আগের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি চায় যুক্তরাষ্ট্র

:: ভয়েস অব আমেরিকা ::

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছেন, র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব রয়েছে। তবে, অনেকে এই প্রভাব নিয়ে অতিরঞ্জিত কথাও বলছেন।

তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাব কর্তৃক আগে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি দেখতে চাওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন এমন কিছু না হয় সেজন্য বাহিনীটির সংস্কার চায়। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূত পিটার হাস  দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক, রোহিঙ্গা ইস্যু, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আনিস আহমেদ। 

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বর্ষপূর্তি নিয়ে। রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের, বন্ধুত্বের ৫০তম বর্ষপূর্তির এই সময়ের চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে! গত ৫১ বছরে বাংলাদেশ অসাধারণ সব উন্নতি করেছে।

 একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে কেবল স্বাধীনতার ধারণা নিয়ে পথচলা দেশটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমৎকার উন্নতি করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় দেশটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। উন্নতি করেছে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণেও। আমার কাছে যেটা বিস্ময়কর সেটা হলো, ৯৬% টিকাদানের হার, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।

বিগত ৫০ বছরের এসব সাফল্যের পর এখন সময় সামনের ৫০ বছরটা কেমন যাবে সেটা ঠিক করা। কারণ, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করতে চলেছে এবং দেশটিকে গত ৫০ বছরের তুলনায় ভিন্নধর্মী, নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তবে তিনি মনে করেন, গণতন্ত্রের পথে আরও বেশি অগ্রসর হওয়া, আরও অর্থনৈতিক উদারীকরণসহ যেসব চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে রয়েছে; সেগুলো ইতিমধ্যেই অতিক্রম করে আসা চ্যালেঞ্জগুলোর তুলনায় কিছুই না। 

গত বছর ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ছিল এমন: এটা একদম পরিষ্কার- আমাদের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রয়েছে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার। এই ইস্যুটি (র‍্যাব) নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই কথা বলে আসছি। 

বিচারবহির্ভূত হত্যা একটা ইস্যু। মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোতে র‍্যাব দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি অনেক বছর ধরেই উঠে এসেছে। এসব নিয়ে উদ্বেগের কারণে আমরা ২০১৮ সালে র‍্যাবকে প্রশিক্ষণ প্রদানও বন্ধ করে দিয়েছি। সুতরাং, অবশ্যই র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার একটা প্রভাব তো রয়েছেই। এগুলো অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমি মনে করি, অনেকে এর প্রভাব নিয়ে অতিরঞ্জিত কথা বলছে। আমাদের সম্পর্ক অনেক বিস্তৃত, আমরা অনেক কিছু নিয়ে কাজ করি। সেটা একটা মাত্র ইস্যু। নিরাপত্তা ক্ষেত্রে যেমন আমরা নিরাপত্তা বাহিনীকে নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বাংলাদেশে ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি দেখতে চাই এবং ভবিষ্যতে র‍্যাব যেন এমন কিছু না করে সেজন্য বাহিনীটির সংস্কার চাই। 

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি ক্ষেত্র কী এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়ানোর জায়গাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, গত তিন মাসের দিকে তাকালে চমৎকার সব কার্যক্রম দেখতে পাবেন। এই তিন মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হয়েছে যাতে অংশ নিতে আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বাংলাদেশে এসেছিলেন, ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নিরাপত্তা সংলাপ হয়েছে, হনুলুলুতে মিলিটারি পার্টনারশিপ ডায়ালগ হয়েছে এবং অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটনে দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপ হয় যাতে অংশ নিতে (প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা) সালমান এফ রহমান যুক্তরাষ্ট্র এসেছিলেন। সুতরাং, ওই চার ক্ষেত্রে আমরা কতোটা নিবিড়ভাবে, কতোটা একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করছি বুঝাই যাচ্ছে। 

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করে রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, রোহিঙ্গারা যখন বার্মাতে (মিয়ানমারে) গণহত্যার শিকার হচ্ছিল, তখন অন্য কোনো দেশ নয়, বাংলাদেশই তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ বা বিশ্বের কেউই তখন প্রত্যাশা করেনি যে, তারা ৫ বছর ধরে (এখন পর্যন্ত) এখানেই থাকবে। প্রথমত, তারা যেন নিরাপদে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে (যেমনটি তারা চায়) সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ তারা নিজ দেশের বাইরে অবস্থান করছে ততক্ষণ তাদের জীবিকা, শিক্ষা এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এসব নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, যাতে তারা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকতে পারে, বেঁচে থাকতে পারে। 

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত জানান, এটা কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের নয়, সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। আসিয়ানও এক্ষেত্রে চাপ প্র‍য়োগ করতে পারে। গণহত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও এক্ষেত্রে সকলের দায়িত্ব রয়েছে। 

সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ মুক্ত গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। উপস্থাপকের এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে মার্কিন দূত বলেন, কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হলো মুক্ত গণমাধ্যম। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কারণে এটা বাংলাদেশে চাপের মধ্যে রয়েছে। এই আইনের কিছু প্রস্তাবিত ‘রেগুলেশন’ বরং সাংবাদিকদের জন্য কাজ করাটাকে আরও কঠিন ও ভয়ঙ্কর করে তুলবে। সমাজ স্বাধীন ও মুক্ত হয় না যদি গণমাধ্যমকে তার প্রশ্ন করতে দেয়া না হয়, সে তার মত প্রকাশ করতে না পারে, সরকারের সমালোচনা না করতে পারে (বলছি না যে দায়মুক্তি দিয়ে)। সরকারের কোনো ভুল দেখলে তার সমালোচনা করার যেন তাদের সম্পূর্ণ অধিকার থাকে। আমি মনে করি, নির্বাচনের সময় এ বিষয়টি অত্যন্ত মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সক্রিয় গণমাধ্যম ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে আপনার দীর্ঘ অবস্থানের কারণে আপনি অবগত যে, এখানকারও অনেক মানুষ, অনেক রাজনীতিবিদ গণমাধ্যমকে পছন্দ করেন না কারণ গণমাধ্যম তাদের ঘাম ছুটিয়ে দেয়। 

বাংলাদেশে অবস্থানকালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ চমৎকার একটা জায়গা। এ দেশের মানুষ খুব বেশি আন্তরিক। আমি যেহেতু অল্প কিছুদিন হলো এখানে এসেছি, তাই চাইলেও বেশি জায়গায় যেতে পারিনি। শুধু কক্সবাজারেই গিয়েছিলাম। জুলাইতে রাজশাহী ভ্রমণের মাধ্যমে শুরু করবো। আম খেতে যাবো। আগস্টে ইকো টুরিজম প্রজেক্টে সুন্দরবন যাবো। তারপর সেপ্টেম্বরে আবারো কক্সবাজার। নভেম্বরে যাবো চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে। আমি অবশ্যই মিষ্টি দই চেখে দেখবো, (হেসে) প্রত্যেক জায়গার কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে দেখবো যে আসলেই কোনটা সুস্বাদু। 

পিটার হাস মনে করেন, সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আসলে তেমন কিছুই নয়। তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যবসায়িক সম্পর্ক, শিক্ষার সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি বলেন, এ বছর ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলকে বাংলাদেশে আসতে দেখে খুবই ভালো লেগেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দ্রুততম হারে বাড়ছে দেখে আমি উদ্বেলিত হই। যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাংলাদেশে ফিরে আসা বাংলাদেশি আমেরিকানদের সাফল্য আমাকে আনন্দিত করে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে যেভাবে এগিয়ে নিতে চায় আমরাও ঠিক সেভাবেই এগিয়ে যেতে চাই।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *