতদরিদ্র, বঞ্চিত মানুষের প্রতি আবেগ, সহানুভূতির চেতনা ফুটে ওঠেছে। তাঁর সেরা কবিতা হিসেবে গন্য করা হয়, ‘আউরাত,’ ‘মাকান,’ ‘দায়েরা,’ ‘সাঁপ’ ও ‘বহুরূপনি’।

কাইফি আজমি প্রথমে একজন মানুষ, এরপর তিনি একজন কবি; প্রথমে তিনি একজন প্রেমিক, এরপর একজন কবি। দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের জন্য তাঁর গভীর উদ্বেগ ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তাঁর অসংখ্য ‘নজম,’ ‘গজল’ ও অসংখ্য কবিতায়। তাঁর সমসাময়িক কবি ও গীতিকার সাহির লুধিয়ানভি, মাজরুহ সুলতানপুরি, শাকিল বদায়ুনী, শৈলেন্দ্র এবং অন্যান্যের তুলনায় ছায়াছবিতে অন্তর্ভুক্ত তাঁর গানের সংখ্যা অনেক কম হলেও, তিনি যে গানগুলো লিখেছেন, সেগুলো রোমান্টিক, ভাবাবেশপূর্ণ এবং বিদ্রোহমূলক বার্তাবাহী।

কাইফি আজমি’র বিদ্রোহী মনোভাব তাঁর শৈশব থেকে। তাঁর বিপ্লবী চিন্তাভাবনা, বামপন্থী ভাবধারা, স্বাধীতা পরবর্তী সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা তাঁর প্রগতিশীল লেখার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে এবং তাঁর লেখা গানেও এ চেতনা ফুটে ওঠেছে। তিনি সাধারণ মানুষের কবি ছিলেন, কিন্তু তাঁর কবিতা রূপক ও কল্পনায় সমৃদ্ধ। তিনি ছিলেন চিন্তাশীল কবি, প্রগতিশীল লেখক, একজন বিপ্লবী ও প্রেমিক।

কাইফি আজমি ১৯ বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে বিয়ে করেন এবং এর কাছাকাছি সময়ে তিনি তার প্রথম নবজাত সন্তানকে হারান। স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকার কমিউনিস্ট পার্টির অফিস বন্ধ করে দেওয়ার পর তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হয়। বিপর্যয়ের মাঝেও নিজের মর্যাদা বজায় রেখে টিকে থাকার জন্য তিনি ছায়াছবিতে সঙ্গীত ও চিত্রনাট্য লেখার কাজ গ্রহণ করেন। তাঁর কমিউনিস্ট বন্ধু ইসমত চুগতাই এবং শহীদ লতিফ তাঁকে ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডের কিছু ছবিতে লেখার কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কাইফি আজমির স্বীকৃতি আসে গুরু দত্তের আধা-আত্মজীবনীমূলক ছায়াছবি ‘কাগজ কে ফুল’ এর গীতিকার হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়ে। সাহির লুধিয়ানভির সঙ্গে গুরু দত্তের মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি কাইফি আজমিকে গীতিকার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হলে কাইফি আজমিসহ ছবিটির সঙ্গে জড়িত সকলেই হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু কাইফি আজমির হৃদয় পুরোপুরি ভাঙেনি। গুরু দত্তের আরেকটি ছায়াছবির জন্য তিনি লিখেন:

“বদল জায়ে আগার মালি, চমন হোতা নেহি খালি,

বাহারে ফির ভি আতি হ্যায়, বাহারে ফির ভি আয়েগি,”

(মালির পরিবর্তন হলে উদ্যান শূন্য পড়ে থাকে না,

আবারও বসন্ত আসে, আবারও বসন্ত আসবে।)

‘কাগজ-কে ফুল’ এর পর কাইফি আজমি ‘৪০ দিন,’ ‘নকলি নওয়াব,’ ‘আপনা হাত জগন্নাথ,’ ‘এক কে বাদ এক’সহ বেশ কিছু ছায়াছবির জন্য গান লিখেছিলেন এবং প্রতিটি ছবি বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর কাইফি আজমিকে ব্যর্থ গীতিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে শৈল্পিক মানে উত্তীর্ণ ও বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে তাঁর খ্যাতি আসে ‘হাকিকত’ ছায়াছবির সঙ্গে। এই ছবিতে তাঁর গানে সুর দিয়েছেন সুরকার হিসেবে ব্যর্থতার তকমাধারী মদন মোহন। ছবিতে গানের তেমন সুযোগ না থাকলেও কাইফি আজমির দুটি গান স্থান পায়, যার একটি:

“কর চলে হাম ফিদা জান-ও-তন সাথিয়োঁ,

আব তুমহারে হাওয়ালে ওয়াতান সাথিয়োঁ,”

(বন্ধুরা, আমরা আমাদের জীবন ও দেহ বিসর্জন দিয়েছি,

এখন দেশের দায়িত্ব তোমাদের ওপর সপে দিয়েছি।)

সকল যুগের উপযোগী দেশাত্ববোধক গানটি ভারতজুড়ে এখনো জনপ্রিয়।

ছায়াছবির গানের ক্ষেত্রে কাইফি আজমি পরিচালক হৃষিকেষ মুখার্জির সঙ্গে কাজ করে সত্যিকার অর্থেই কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন। তিনি তাঁর পরিচালিত ‘দো দিল,’ ‘অনুপমা,’ ‘সত্যকাম,’ ‘বাবুর্চি,’ ইত্যাদি ছবির জন্য গান লিখেছেন। দু’জন সমবয়সী হলেও হৃষিকেশ তাকে তার ওস্তাদ বিবেচনা করতেন এবং অনেক সময় কাইফি তাকে তিরস্কার করে বলতেন যে একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের উচিত সমাজের বিবেকের রক্ষক, দোকানদার নয়।

কাইফি আজমি একজন নাস্তিক ছিলেন, কিন্তু তাঁর ধর্মনিপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে সকল ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখিয়েছিল। পরলোকগত বিখ্যাত হিন্দি ও মারাঠি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী উষা কিরণের কন্যা তানভি’র সঙ্গে কাইফি আজমির পুত্র বাবা আজমি’র প্রেম যখন বিয়ের দিকে গড়ায়, উষা কিরণ দেশবিভাগের দিনগুলোতে সংঘটিত দাঙ্গার স্মৃতির কারণে মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখতেন এবং কন্যাকে একজন মুসলিমের সঙ্গে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। কাইফি কারণ জানতে পেরে উষা কিরণের বাড়ি গিয়ে তার সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জন্য বলেন যে তার পরিবারের মুসলিম হওয়াই যদি বিয়ের আপত্তির প্রধান কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তিনি তাঁর বাড়িতে পুত্রবধুঁ তানভি’র জন্য একটি মন্দির তৈরি করে দেবেন।

কাইফি আজমি সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বহু পদক ও পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত করা হয়। কিন্তু মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিং ‘যারা উর্দু ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে তাদেরকে গাধার পিঠে বসিয়ে প্রদক্ষিণ করানোর উচিত” মর্মে মন্তব্য করলে ১৯৮০ সালে কাইফি আজমী ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব ফিরিয়ে দেন। তিনি বলেন যে তিনি তাঁর সারা জীবন উর্দু ভাষায় লিখেছেন এবং মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উর্দু সম্পর্কে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করায়, একজন লেখক হিসেবে এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানো তাঁর কর্তব্য বলে বিবেচনা করেন। ২০০০ সালে দিল্লি সরকার এবং দিল্লি উর্দু একাডেমি তাঁকে প্রথম মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। শান্তি নিকেতনের বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করে। কাইফি আজমি ২০০২ সালের ১০ মে মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুর পরও তাঁকে অনেক মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।

২০০৫ সালে দিল্লির একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় ‘কাইফি আজমী সড়ক’। দিল্লির আর,কে পুরমের একটি রাস্তার নাম ‘কাইফি আজমী মার্গ’। হায়দরাবাদেও তার নামে ‘কাইফি আজমী রোড’ রয়েছে। ভারতীয় রেলওয়ে তাঁর জন্মস্থান আজমগড় থেকে পুরোনো দিল্লি পর্যন্ত ৮০০ মাইল দীর্ঘ রেলপথে চলাচলকারী একটি ট্রেনের নামকরণ করে ‘কাইফিয়াত এক্সপ্রেস’। বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সেরা কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম কবি হিসেবে বিবেচিত।

কাইফি আজমি সফলভাবে কাজ করেন চেতন আনন্দের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে, যার একটি ছিল “হীর রঞ্ঝা,” যে ছবির একটি গানের কথাগুলোকে অনেকটা অমরত্ব লাভ করেছে বলা চলে। পাঠকদের কাছে গানটি উপস্থাপন করছি:

“ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল, মেরে কাম কি নেহি,

কিসকো সুনায়োঁ হালে দিল-এ-বেকারার কা,

বুঝতা হুয়া চিরাগ হুঁ আপনে মাজার কা,

এ্যয় কাশ ভুল জাউঁ, মগর ভুল তা নেহি,

কিস ধুম সে উঠা থা জানাজা বাহার কা,

ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল —,

আপনা পাতা মিলে না খবর ইয়ার কে মিলে,

দুশমন কো ভি না এ্যয়সি সাজা পিয়ার কি মিলে,

উনকো খুদা মিলে, হ্যায় খুদা কি জিনহে তালাশ,

মুঝ কো বাস এক ঝলক মেরে দিলদার কি মিলে,

ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল —-,

সেহরা মে আ’কে ভি মুঝ কো ঠিকানা না মিলা,

গম কো ভুলানে কা কোঈ বাহানা না মিলা,

দিল তরসে জিস মে পিয়ার কো কিয়া সমঝুঁ উস সনসার কো,

ইক জিতি বাজি হার কে, ম্যায় ঢুন্ডু বিছড়ে ইয়ার কো —

ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল —,

দূর নিগাহো সে আঁসু বাহাতা হ্যায় কোঈ,

ক্যায়সে না জাউঁ ম্যায় মুঝ কো বুলাতা হ্যায় কোঈ,

ইয়া টুটে দিল কো জোড় দো, ইয়া সারে বন্ধন তোড় দো,

এ্যয় পর্বত রাস্তা দে মুঝে, এ্যয় কাঁটোঁ দামন ছোড় দো,

ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল —-,”

বাংলা অনুবাদ:

(এই পৃথিবী, এই আসর আমার কোনো কাজের নয়,

আমি কাকে আমার অস্থির হৃদয়ের কাহিনি শোনাবো?

আমি আমার নিজের কবরের নিভে যাওয়া প্রদীপ,

হায়, যদি আমি ভুলে যেতে পারতাম, কিন্তু ভুলতে পারি না,

কত আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটন্ত বসন্তের শবযাত্রা শুরু হয়েছিল

এই পৃথিবী, এই আসর আমার কোনো কাজের নয়,

আমি জানি না যে আমি কোথায়, আমার বন্ধুর কোনো খবর পাই না,

প্রেমের জন্য কোনো শত্রুও যাতে এমন শাস্তি ভোগ না করে,

এমনকি যারা খোদার সন্ধান করে, তারা খোদাকে পায়,

আমি শুধু আমার প্রেমিকাকে এক বার দেখতে চেয়েছি,

এই মরুভূমিতে এসেও তো আমি কোনো কুল-কিনারা পাচ্ছি না।

এমনকি দু:খ ভুলে থাকার জন্য কোনো অজুহাত খুঁজে পাচ্ছি না,

যে পৃথিবীতে ভালোবাসার জন্য হৃদয় তৃষ্ণার্ত, সে পৃথিবীকে কিভাবে বুঝবো,

জয়ী হওয়ার খেলায় হেরে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজছি,

এই পৃথিবী, এই আসর আমার কোনো কাজের নয়,

আমি দেখছি বহু দূরে কেউ অশ্রু বিসর্জন করছে,

আমাকে কেউ ডাকছে, আমার পক্ষে কিভাবে না যাওয়া সম্ভব?

হয় ভাঙা হৃদয়কে যুক্ত করে দাও, অথবা সকল বন্ধন ভেঙে ফেলো,

হে পর্বত, আমাকে পথ করে দাও, হে কন্টক, আমার সঙ্গ ত্যাগ করো,

এই পৃথিবী, এই আসর আমার কোনো কাজের নয়,

কাইফি আজমির কবিতা ‘আওরত’ নারীদের বিদ্রোহী হতে, পুরুষের পাশপাশি কাজ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে:

আওরাত

“উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

কলব-এ-মাহোল মে লরজাঁ শারার-এ-জঙ হ্যায় আজ

হোসলে ওয়াক্ত কে আউর জিস্ত কে এক রং হ্যায় আজ

আ’বগিনোঁ মে তাপান ওয়ালওয়ালে-এ-সঙ হ্যায় আজ,

হুসন আউর ইশক হাম আওয়া’জ-ও-হামা’হাঙ হ্যায় আজ,

জিস মে জ্বলতা হুঁ উসি আগ মে জ্বলনা হ্যায় তুঝে

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

জিন্দেগি জেহদ মে হ্যায় সবর কে কাবু মে নেহি,

নবজ-এ-হাস্তি লহু কাঁপতি আ’সু মে নেহি.

উড়নে খুলনে মে হ্যায় নাখাট খাম-এ-গেসু মে নেহি

জান্নাত এক আউর হ্যায় জো মরদ কে পেহলু মে নেহি,

উসকি আজাদ রাওয়িশ পর ভি মচলনা হ্যায় তুঝে,

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

কদর আব তক তেরি তারিখ নে জানি হি নেহি,

তুঝ মে শোলে ভি হ্যায় বাস আশকফিশা’নি হি নেহি,

তু হাকিকত ভি হ্যায় হিলচসপ কাহানি হি নেহি,

তেরি হাস্তি ভি হ্যায় এক চিজ জওয়ানি হি নেহি,

আপনি তারিখ কা উনবান বদলনা হ্যায় তুঝে,

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

গোশে গোশে মে সুলাগতি হ্যায় চিতা তেরে লিয়ে

ফরজ কা ভেস বদলতি হ্যায় কাদা তেরে লিয়ে,

কহর হ্যায় তেরি হর এক নরম আদা তেরে লিয়ে

জেহর হি জেহর হ্যায় দুনিয়া কি হাওয়া তেরে লিয়ে,

রুত বদল ডাল আগার ফুলনা ফলনা হ্যায় তুঝে,

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

তোড় কর রসম কে বুত বন্দে কদামাত সে নিকাল,

জৌফ-এ-ইশরাত সে নিকাল, বাহম-এ-নাজাকাত সে নিকাল,

নফস কে খিঁচে হুয়ে হালক-এ-আজমত সে নিকাল

কয়েদ বন জায়ে মুহব্বত তো কয়েদ-এ-মুহব্বত সে নিকাল,

রাহ কা খার হি কিয়া গুল ভি কুচলনা হ্যায় তুঝে

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

তোড় ইয়ে আজম-শিকন দাগদাগ-এ-পন্দ ভি তোড়,

তেরি খাতির হ্যায় জো জঞ্জীর ওহ সোউগন্ধ ভি তোড়,

তউক ইয়ে ভি জমরুদ কা গুলবন্দ ভি তোড়,

তোড় পায়মানা-এ-মরদান-এ-খিরদমন্দ ভি তোড়,

বানঁকে তুফান ছলকনা হ্যায় উবালনা হ্যায় তুঝে,

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে,

তু ফালাতুন-আরাস্তু হ্যায় তু জোহরা পারভিন,

তেরে কবজে মে হ্যায় গরদুঁ, তেরি ঠোকর মে জমিঁ,

হাঁ, উঠা, জলদ উঠা পা-এ-মুকাদ্দর সে জাবিঁ,

ম্যায় ভি রুকনে কা নেহি ওয়াক্ত ভি রুকনে কা নেহি,

লড়খরায়েগি কাহাঁ তক কি সামভালনা হ্যায় তুঝে,

উঠ মেরি জান মেরে সাথ হি চলনা হ্যায় তুঝে।

বাংলা অনুবাদ:

নারী

(ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে,

আমাদের পৃথিবীতে আজ জ্বলে ওঠেছে যুদ্ধের আগুন,

এখন সময় ও ভাগ্যের আশা-আকাংখা অভিন্ন,

আজ আমাদের অশ্রু প্রবাহিত হবে তপ্ত লাভার মতো,

আজ এক হয়ে গেছে সৌন্দর্য ও প্রেমের জীবন ও আত্মা,

আমার সাথে তোমাকে জ্বলতে হবে স্বাধীনতার আগুনে,

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে,

জীবনভর সংগ্রামে ধৈর্য্য ও সহনশীলতায় কোনো কাজ হবে না,

অশ্রু নয়, রক্তই টিকিয়ে রাখবে জীবনের স্পন্দন,

স্বাধীন হলে তুমি উড়বে এবং প্রেমের ফাঁদে পড়বে না,

তোমাকে যে ভালোবাসে বেহেশত শুধু তার হাতে নয়,

শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে আমার সাথে স্বাধীনতার পথে চলো,

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে,

ইতিহাস এখনও তোমার মূল্য সম্পর্কে জানতে পারেনি,

তুমি শুধু অশ্রুই ফেলোনি, কয়লা জ্বালিয়ে ভস্ম করেছো,

তুমিই বাস্তবতা, তুমি শুধু আনন্দপূর্ণ গল্প-কাহিনি নও,

মূল্যবান শুধু তোমার যৌবন নয়, তোমার ব্যক্তিসত্তাও মূল্যবান,

তোমাকে বদলাতে হবে ইতিহাসের শিরোনাম,

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে,

তুমি যেখানেই যাবে তোমার জন্য অপেক্ষা করবে আত্মত্যাগ,

এই আত্মত্যাগই তোমার জন্য জীবনের এক পথ,

তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে তোমার সকল সৌন্দর্য,

পৃথিবীর পথগুলো তোমার জন্য বিষতূল্য,

ফুটে ওঠার জন্য ঋতুকে পরিবর্তন করো এবং মুক্ত হও

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।

বের হয়ে এসো পুরোনো বন্ধন থেকে, ভেঙে ফেলো প্রথাগত মূর্তি,

উপভোগের দুর্বলতা, তুচ্ছ মোহ, নিজের টানা কল্পিত শ্রেষ্ঠত্বেও সীমানা,

প্রেমের বন্ধন, কারণ এটাও এক ধরনের গোলামি,

তোমাকে শুধু পথের কাঁটা নয়, ফুলকেও পদপিষ্ট করতে হবে,

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।

সন্দেহের বাণী প্রচারের শেকলগুলো ভেঙে ফেলো,

ভেঙে ফেলো সেই প্রতিশ্রুতি যা তোমার শেকল হয়েছিল,

এগুলোও ভাঙ্গো, পান্নার কণ্ঠহার,

জ্ঞানী ব্যক্তিদের তৈরি করা নিয়মরীতি,

তুমি হবে প্রবল ঝড়, আছড়ে পড়বে, টগবগ করবে,

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।

তুমি অ্যারিস্টটলের দর্শন, তুমি ভেনাস, তুমি সপ্তর্ষি,

তুমি আকাশ এবং তোমার পায়ের নিচে মাটিকে নিয়ন্ত্রণ করো,

হ্যাঁ, ওঠো, শিগগির ওঠো, ভাগ্যের পা থেকে তোমার কপাল উঁচু করো,

আমিও থামবো না, এবং সময়ও থেমে থাকবে না,

আর কতকাল তুমি পড়ে পড়ে যাবে, দৃঢ় হতে হবে তোমাকে,

ওঠো আমার প্রেম, এখন তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।)

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা উপস্থাপন করছি, যেটির নাম “এক বোসা” বা “একটি চুম্বন:”

এক বোসা

“জব ভি চুম লেতা হুঁ উন হাসিন আঁখো কো,

সো চিরাগ অন্ধেরে মে জগমগানে লাগতে হ্যায়।

ফুল ক্যয়া, শাগুফে ক্যয়া, চান্দ ক্যয়া সিতারে ক্যয়া,

সব রকীব কদমো পর সর ঝুকানে লাগতে হ্যায়।

ফুল খিলনে লাগতে হ্যায় উজড়ে উজড়ে গুলশান মে,

পিয়াসি পিয়াসি ধরতি পর আবর ছানে লাগতে হ্যায়।

লামহে ভর কো ইয়ে দুনিয়া জুলম ছোড় দেতি হ্যায়,

লামহে ভর কো সব পাত্থর মুস্কুরানে লাগতে হ্যায়।

বাংলা অনুবাদ:

একটি চুম্বন

(যখনই আমি এই সুন্দর চোখে চুম্বন করি,

অন্ধকারে একশ বাতি ঝলমল করতে থাকে,

শুধু ফুল বা ফুলের কলি, চাঁদ অথবা তারা নয়,

এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তার পায়ে মাথা ঝুকায়।

বহুকাল অযত্মে থাকা উদ্যানে ফুল ফুটতে থাকে,

তৃষ্ণার্ত মাটির ওপর জড়ো হতে থাকে মেঘ।

মুহূর্তের জন্য পৃথিবী নিপীড়নে পথ ছেড়ে দেয়,

মুহূর্তের জন্য পাথরও হাসতে শুরু করে।)

কাইফি আজমি বহু জনপ্রিয় গানের একটি হচ্ছে:

“ইয়ে জিন্দেগি উসি কি হ্যায়, জো কিসি কা হো গ্যয়া,

পিয়ার হি মে খো গ্যায়া,

ইয়ে বাহার, ইয়ে সামা, কেহ রাহার হ্যায় পিয়ার কর,

কিসি কি আরজু মে আপনে দিল কা বেকারার কর,

জিন্দেগি হ্যায় বেওয়াফা —

জিন্দেগি হ্যায় বেওয়াফা, লুট পিয়ার কা মজা,

ধড়ক রাহা হ্যায় দিল তো ক্যয়া?

দিল কি ধড়কনে না গিন,

ফির কাহা ইয়ে ফুরসতে

ফির কাহা ইয়ে রাত-দিন,

আ রাহি হ্যায় ইয়ে সদা —

আ রাহি হ্যায় ইয়ে সদা, মস্তিয়ো মে ডুব জা,

ইয়ে জিন্দেগি উসি কি হ্যায়, জো কিসি কা হো গ্যয়া,

পিয়ার হি মে খো গ্যায়া —,

বাংলা অনুবাদ:

(এ জীবন তো তারই, যে অন্য কারও হয়ে গেছে,

এবং প্রেমের মাঝে হারিয়ে গেছে।

এই বসন্ত এবং এই সন্ধ্যা বলছে প্রেম করো,

কারও বাসনার মাঝে অশান্ত করে তোলো হৃদয়কে,

এ জীবন তো প্রতারক,

প্রতারক জীবনে প্রেমের আনন্দ গ্রহণ করো,

হৃদস্পন্দন দ্রুত হলে তাতে কি আসে যায়?

হদয়ের স্পন্দনকে গণনা করো না,

কোথায় পাবে আর এই অবসর

কোথায় পাবে এই রাত দিন?

এসব তো সবসময় আসবে

এসব সবসময় আসবে, তুমি আনন্দে ডুবে থাকো।

এ জীবন তো তারই, যে অন্য কারও হয়ে গেছে,

এবং প্রেমের মাঝে হারিয়ে গেছে।)

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *