ফ্যাসিবাদ ও জনতুষ্টিবাদের সাংস্কৃতিক দ্বৈরথঃ সমাধান কোন পথে?

:: ফারহান আরিফ ::

টিএসসিতে ছাত্রলীগের হামলাটা অনিবার্যই ছিল। কারণ ফ্যাসিবাদের ভ্যানগার্ডদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভাল কিছু প্রত্যাশিত ছিল না। গতকালের হামলার মূল হোতার বক্তব্য থেকেও বুঝা যায় যে, কিছু একটা তার স্বার্থানুকূল হয় নি! সাধারণত ফ্যাসিবাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, উন্নয়ন সহ সবকিছুতেই একটা নিজস্ব উগ্র ধরণ থাকে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য খুবই পরিষ্কারঃ জনমতের বিরুদ্ধ কোন কিছুকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া; প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করা। শিল্প, সাহিত্যে তারা তাদের চেয়ে অগ্রগামী ও প্রগতিশীল কোনো কিছুকে সহ্য করতে পারে না। তাদের নাকের ডগায় অন্য কেউ সফল হোক- এটা হজম করা ফ্যাসিবাদের জন্য নিদারুণ অপমানজনক। সবকিছুতেই তাদের অনভিপ্রেত অংশগ্রহণ চাই ই চাই। সুতরাং টিএসসিতে গতকালের ছাত্রলীগের হামলা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, হামলার উপলক্ষ কি হতে পারে?

দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্রলীগের হাতে হামলার মারণাস্ত্র তুলে দিয়েছে এই পুরো আয়োজনের একেবারেই বাহিরের দু’টি গোষ্ঠী। কাওয়ালি সন্ধ্যা আয়োজনের এই উপলক্ষকে ইসলামী তাহজিব-তমদ্দুন সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এই বিতর্কের সূত্রপাত করে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এক নেতা। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে এর জায়েজ-নাজায়েজের ব্যাখ্যা সামনে নিয়ে আসে কওমি ঘরানার আলেমগণ। অথচ এই দু’টি গোষ্ঠীই উক্ত আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত নয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও অংশ নয়। যদিও ঢাবির ইশা ছাত্র আন্দোলন এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে, কিন্তু আদতে তাদেরও এই আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল বলে দেখা যায় নি।

যাই হোক, সুফি ঘরাণার এই সংগীতায়োজনের জায়েজ-নাজায়েজের নানারকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকতে পারে। সে আলোচনায় যাবো না। বরং নজর দেয়া যাক আয়োজক এবং তাদের প্রতিপক্ষের সাংস্কৃতিক দ্বৈরথের প্রতি।

ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু কিংবা জনতুষ্টিবাদের রঙিন দুনিয়া নয়; বরং গণতন্ত্রপ্রত্যাশী বাংলাদেশবাদই হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এ কারণে বাংলাদেশবাদী ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান প্রত্যাশীদের সাবধানে পা ফেলা একান্তই অপরিহার্য। সময়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং।

সাধারণ দৃষ্টিতে এই আয়োজনের রাজনৈতিক তাৎপর্য অনুমান করা দুষ্কর। কোক স্টুডিওর কল্যাণে হোক কিংবা নানা সময়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন আয়োজনের কল্যাণে হোক, বর্তমানকালে সূফী ভাবধারা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণ শ্রোতারা এর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্বন্ধে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়। তাছাড়া দ্রুত পরিবর্তনশীল নাগরিক জীবনে সেই ভাবনার অবকাশই বা কোথায়! তবে এই ভাবধারার সুর, তালে যে অন্তরাত্মার তৃপ্তি সাধিত হয় সেটা অনস্বীকার্য। আর সে কারণেই হয়তো জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন তরুণ সমাজের কাছে এই সুর হয়ে উঠেছে অন্তরের দুশ্চিন্তা রোধের অন্যতম বাহন। যদিও দীর্ঘকাল যাবত নানা গোষ্ঠী নানা আঙ্গিকে সূফিগানের চর্চা করে আসছিলো, সেদিকটায় তেমন খেয়াল ছিল না কারোরই। বিশেষ করে চিশতিয়া, মাইজভাণ্ডারি সিলসিলার সূফিবাদ এবং উল্লেখযোগ্যভাবে কাওয়ালি সংগীতের নিজস্ব চর্চা উল্লেখযোগ্য। যদিও তাদের সূফি দর্শনের কায়দাকানুন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে, তবে তারা এটাকে নিজেদের আদর্শ চর্চার মাধ্যম হিসেবেই নিয়েছে। অন্যদিকে কওমি ঘরানাতেও সূফিবাদের চর্চা রয়েছে। কিন্তু এ অঙ্গনে এটাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি কখনোই। দেওবন্দি ঘরানার এই গোষ্ঠীটি বরং সূফিবাদের নিগূঢ় মর্মার্থকে প্রাত্যহিক ধর্মচর্চার সাথে প্রাসঙ্গিকতার বিচারে চর্চা করে যেতেন। কিন্তু আমাদের দেশের আধুনিক তরুণদের সূফিগান কিংবা কাওয়ালি চর্চার ধারাকে শরৎচন্দ্রের ভাষায় বলা চলে ‘বাঙালীর বিষ।’ মূলতঃ আমরা এটাকে চিত্তবিনোদনের অংশ হিসেবেই নিয়েছি। আবার সংগীতের এ ধারাকে তরুণ সমাজের চিত্তবিনোদনের খোরাক হয়ে উঠার এ সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক চক্র। খুব সূক্ষ্মভাবে তারা এর মাধ্যমে একধরণের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়াস পায়। এটা অবশ্য দূষণীয় নয় মোটেও। কিন্তু কথা থেকে যায়, যদি এটাকে বাংলাদেশের অপরাপর সাংস্কৃতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটা এখনো প্রকট আকারে দৃশ্যমান না হলেও, গতকালের ঘটনার পর এই বিতর্কটা হালে পানি পেয়েছে। আপাত নিরীহ একটা আয়োজনে ফ্যাসিবাদের ভ্যানগার্ড সংগঠন ছাত্রলীগের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের চেষ্টা থেকে হামলার মাধ্যমে এ প্রশ্নগুলো সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে, ঢাবি ছাত্রলীগের এক শীর্ষনেতার বক্তব্যে নিজের অপরাধকে ঢাকতে গিয়ে অস্ংলগ্ন বিভিন্ন কথা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে, এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার নিজস্ব ধরণ তথা উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদ একটা পক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

এবার দেখা যাক, আয়োজকদের এ আয়োজন ঘিরে রাজনৈতিক অভিসন্ধির দিকে। প্রত্যক্ষভাবে আয়োজনটিকে টিএসসি কেন্দ্রিক আর দশটি আয়োজনের মত দেখা গেলেও, আয়োজক মহল যে একটি রাজনৈতিক শক্তি তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এখন যদি বলা হয়- এ আয়োজনের পেছনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, তাহলে সেটা হবে এক ধরণের অপলাপ। রাজনৈতিক দল বা তদীয় ব্যক্তিবিশেষের যে কোন অংশগ্রহণকেই রাজনৈতিক মানদণ্ডে মাপার অবকাশ থাকে। মূলত এটা উক্ত রাজনৈতিক সংগঠনটির জনতুষ্টিবাদি রাজনীতির একটি বহিঃপ্রকাশ। ফলস্বরূপ যদি বিরোধের আয়োজন হয়, তাহলে এখানে ফ্যাসিবাদ বনাম জনতুষ্টিবাদের সাংস্কৃতিক দ্বৈরথ স্পষ্ট হয়ে উঠে। এর এক পাশে রয়েছে উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদ তথা রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতির আগ্রাসী ধারা; আর অন্যদিকে রয়েছে বিশেষায়িত মুসলিম জাতীয়তাবাদ তথা সারমেয়হীন বঙ্গীয় সূফী সংস্করণ।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, একটি কল্যাণমূখী রাষ্ট্রগঠনে রাজনীতির এই দু’টি ধারাই বিপদজনক। ফ্যাসিবাদ ও জনতুষ্টিবাদ প্রকারান্তরে একে অন্যের পরিপূরক। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যয়বিচার’ –এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি গণতন্ত্রকামী শাসনব্যবস্থা ও শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। আর এ লক্ষ্য সাধনে একমাত্র পরিপূরক হতে পারে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। শ্যোভেনিজমকে ত্যায্য করে গড়ে উঠা এই জাতীয়তাবাদী দর্শন বিশ্বাস করে সকল সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও পারস্পরিক আদান-প্রদান। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের বাণীই মূলত এ দর্শনের মূলকথা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডে বিরাজমান প্রতিটি মত, পথ ও দর্শনকে গ্রহণ করার মাধ্যমে একটি বৈচিত্র্যময় এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি বিনির্মাণ ও কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এ দর্শনের প্রকৃত কর্মসূচী। নিকট অতীতে যখন এ ধারার রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশের ক্ষমতায় ছিল, তখন আমরা এই প্রচেষ্টা দেখতে পেয়েছি। উক্ত সময়ে দেশব্যাপী সমানতালেই চর্চিত হয়েছে সর্বশ্রেণীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রান্তিক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগাদা ছিল। এর ফলাফলও ছিল দারুণ। দেশের নানা সংকটে উগ্রবাদীরা বাদে বাকি সবার ঐক্যবদ্ধ সংকট নিরসনের উদ্যোগ আমরা দেখেছি। উগ্র সালাফিজমের তল্পিবাহক জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সকল ধারার নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ ছিল। পরমত সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও দেখা গিয়েছে। আজ যে টিএসসিতে ক্ষমতাসীনের আঘাত প্রদর্শিত হয়েছে, সেই টিএসসিতেই জনপ্রিয় শিল্পী প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরী তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে গানে গানে বক্তব্য দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো আঘাত করা হয় নি।

আলোচনার শেষে এসে বলা চলে, ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু কিংবা জনতুষ্টিবাদের রঙিন দুনিয়া নয়; বরং গণতন্ত্রপ্রত্যাশী বাংলাদেশবাদই হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এ কারণে বাংলাদেশবাদী ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান প্রত্যাশীদের সাবধানে পা ফেলা একান্তই অপরিহার্য। সময়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *