ডিসেম্বরে ৫১৭ সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত ৫১২

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

বিদায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে ৫১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫১২ জন। আহত হয়েছেন ৭৯৩ জন। দুর্ঘটনায় ৫৯ নারী ও ৬৪ শিশুর প্রাণ ঝরেছে সড়কে।

২১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০১ জন। দুর্ঘটনার হার ৪১ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২০১ জন, যা মোট নিহতের ৩৯.২৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১.১৯ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১১৪ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২২.২৬ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৬ জন, অর্থাৎ ১০.৯৩ শতাংশ।

এই সময়ে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত, ১৪ জন আহত এবং ১১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ট্রলার ডুবে ৩৩টি গরুর মৃত্যু ঘটেছে। ২৬টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্টনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র

দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২০১ জন (৩৯.২৫%), বাস যাত্রী ৯ জন (১.৭৫%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ড্রামট্রাক-রোলার মেশিন গাড়ি আরোহী ২৬ জন (৫.০৭%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-পাজেরো জীপ আরোহী ১৫ জন (২.৯২%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১০১ জন (১৯.৭২%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্র-পাখিভ্যান-টাফি গাড়ি) ৩০ জন (৫.৮৫%) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশা ভ্যান আরোহী ১৬ জন (৩.১২%) নিহত হয়েছে।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৬২টি (৩১.৩৩%) জাতীয় মহাসড়কে, ২৩৮টি (৪৬.০৩%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৭টি (১৪.৮৯%) গ্রামীণ সড়কে, ৩৭টি (৭.১৫%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৩টি (০.৫৮%) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন

দুর্ঘটনাসমূহের ১১৬টি (২২.৪৩%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৩৭টি (৪৫.৮৪%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১১১টি (২১.৪৭%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৪২টি (৮.১২%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১টি (২.১২%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনসমূহ

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রামট্রাক-পুলিশভ্যন-এক্সাভেটর-ডাম্পার ট্রাক-রোলার মেশিন গাড়ি ২৬.২৫%, যাত্রীবাহী বাস ১০.০৭%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার ল্যণ্ডক্রুজার জীপ ৪.০৭%, মোটরসাইকেল ২৬%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু-হিউম্যান হলার-ট্যাক্সি) ২১.১০%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-টমটম-মাহিন্দ্র-চান্দের গাড়ি-পাখিভ্যান-টাফি গাড়ি-পাগলু-পাওয়ারটিলার) ৭.০৭%, বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ২.৫১% এবং অজ্ঞাত গাড়ি ২.৮৭%।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৮৩৪টি। (বাস ৮৪, ট্রাক ১২১,কাভার্ডভ্যান ১৯, পিকআপ ২৮, ট্রাক্টর ১১, ট্রলি ৯, লরি ১৪, ড্রামট্রাক ১২, পুলিশভ্যান ১, এক্সাভেটর ১, ডাম্পার ট্রাক ২, রোলার মেশিন গাড়ি ১, মাইক্রোবাস ১৬, প্রাইভেটকার ১৭, ল্যাণ্ডক্রুজার জীপ ১, মোটরসাইকেল ২১৭, থ্রি-হুইলার ১৭৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু-হিউম্যান হলার-বেশি ট্যাক্সি), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৫৯ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-টমটম-মাহিন্দ্র-চান্দের গাড়ি-পাখিভ্যান-টাফি গাড়ি-পাগলু-পাওয়ারটিলার) বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ২১ এবং অজ্ঞাত গাড়ি ২৪ টি।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ২.২২%, সকালে ৩০.৩৬%, দুপুরে ১৬.৬৩%, বিকালে ১৯.৭২%, সন্ধ্যায় ৯.২৮% এবং রাতে ১৮.৭৬%।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৩.৭৯%, প্রাণহানি ২৩.০৪%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩.১৫%, প্রাণহানি ১২.৮৯%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬.৪৪%, প্রাণহানি ১৬.৯৯%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২.৩৭%, প্রাণহানি ১২.৬৯%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৫৪%, প্রাণহানি ৭.৪২%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৬০%, প্রাণহানি ৫.৮৫%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১১.০২%, প্রাণহানি ১০.১৫% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ১০.০৫%, প্রাণহানি ১০.৯৩% ঘটেছে।

ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১২৩ টি দুর্ঘটনায় ১১৮ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ২৯ টি দুর্ঘটনায় ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি ৪১টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে চাঁদপুর জেলায়। ৩টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

রাজধানী ঢাকায় ২৭ টি দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছে।

নিহতদের পেশাগত পরিচয়

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৪ জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ৮ জন, চিকিৎসক ২ জন, সাংবাদিক ৩ জন, প্রকৌশলী ৩ জন, কৃষিবিদ ১ জন, নির্বাচন কর্মকর্তা ১ জন, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৬ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ৭ জন, মুয়াজ্জিন ৪ জন, ফায়্যার ফাইটার ১ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৪ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ১৯ জন, কাউন্সিলরসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৩ জন, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ১ জন, পোশাক শ্রমিক ৩ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ১ জন, মোটর মেকানিক ১ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৮ জন, দিনমজুর ৫ জন, মানসিক প্রতিবন্ধী ৩ জন এবং বাশেমুপ্রবি ছাত্র ১ জন, তিতুমীর কলেজের ছাত্র ১ জনসহ দেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা-কলেজের ৭১ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ

১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

সুপারিশসমূহ

১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০. “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য

গত নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৭ জন নিহত হয়েছিল। প্রতিদিন নিহত হয়েছিল ১৫.৫৬ জন। ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন নিহত হয়েছে ১৬.৫১ জন। এই হিসাবে ডিসেম্বরে প্রাণহানি বেড়েছে ৬.১০%।দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪১৩ জন, অর্থাৎ ৮০.৬৬%।

অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ যেমন দরকার, তেমনি দরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন। প্রযুক্তির মাধ্যমে যানবাহনের গতি নজরদারি করতে হবে। বেপরোয়া যানবাহন এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।

ইদানিং মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের পেছনে বেপরোয়া যানবাহনের ধাক্কায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যানবাহন দাঁড়ানো নিষিদ্ধ করতে হবে।

ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপসহ পণ্যবাহী ভারী যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তাদের চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ দরকার। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর-যুবক। এরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। মোটরসাইকেল বেপরোয়া চালানোর সাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে জীবনমুখি প্রচারণা চালাতে হবে। একইসাথে গণপরিবহন সহজ, সাশ্রয়ী ও উন্নত করে, যানজট কমিয়ে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *