‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না’

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যতক্ষন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা না হবে ততক্ষন দেশে নির্বাচন হবে না বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন।

শনিবার (১২ নভেম্বর) ফরিদপুর শহরে অদূরে ফরিদপুর বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব এই হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

তিনি বলেন, ‘‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এদেশের মানুষের মনের দাবি। কারণ বিগত দুইটা নির্বাচনে আপনারা মানুষকে প্রবঞ্চনা করে, মিথ্যা কথা বলে, আপনারা ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা করে ক্ষমতায় চলে গেছেন। কিন্তু এবার আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি, মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবার কোনো নির্বাচন এদেশে হবে না যতক্ষন না নিরপেক্ষ সরকার করা হবে। এটা আমাদের খুব স্পষ্ট কথা। আমি ক্ষমতা ছাড়বো না। তোমরা যে যাই বলো ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই-এটা আর হবে না। এটা আর হবে না।”

দলের দাবি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আমরা চাই, এই মুহুর্তে শেখ হাসিনার পদত্যাগ। পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যসে জনগনের প্রতিনিধির একটা পার্লামেন্ট তৈরি করবে। সেই পার্লামেন্ট যারা আসবে তারা একটা সরকার গঠন করবে। আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন, নির্বাচন জয়ী হলে যারা অংশগ্রহন করেছেন তাদের নিয়ে আমরা একটা জাতীয় সরকার গঠন করব। সেই জাতীয় সরকার গঠন করে আমরা রাষ্ট্রের মেরামতের কাজ করবো। আমরা নতুন করে বিচার বিভাগকে সাজাতে চাই ন্যায় বিচারের স্বার্থে, আমরা নতুন করে প্রশাসনকে সাজাতে চাই সুশাসনের স্বার্থে, আমরা দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই।”

বক্তব্যের শুরুতে মির্জা ফখরুল ফরিদপুরের প্রয়াত রাজনীতিক মোহন মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান, ওবায়দুর রহমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ই্উসুফের নাম উল্লেখ করেন তাদের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বেলা আড়াইটায় সমাবেশের প্রধান অতিথি ও অন্যান্য অতিথিবৃন্ধ মঞ্চে আসলেও মূলত নেতাদের বক্তব্য দেয়া শুরু হয় বেলা ১১ টা থেকেই। এর আগেই সমাবেশের মাঠ কানায় কানায় ভরে উঠে।

ফরিদপুরের ৯ টি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হয় নেতাকর্মীরা। এসময় নেতাকর্মীরা রং বেরঙের টিশার্ট-ক্যাপ পরিধান, নেতাদের ছবি সম্বলিত প্লাকার্ড-ফেস্টুন বহন করে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব ওই যে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে একটা মহাসমাবেশ করছে না যুব লীগের নামে। ওইখানে উনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ নাকি সংগ্রাম করছে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার জন্য। এই কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। আর বলবে ভূতে মুখে রাম রাম। যারা গণতন্ত্রকে ধবংস করে দিলো, যারা গণতন্ত্রকে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো, যাদের গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে যে, কোনো মানুষ ভোট দিতে পারবে না। জোর করে ভোট দেবে।তাদের গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে গুম করা, খুন করা, হত্যা করা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া। তারা বলে তারা নাকী গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেবে।”

তিনি বলেন, ‘‘আপনি দয়া করে বলবেন, আপনার কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা কি, ডেফিনেশনটা কি? সেটা কি এই কথা যে, এটা- অন্য কোনো দলকে আামি কোনো কিছু করতে দেবো না।হায়রে আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রের আওয়ামী লীগ। আজকে ফরিদপুরের এই জনসমাবেশকে পন্ড করার জন্য, নতসাত করার জন্য তিনদিন আগে থেকে তাদের আজ্ঞাবহ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিক ইউনিয়ন দিয়ে পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে।পথে পথে সিকিউরিটি চেক বসিয়েছে। আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা আটকায়। জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাবেন। বলে যাওয়া যাবে না, রাস্তা বন্ধ আছে। বরিশালে আরো খারাপ কাজ করেছে। বরিশালে ট্রলারে করে মানুষজন যখন আসছিলো, সেই ট্রলার ফেলে দিয়ে লোকজনকে নদীতে ফেলে পিটিয়েছে। বাস থেকে নামিয়ে মেরেছে, ময়মনসিংহে একইভাবে গোলাগুলি করেছে। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগে গণতন্ত্র।”

ফখরুল বলেন, ‘‘এতো ভয় কেনো? জনগন থেকে তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছো। জনগনের সাথে তোমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। আজকে এদেশে আলেম-ওলামাদের পর্যন্ত তোমরা হয়রানি করছো। তোমরা তাদেরকে মিথ্যা মামলায় আসামী করে তাদেরকে জেলে পাঠাচ্ছো এবং তাদেরকে কোনো জামিনও দিচ্ছো না। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যিনি গণতন্ত্রের মাতা, তার ৯ বছর দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে সেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গণতন্ত্রের চারণ কবির মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন সেই নেত্রীকে তুমি মিথ্যা মামলা দিয়ে আজকে চার বছর ধরে বন্দি করে রেখেছো। অসুস্থ মানুষ, চিকিতসার জন্য বাইরে যেতে দাও না। ভয় কেনো? ভয় এজন্য যে, বেগম জিয়া তো হ্যামিলনের বংশীবাদক। উনি বেরুলে সেই বাঁশী যদি বাজাতে শুরু করেন তাহলে দেশের মানুষ সেই একাধারে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। ওই ভয়ে তোমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন পর্যন্ত দাও না যেটা উনার প্রাপ্য।”

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘আজকে তোমরা ক্যাসিনো সম্রাটকে জামিন দিয়ে মুক্ত করে দাও। সে এখন যুবলীগের মহাসমাবেশে সামনের সারিতে শেখ হাসিনার সা্থে বসে থাকে। কি দেশ আমাদের? যারা লুট করে, যারা মাফিয়া হিসেবে কাজ করে, যারা এদেশের সব কিছু ধবংস করে দেয়, তাদের জামিন হয়, তারা মুক্তি পায়। অথচ গণতন্ত্রের জন্য যিনি ৯ বছর সংগ্রাম করলেন এবং যিনি জীবনের ৩৫টি বছর গণতন্ত্রের জন্য কাজ করেছেন তাকে তোমরা আটকিয়ে রেখে দাও। আমাদের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে কতগুলো মিথ্যা মামলায় সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে সাজা দিয়ে বসে আছে। আরে ওই সাজা কি টিকবে? টিকে কখনো।মিথ্যা মামলায় সাজা টিকে কখনো। কেউ কাউকে আটকিয়ে রাখতে পেরেছে। তাদের তো নিজের ইতিহাসটা ভালো করে পড়া উচিত। এভাবে কাউকে আটকিয়ে রাখা যায় না। আর জোর করে, জবরদস্তি করে কোনো দিন মানুষের ন্যায়ের সংগ্রামকে বন্ধ করে রাখা যায় না। ফেরাউন পারিনি, নমরুদ পারেনি, হিটলার পারেনি, মুসলিন পারেনি।আমাদের দেশে আইয়ুব খানও পারিনি। আপনারাও কিন্তু পারেন নাই। ভুলে যান কেনো? একনায়কতন্ত্র করে, কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়ে, জোর করে, মানুষকে গুম করে, খুন করে আপনারা কেউ রেহাই পাবেন না।

সরকার আবারো অতীতের মতো মিথ্যা মামলা দায়ের কৌশল নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

‘‘এখন শুরু করেছে নতুন কায়দা। সেই কায়দা কি? মামলা শুরু করেছে। গত কয়েকদিন আগে নরসিংদীতে দেখলাম- একজন আওয়ামী লীগের লোককে ধরেছে। তার বাড়িতে দেশী বোমা ও বারুদ পেয়েছে।ওকে ধরেছে। আর মামলা দিয়েছে আমাদের যুব দলের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারিসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে। এটা নতুন কৌশল।”

তোমাদের মনে থাকা উচিত যে, লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে মেরে তার ওপর তোমরা নেচে নেচে ১/১১ আনার ষড়যন্ত্রটা করেছিলে। আজকে আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, সংবিধানের কথা বলেন। এই সংবিধানকে তো শেষ করেছেন আপনারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা হয়েছিলো আপনাদের দাবি। আপনারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন। তখন জাতীয় পার্টি-জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করে এমন অবস্থা তৈরি করলেন এক অচালাবস্থা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, জনগন এটা চায়।তখন তিনি পার্লামেন্ট ইলেকশন করে নতুন পার্লামেন্টে এক রাতে আমি সেই পার্লামেন্টের সদস্য ছিলাম এক রাত্রে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটা পাস করেছি।

রাজবাড়ী মহিলা দলের নেত্রী সোনিয়া আখতার স্মৃতিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ তার অপরাধ কী? তিনি একটা পোস্টে শেয়ার করেছিলেন। রাত্রি ২টার সময়ে তার দুই ছোট ছোট বাচ্চা আছে, তাদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। সে নাকী প্রধানমন্ত্রীকে কটু বাক্য বলেছেন। সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এই যারা রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান থাকেন তাদের বিরুদ্ধে কার্টুন আঁকা হয়, তাদের বিরুদ্ধে নাটক হয়,তাদের বিরুদ্ধে অনেকে অনেক কথা বলে।সেখানে তাকে গ্রেফতার করা হয় না, তাকে শাস্তি দেয়া হয় না। ও্ইটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের বিউটি, এটাই সহশীলতা। এদেশে সহনশীলতা নাই। ওরা মনে করে দেশটা তাদের বাপের দেশ, তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এখানে সাধারণ মানুষ আমরা সব চাকর-বাকর, ক্রীতদাস আর কি। আমাদেরকে যেমন খুশি ব্যবহার করা যাবে। আপনাদের কথাটা ভালো লাগবে না। সেটাই আপনারা করতে চাচ্ছেন। আপনারা যে ভাষায় কথা বলেন এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়, আপনারা যেভাষায় কথা বলেন, এটা সহনশীলতার ভাষা নয়। এটা দেশকে তৈরি করবার ভাষা নয়।”

আবার বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে উল্লেখ মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আপনারা শুরু করছেন, হত্যা করছেন। আমরা আর অন্যায় অত্যাচার সহ্য করব না। আমরা রুখে দাঁড়াব। তরুনদের জেগে উঠতে হবে, সব মানুষকে জেগে উঠতে হবে, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে….। আমাদের একদফা এক দাবি এই সরকারের পদত্যাগ।। এই ফয়সালা হবে রাজপথে।”

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘খাজানজিখানায় তো টাকা নাই। টাকা শেষ। এজন্য বলছেন যে, আর বাড়ানো হবে না ওই দুঃস্থ মহিলাদের তালিকা। কোথাও তাদের টাকা নাই। রিজার্ভে টাকা নেই। সব খেয়ে ফেলেছে। বড় বড় গলায় বলছে, একজন বললেন, আমরা কি টাকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছি। আমরা বললাম যে, আপনারা টাকা চিবিয়ে খাননি।আপনারা রিজার্ভের টাকা গিলে খেয়ে ফেলেছেন।

এই সরকার এমন একটা খাত বাকি রাখে নাই যেখানে তারা চুরি করে নাই, দুর্নীতি করে নাই। আজকে চতুর্দিকে দুর্নীতি। আপনি যেখানে তাকাবেন, সেখানে দুর্নীতি। কোনো কাজ করতে পারবেন না ঘুষ না দিয়ে,কোনো কাজ হবে না টাকা না দিয়ে, কমিশন না দিয়ে কোনো কাজ হবে না।

কারা মধ্য আয়ের দেশে গেছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘‘সেই সমস্ত লোকের আয় বেড়েছে যারা চুরি করছে, দুর্নীতি করছে, সরকারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আজকে বড় বড় সাহেবরা.. আজকে দেখেন আমাদের মানুষের কত কষ্ট। চালের দাম কমেছে না বেড়েছে? বলেছিলো না ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে। খাইয়েছে ১০ টাকা কেজি চাল? আমার ছেলেদেরকে বিনা পয়সায় চাকুরি দেবে বলেছিলো না। চাকুরি দিয়েছে, ঘরে ঘরে চাকুরি হয়েছে, কৃষকরা কি বিনা সার পেয়েছে? পায় নাই ….।”

ফরিদপুর মহানগর আহ্বায়ক এএফএম কাইয়ুম জঙ্গীর সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজের, একেএম কিবরিয়া স্বপনের সঞ্চালনায় এই সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসুর মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা শাহজাহান ওমর, এজেডএম জাহিদ হোসেন, জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া, শাহ আবু জাফর, মজিবুর রহমান সারোয়ার, মাহবুবউদ্দিন খোকন, শ্যামা ওবায়েদ, অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া সেলিমুজ্জামান সেলিম, খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুক, নায়েবা ইউসুফ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাক্তার রফিকুল ইসলাম, জাসাস সভাপতি হেলাল খান, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, যুব দলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কৃষক দলের শহিদুল ইসলাম বাবুল, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসকে জিলানি, ছাত্র দলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবন, সাইফুল ইসলাম পটু, মোদারেছ আলী ইছা, একে কিবরিয়া স্বপন, বি সিদ্দিকী মিতুল প্রমুখ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *