ধনী ও অভিজাত শ্রেণি সবসময় গণতন্ত্রের বিপক্ষে

:: হাবিবুর রহমান ::

সরকারি হিসাব মতে ১৯,৫০৪ ভোট পেয়েছেন হিরো আলম। হিরো আলমের প্রার্থীতাই অনেকে মানতে পারছেন না। এই প্রসঙ্গে গ্রিক দার্শনিক জেনোফোন এর দুটি কথা পুনরায় ব্যক্ত করছি।

পৃথিবীতে আধুনিক গণতন্ত্রের চর্চা প্রথম শুরু হয়েছে গ্রীসের এথেন্সে। এথেন্সের মানুষ গণতন্ত্রকে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছিল। কেন এবং কীভাবে এথেন্সের গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে ? কারা করেছে ?

এই বিষয়ের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন দার্শনিক জেনোফোন (Xenophon); তিনি নিজে এথেন্সের একজন মিলিটারি জেনারেল ছিলেন। কিন্তু তার প্রজ্ঞার কারণে দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

জেনোফোন প্রথমেই একটা বিষয়ের উপরে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে যারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এলিট তারা সবসময় গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কয়েকজন অভিজাতদের শাসন এলিটদের খুব পছন্দ। এলিট অথবা এলিট হওয়ার দৌঁড়ে যারা এগিয়ে আছেন তাদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র একটি অত্যন্ত খারাপ শাসনব্যবস্থা।

অভিজাতদের হাতে যখন পলিসি মেকিং পাওয়ার থাকে তখন তারা নিজেদের স্বার্থে পলিসি তৈরি করে। দেশের কথা চিন্তা করে না। জেনোফোন দেখেছেন, গণতন্ত্রও দেশের কথা চিন্তা করে না। এখানে গরীব মানুষ তাদের স্বার্থে পলিসি তৈরি করে। গরীব মানুষ যেহেতু দাস হতে চায় না তাই তারা নিজেদের হাতে ক্ষমতা রেখে অভিজাতদের চাপে রাখে। তাই জেনোফোন বলেছেন, গণতন্ত্র মানে হচ্ছে অভিজাতশ্রেণীর উপরে নিম্নবিত্তদের নিয়ন্ত্রণ।

জেনোফোন খেয়াল করেছেন, এথেন্সের গরীব মানুষ গণতন্ত্রের পক্ষে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, গরীব মানুষ স্রেফ নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গণতন্ত্র সমর্থন করে। যারাই শাসনক্ষমতা পাবে তারাই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন তৈরি করবে। তাই এথেন্সের গরীব মানুষ ভেবে দেখল অভিজাতদের হাতে শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিলে তারা গরীব মানুষকে নিজেদের দাস বানিয়ে রাখবে। সেই দাস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখা। গরীব মানুষ যখন দেখল তারা সম্পত্তি, শিক্ষা, কালচার সবদিক থেকে ইনফেরিয়র কিন্তু সংখ্যায় বেশি, তখন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন এর ফর্মুলা সামনে এনেছে। নাম দিয়েছে democracy। ডেমোক্রেসি শব্দটি এসেছে demos থেকে। demos শব্দের অর্থ : গরীব, নিম্নবিত্ত মানুষ বা সাধারণ মানুষ।

অভিজাতদের হাতে যখন পলিসি মেকিং পাওয়ার থাকে তখন তারা নিজেদের স্বার্থে পলিসি তৈরি করে। দেশের কথা চিন্তা করে না। জেনোফোন দেখেছেন, গণতন্ত্রও দেশের কথা চিন্তা করে না। এখানে গরীব মানুষ তাদের স্বার্থে পলিসি তৈরি করে। গরীব মানুষ যেহেতু দাস হতে চায় না তাই তারা নিজেদের হাতে ক্ষমতা রেখে অভিজাতদের চাপে রাখে। তাই জেনোফোন বলেছেন, গণতন্ত্র মানে হচ্ছে অভিজাতশ্রেণীর উপরে নিম্নবিত্তদের নিয়ন্ত্রণ।

অভিজাতদের দৃষ্টিতে দেখলে গণতন্ত্র হচ্ছে আইনসভায় কিছু অশিক্ষিত, আনকালচারড মানুষের হট্টগোল। কিন্তু জেনোফোনের ব্যাখ্যা হচ্ছে গরীব মানুষ যখন আইনসভায় যায় তারা এরকম উচ্ছৃঙ্খলতা বা হট্টগোল করে না। তাদের পলিসি মেকিংও সুচিন্তিত এবং পরিকল্পিত। কিন্তু এখানে দেশের উন্নতি বা ন্যায্যতা বিবেচনা করে তারা পলিসি তৈরি করে না। তারা পলিসি তৈরি করে নিম্নবিত্তদের স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করে। জেনোফোন এই বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। এলিট দৃষ্টিতে দেখলে কিছু পলিসির ব্যাখ্যা বোঝা কঠিন। কিন্তু গরীবদের স্বার্থের কথা চিন্তা করলে এর কারণ বোঝা সহজ।

যেমন, এথেন্সে কোনো দাস বা অভিবাসী শ্রমিকদেরকে তার মনিব বা অন্য কেউ শারিরীকভাবে আঘাত করতে পারত না। আইনে নিষিদ্ধ ছিল। এই আইনটি দেখে মনে হয় আধুনিক যুগের হিউম্যান রাইটস এর ধারণা থেকে এই আইনের উৎপত্তি। কিন্তু আইনটি এমন হওয়ার কারণ সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক এবং শ্রেণি স্বার্থ কেন্দ্রিক। এথেন্সের সাধারণ মানুষ বা ডেমোসরা ছিল নিতান্ত গরীব। তাদের চেহারা সুরত আর জামাকাপড় অভিবাসী শ্রমিক এবং দাসদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তাই শ্রমিক বা দাস মনে করে কেউ এথেন্সের নাগরিকদের গায়েও হাত তুলতে পারে এই আশঙ্কা থেকে এই আইনটি করা হয়েছে।

এথেন্সে দাস এবং অভিবাসী শ্রমিকদের ইকোয়াল স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। দাসদের নিজস্ব সম্পত্তির মালিকানার অধিকারও দেয়া হয়। এর কারণও অর্থনৈতিক অর্থাৎ এথেন্সের গরীবদের স্বার্থরক্ষা। এথেন্সের সাধারণ মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। তাদের অর্থনীতির উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত পুঁজি ছিল না। এই অবস্থায় দাসদেরকে অধিকার দিলে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অধিক পরিশ্রম করবে। অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ দিলে তাদের ইনকাম থেকে ট্যাক্স আদায় করা যাবে।

এই অর্থনৈতিক কারণেই এথেন্সের গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ জিমন্যাস্টিকস, নৌকাবাইচ এবং গান বাজনা প্রমোট করেছে। এর উদ্দেশ্য ছিল সম্পদের পুনর্বণ্টন। ধনী মানুষরা এসবে অভ্যস্ত হলে গরীবের কর্মসংস্থান বাড়বে, জীবনযাত্রা উন্নত হবে।

জেনোফোন গণতন্ত্রকে নৈতিকতা বা দেশপ্রেমিক শাসন হিসেবে দেখেননি। তার মতে, আইন তৈরির ক্ষমতা যার হাতে থাকবে সে তার নিজের স্বার্থে আইন তৈরি করবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে ক্ষমতা গরীব মানুষের হাতে থাকবে এবং গরীবদের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা পদক্ষেপ নিবে। আর এই কারণে ধনী এবং অভিজাত শ্রেণি সবসময় গণতন্ত্রের বিপক্ষে থাকে।

লেখকঃ শিক্ষানবিস আইনজীবী, হাবিব ল একাডেমীর শিক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *