:: ফারহান আরিফ ::
দুই দিকে বল ঘুরানোর এক অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে ক্রিকেটে রাজত্ব করেছিলেন ইমরান খান। কেবল তাই নয়; দুর্দান্ত হুক, পুলের পসরা সাজিয়ে নান্দনিক ব্যাটিংশৈলির মাধ্যমে বিশ্ব ক্রিকেটে এক অবিসংবাদিত অলরাউন্ডার হিসেবে কিংবদন্তি হয়ে ভক্তকুলের হৃদয়ের মণিকোঠায় ইমরানের অবস্থান। উপমহাদেশের মানুষজন তুলনামূলক বেশি ক্রিকেটপ্রেমী। ইমরান খান এই উন্মাদনার এক অন্যতম মধ্যমণি। তার উপরে ১৯৯২ এর বিশ্বকাপে তার অধিনায়কত্ব পাকিস্তানের একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে তাকে বীরের আসনে সমাসীন রেখেছে। ইমরানের আরেকটি চমৎকৃত দিক হচ্ছে তার স্মার্টনেস। কেবল দেহসৌষ্ঠবেই নন; তিনি চলনে, বলনেও একজন সুপুরুষ। অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট ইমরানের এই দিকটি আবার তার নারী ভক্তের সংখ্যা বাড়িয়েছে প্রচুর। শোনা যায়, একবার সিডনিতে ইমরান তার গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে রেস্টুরেন্টে খেতে ঢুকেছিলেন। খাওয়া শেষে এসে দেখেন, যুবতিরা তার গাড়িটিকে লিপস্টিকের রঙয়ে রঙীন করে রেখেছেন। ইমরান খানের তারকাখ্যাতির ক্রিকেটিয় কারণের বাইরে আরো একটি দিক হচ্ছে, তার ক্যান্সার হসপিটাল প্রতিষ্ঠা। তার প্রতিষ্ঠিত ক্যান্সার হসপিটালটির জন্য তিনি খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই ক্যাম্পেইন করে বেড়িয়েছিলেন। শিক্ষা-দীক্ষা, ক্রিকেটার খ্যাতি, ক্যান্সার হসপিটাল প্রতিষ্ঠা- সবকিছু মিলিয়ে ইমরান খান পাকিস্তানের সাধারণ জনজীবনে তখন একটি শ্রদ্ধা জাগানিয়া নাম। ইমরান নিজেও তার এই জনপ্রিয়তার ব্যাপারে সচেতনভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই কিনা এই প্রতিষ্ঠিত ইমেজটুকুকে ভিত্তি করে রাজনীতিতে জড়ালেন। কিন্তু গোড়ার দিকে রাজনীতির পিচ্ছিল পথে তাকে বারংবার হোঁচট খেতে হয়েছে। তবে ক্যাপ্টেন খান মনোবল হারাননি। একজন পাঠান যেমনটা হয় আর কী!
ক্রিকেট ছাড়ার চার বছর পর ইমরান খান তেহরিক-ই-ইনসাফ গঠন করেন, যা সংক্ষেপে পিটিআই নামে পরিচিত। ২০০২ সালে তিনি তিনি প্রথমবারের মত পাকিস্তানের ন্যশনাল এসেম্বলিতে জায়গা করে নিতে সমর্থ হন। কিন্তু পরের বছরগুলো তার জন্য খুব একটা মসৃণ ছিল না। ২০১১ সালে এসে ইমরান প্রথমবারের মতো পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। ইসলামাবাদে এক লাখ লোকের এক জমায়েতের মাধ্যমে ইমরান পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। খাইবার পাখতুনখাওয়ায় ন্যাটোর সাপ্লায়ার্স বন্ধের দাবিতে ইমরানের ঐ সমাবেশ এবং পরের বছর মার্কিন ড্রোন হামলার প্রতিবাদে লাহোর থেকে ইসলামাবাদে রোড মার্চের মাধ্যমে ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করতে সমর্থ হন। পাকিস্তানের তৎকালীন এস্টাবলিশমেন্টের মার্কিন মিত্রতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি বিশেষ করে রক্ষণশীল অংশটির আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। পাশাপাশি ইমরানের তারকা ক্রেজ তাকে তরুণদের কাছে প্রবল জনপ্রিয় করে তুলতে থাকে। কারণ ঐ সময়ে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের নামে পাকিস্তানে মার্কিন খবরদারির ফলে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিলো। এর একটা বিপরীত কারণও আছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে তালেবান রা পিছু হটে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেয়। এই সময়টাতে পাকিস্তানভিত্তিক তালেবান ও বিশেষ সক্রিয় হতে শুরু করে। তালেবানের মিসরিয় সদস্যরা তথা ইবনে তাইমিয়া, হাসান আল বান্নার ফিলোসফি প্রভাবিত অংশটি তখন একটি নতুন যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। এই অংশটি তাদের সংগ্রামকে উপমহাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই অংশ হিসেবে পাকিস্তানের এক শ্রেণীর দ্বিচারি এস্টাবলিশমেন্ট ও গোয়েন্দা মদদে তালেবান তার শাখা প্রশাখা গড়ে তুলতে শুরু করে। এর ফলে ন্যাটো ও মার্কিনিদের খবরদারিও এই অংশে বেড়ে যায়; আর পাকিস্তান হয়ে পড়ে নতুন ব্যাটলফিল্ড। এই ব্যাটলফিল্ডে প্রায়শই রক্ত ঝড়তে শুরু করলো। একদিকে তালিব এবং অপরদিকে ন্যাটো বাহিনী- এই ব্যাটলে প্রাণ যেতে শুরু করলো হাজার হাজার নিরীহ মানুষের। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকার ফলে পাকিস্তানের তৎকালীন এস্টাবলিস্টমেন্ট এর কোনো সহজ সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলো না। এই সময়ে ইমরান খান ন্যাটো বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে তালেবান খান নামেও পরিচিতি পান। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের আর্থ-রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফলে ইমরান খানের তাতে তেমন কোনো ক্ষতি সাধিত হয়নি। ফলে শক্ত কোনো আইডিওলজিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশন ছাড়াই একটি রাজনৈতিক দলের পপুলিস্ট একটিভিজমের মাধ্যমে ইমরান প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকলেন।
[ক্রমশ]