আল্লাহর বিধান অমান্য: সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সৌদি নারী

:: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ::

আল্লাহ হারিয়ে গেছেন! শিরোনামটি আমার নয়। বিখ্যাত সিন্ধি লেখক অমর জালীল (পুরো নাম কাজী আমির আবদুল জালীল) এর একটি ছোটগল্পের শিরোনাম সিন্ধি ভাষায় “খুদা গুম থি ওয়াইয়ো” যার উর্দু “খুদা গুম হো গ্যায়া হ্যায়” অর্থ্যাৎ “আল্লাহ হারিয়ে গেছেন।” অমর জালীলের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকের শুরুতে। খুশবন্ত সিং সম্পাদিত ভারতের বিড়লা গ্রুপের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’য় অমর জালীলের বেশ কিছু ছোট গল্পের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। তার একটি গল্প ছিল “দ্য বাংলো ইন কুইন্স রোড” বা ‘কুইন্স রোডের বাংলো’।

গল্পটির কাহিনি ছিল যে, করাচির কুইন্স রোডের একটি সুন্দর বাড়িতে বিদেশি পতিতারা অভিজাত খদ্দেরদের চিত্ত বিনোদনে বা দেহদানে নিয়োজিত ছিলেন। গল্পের নায়ক পতিতাদের ‘পিম্প’ বা ভাড়ুয়ার মাধ্যমে সেখানে যান। পতিতা তার খদ্দেরকে সেবা দিতে আসেন। সুন্দরী তরুণী পতিতা আরবি ভাষায় খদ্দেরকে স্বাগত জানিয়ে তার পরিচয় দেন যে, তিনি লেবানন থেকে আগত। কিন্তু খদ্দের তার মুখে আরবি শুনে চমকে উঠেন এবং তার সেবা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। উভয়ের বচসায় ভাড়ুয়ার আবির্ভাব ঘটে এবং কারণ জানতে চাইলে খদ্দের তাকে জানান যে, কোরআনের ভাষায় কথা বলে এমন নারীকে শয্যায় নিয়ে তিনি তার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের অবমাননা করতে পারেন না এবং নিজের পাপের পাল্লা ভারি করতে চান না।

লেবানিজ সুন্দরী তার ভাড়ুয়ার কাছে খদ্দেরের বক্তব্য তরজমা করে দিতে বলেন এবং ভাড়ুয়া তাকে খদ্দেরের আপত্তির কথা বুঝিয়ে বললে পতিতা ক্ষেপে খদ্দেরকে গালিগালাজ করে যা বলেন, তার মর্ম হচ্ছে, তিনি তার দেহ বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করেন তা লেবাননে অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরের এতিম শিশুদের লালন পালনে ব্যয় করেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি মুসলমানদের ভন্ডামিপূর্ণ আচরণের কারণে তাকে এবং আরও অনেককে এ পথ বেছে নিতে হয়েছে। তাদের শরীরের পবিত্রতার চেয়ে পিতৃমাতৃহীন নিস্পাপ ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবন রক্ষা করা অনেক বেশি সওয়াবের কাজ।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী গল্পটির ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, গল্পটির মানবিক দিক আমাকে চমৎকৃত করেছিল। মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় কালিমা তাইয়েবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ খচিত সৌদি আরবের পতাকা হাতে সৌদি সুন্দরী ‘রামি আলক্বাহতানি’র অংশগ্রহণের সচিত্র খবরটি আমাকে অনুরূপ চমৎকৃত করেছে। আমি বিস্মিত হইনি যে সৌদি আরবের মতো একটি রক্ষণশীল দেশের এক তরুণী সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন।

এই ধরনের আগ্রহগুলো মানুষের সহজাত এবং ধর্মীয় বিধিবিধান এসব আগ্রহকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখতে পারে না। ‘ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ’ চলেই। ধর্মের বিধিবিধানের আড়ালে চলে, ধর্ম না থাকলেও চলে। একটি আরবি প্রবাদ আছে “কুল্লু শাইয়িন ইয়ারজিউঁ ইলা আসলিহি” ‘প্রত্যেক বস্তু নিজ নিজ মূলের দিকে ধাবিত হয়।’ মহানবী মুহাম্মদ সা. এর আগের আরব দুনিয়া কেমন ছিল? মূর্তিপূজা, দস্যুবৃত্তি, রাহাজানি, ধর্ষণ, নারীহরণ, কন্যাশিশুকে জ্যান্ত কবর দেওয়াসহ হেন পাপাচার ছিল না, যা আরব জগতের লোকজন তারা করতো না। কাবাঘর তাওয়াফ করতো মদ পান করে এবং অনেকে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন অবস্থায়। কাবা তাওয়াফ করতে আসা লোকজনের মালামালও চুরি করতো। ইসলামের আবির্ভাবে ইসলাম মানতেও তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। রাসুল সা. কে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ইহুদি অধ্যুষিত শান্তির নগরী মদিনায়।

আরব জগতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলেও ইসলামের অনুশাসন ও রীতিনীতিকে যে তারা তাদেরকে অবদমনের উপায় বলে বিবেচনা করতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুল সা. এর ওফাতের পর আরব জগতের দিকে দিকে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠা এবং বহুসংখ্যক ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটার মধ্যে। আরবরা আবার তাদের মূলের দিকে, অর্থ্যাৎ পৌত্তলিকতায় ফিরে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারা তাদের নিজ নিজ গোত্রকে বড় করে দেখে এবং ইসলাম ধনী-গরীব একাকার করার দাবি করলেও আজ পর্যন্ত আরব জগতে তো নয়ই, কোনো দেশেই গোত্র প্রথা উৎখাত করতে পারেনি। তারা গোত্রের আইন মানে, ইসলামের আইন নয়। ইসলামের প্রথম খলিফা বেচারা হযরত আবু বকর রা.কে তার পুরো মেয়াদ কাটাতে হয়েছে রিদ্দা যুদ্ধ বা ভন্ড নবীদের দমানোর যুদ্ধ করে।

আরব জগতের মানুষরা যদি চৌদ্দশ’ বছরের বেশি সময় পর “মূলের দিকে ফিরে যায়,” তাহলে কি তাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে? ‘অবদমন’ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে এবং ক্ষোভ জড়ো হতে হতে বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করলে বিদ্রোহীদের কতটা দোষারূপ করা যাবে? সৌদি ধর্মীয় পুলিশরা আগে রাস্তাঘাটে ইসলামী নীতি-নৈতিকতা কার্যকর করার জন্য যে কঠোরতা প্রদর্শন করতো, তাদের সে ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। আহারে! সৌদি সমাজে আগে যেসব কার্যকলাপকে ইসলাম বিরোধী বিবেচনা করা হতো এখন তা ইসলাম সম্মত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সব উদোম হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শায়খ এবং ইসলামী পণ্ডিতরা যে অজ্ঞাত কারণে সৌদি সরকারের কোনোকিছুতে নাক গলান না। তারা বলেন, সৌদি সরকার ও ইসলাম এক নয়। আমার বক্তব্যও অভিন্ন। সৌদি নারীরা গ্রীস্মে পাশ্চাত্যের নারীদের মতো ছোটো ছোটো কাপড়ে বিচরণ করুক, সারা বিশ্বের মুসলমানরা তাদের চোখ ও দিলের চোখ অবনত করে কাবা তাওয়াফ এবং রাসুলের রওজা ও অন্যান্য পবিত্র স্থান জিয়ারত করুক। মুসলমানরা ধর্ম পালন করুক আর সৌদি তরুণতরুণীরা তাদের স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করুক। দোষটা কোথায়?

শায়খরা মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় সৌদি সুন্দরীর অংশগ্রহণেও যে মুখ খুলবেন না, তা প্রায় স্বত:সিদ্ধ। কেন তারা আরেকটি দেশের সরকারের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করবেন? আল্লাহর ইশারা ছাড়া তারা কখনও কোনো কথাই বলেন না। সুবহানআল্লাহ! ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়, ইসলামী পণ্ডিতরা শাসকের সুরে সুরে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন। শাসকের মন বুঝে তারা কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা করেন। কারণ এর ব্যতিক্রম হলেই তাদের কপালে বিপদ নেমে আসবে অথবা লোভনীয় পদ লাভসহ সুযোগ সুবিধায় টান পড়বে। খুব কম সংখ্যককে বিপদ মাথা পেতে নিতে দেখা গেছে। যুগে যুগে এটাই সত্য। ক্ষমতা ও শক্তির কাছে সকলে অবনত মস্তকে থাকে, আলেম-মাশায়েখরাও মুখে তালা মেরে রাখেন ও চাবি দূরে নিক্ষেপ করেন। তারা বড়োজোর মনে মনে ঘৃণা করেন, অর্থ্যাৎ নিজেদের আত্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করেন। ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে যে, অস্ত্রহাতে দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে ‘জিহাদে ছগীর’ বা ছোটো যুদ্ধ এবং আত্মা বা সত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে ‘জিহাদে কবীর’ বা বড়ো যুদ্ধ। সমাজে ‘জিহাদে কবীর’ এ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাই অধিক।

মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির মসনবীতে একটি কাহিনি আছে: “এক ইমাম নামাজে ইমামতি করার সময় কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করছিলেন, ‘বেদুইনরা স্বভাগতভাবে উগ্র, অমার্জিত,’ পেছনের সারি থেকে এক বেদুইন এসে ইমামের কানের ওপর মুষ্টাঘাত করে। দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম তিলাওয়াত করেন, ‘তবে কিছু কিছু বেদুইন মার্জিত ও ভদ্র।’” এটাই বাস্তব চিত্র । অবস্থা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করাই সংখ্যাগরিষ্ঠ পন্ডিত ও শায়খদের কাজ।

লেখার শিরোনাম প্রসঙ্গে বলতে হয়, অমর জালীলের “খুদা গুম হো গ্যায়া হ্যায়” বা “আল্লাহ হারিয়ে গেছেন” গল্পের কাহিনি অনেকটা এমনই। ক্ষমতা যখন মানুষকে খোদায় পরিণত করে তখন আল্লাহ স্বয়ং বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি লিখেছেন, খোদার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল এবং তিনি জানতেন, খোদা ক্ষমতাধর ও পৃথিবীর সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং সবকিছু তিনি নির্ধারণ করেন। খোদা যেহেতু তার বন্ধু, অতএব তিনি খোদার সঙ্গে তর্কবিতর্ক করেন যে, কি কারণে তিনি ১ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বরের মধ্যে একজন নারীকেও পয়গম্বর হিসেবে পাঠাননি। খোদার কাছে সদুত্তর না পেয়ে তিনি আপন মনে বলেন, ‘খোদার যেহেতু কোনো মা নেই, সেজন্য তিনি মায়ের মমত্ব ও নারীর কোমলতা বোঝেন না।’ তিনি খোদাকে বদনসীব বা দুর্ভাগা বিবেচনা করেন। খোদা এক পর্যায়ে তাকে পীড়াপীড়ি করেন, ‘তুমি আমার কাছে কিছু চাও’। তিনি বলেন, ‘আমি যা চাই, তা তুমি দিতে পারবে না।’ খোদা তাকে বলেন, ‘আমার কাছে তোমাকে না দেওয়ার কিছু নেই, তুমি চাও’। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমাকে তোমার খোদায়ী দাও’। খোদার পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া আসে না। তিনি পেছনে ফিরে দেখেন, খোদা নেই। তিনি হারিয়ে গেছেন।”

যারা ক্ষমতার অধীশ্বর হন, তারা কেবল ধরাকে সরা জ্ঞান করেন না, তারা এখন খোদার কাছেও খোদায়ী দাবী করেন না, বরং নিজেরাই খোদা হয়ে উঠেন। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। অমর জালীলের গল্পটি পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। খোদাদ্রোহের কারণে তার বিচার দাবি করা হয়েছিল। তবে এ ধরনের কাহিনি নতুন কিছু নয়। বহু বছর আগে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডারিক নিটশে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘ইশ্বর কি মৃত?’ খ্রিস্ট জগতেও এর বিরুদ্ধে আপত্তি উঠেছিল। সঙ্গত কারণেই এসব প্রশ্ন উঠবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বেশি পড়া, বেশি জানা বিরাট এক সমস্যা (নিজেকে পণ্ডিত দাবি করছি না)। বেশি জানলেই মনে হাজারটা প্রশ্ন আসে। মহানবী সা. বলেন, ‘জানার জন্য সুদূর চীনে যাও,” আধুনিক ধর্মতাত্ত্বিকরাই কিছু জেনে বা জানার জন্য প্রশ্ন তোলাকেও ধর্মবিরুদ্ধ বিবেচনা করেন। কিন্তু মূর্খেরা ছাড়া কে তাদের মানে? হীরক রাজার কথাই বোধহয় সত্য: “যে যত বেশি জানে, সে তত কম মানে।”

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *