ভালো থাকুক সকল শিক্ষক

:: মুহাম্মদ শামীম ::

শিক্ষক শব্দটি মায়া ছড়ানো, মায়ায় জড়ানো, মমতামাখা এবং শাসনের ছায়ায় মুগ্ধতা ছড়ানো। একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন শিক্ষক। এই সমাজে যাদের পড়ুয়া সন্তান রয়েছে, যাদের ভাই-বোন রয়েছে, কিংবা অন্য কেউ যারা এখনো স্কুল-কলেজগামী তারা সবাই ভালো শিক্ষক খুঁজে বেড়ান। এটা শতভাগ সত্য।

একটি স্কুলে কিংবা কলেজের যতজন শিক্ষক রয়েছে তারা সবাই সমান দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়। বয়স, চাকরির অভিজ্ঞতা এবং নিজেকে নিয়মিত সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি যথেষ্ট সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন। তবেই একজন শিক্ষক নিজেকে বিকশিত করতে পারেন। আর শিক্ষক নিজে বিকশিত হলে সেই আলোয় আলোকিত হবে সারা দেশ। আমরা সবাই এটাই চাই, আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমরা কি শিক্ষকদের কথা আসলেই চিন্তা করি? কেমন আছেন আমাদের শিক্ষকরা?

আপনি ভালো শিক্ষক চাইবেন, ভালো শিক্ষা চাইবেন অথচ তাদেরকে অবহেলা করবেন; এভাবে আসলে হয় না। এশিয়ায় নুন্যতম বেতন-ভাতা পায় বাংলাদেশের শিক্ষকরা। কেমন আছে এমপিওভুক্ত কিংবা নন-এমপিও স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা?

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই গত একযুগে সবচেয়ে বেশি আলোকপাত করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষার উপরে এবং অগ্রগতিও হয়েছে বেশ। শিক্ষক নিয়োগ এখন যে কোন সময়ের তুলনায় ফেয়ার এবং মেধাবী শিক্ষার্থীরা পেশায় আসছেন। তবে তাদের ধরে রাখার জন্য নেই যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান। কারণ এ পেশায় নেই প্রমোশন (যদিও প্রমোশন বিধি হচ্ছে হবে করে দিন যাচ্ছে)। করোনায় কারনেই হোক কিংবা অন্য কোন কারন; প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামক পাবলিক পরীক্ষা থেকে রেহাই পেয়েছে লক্ষ লক্ষ শিশু এবং তাদের পরিবার। লস হয়েছে নোটবই এবং গাইডবই প্রকাশকদের। আরেকটি বিষয় এর মাধ্যমে নীরবে বিদায় নিয়েছে তা হচ্ছে প্রশ্নফাঁস নামক ব্যধি। এজন্য সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এই যে লক্ষ লক্ষ কোমলমতি শিশুদের শিক্ষার জন্য যারা নিজেদেরকে বিলিয়ে দেন সেই মহান প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মানী কত, তাদের পরিবার কিভাবে চলে, তারা যে পরিমান শ্রম দেন সে অনুযায়ী কি তাদের বেতন-ভাতা ঠিক আছে? সে খবর কেউ রাখে না। মনে করিয়ে দেই, এক কেজি চালের দাম নুন্যতম ৬০ টাকা আর এক লিটার তেলের দাম অন্তত ১৮০ টাকা। এবার মিলিয়ে নিন একজন শিক্ষকের পরিবারে ৪-৫ জন সদস্য থাকলে তার বেতন-ভাতায় সংসার চলে কিভাবে!

অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষা যেটি শিশুদের জন্য নিজেকে বিকশিত করার সময় সেখানকার অবস্থা অত্যন্ত করুন। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েগুলোতে পিএসসির মাধ্যমে নন-ক্যাডার শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, মেধাবী শিক্ষক পাচ্ছেন শিক্ষকরা। কিন্তু সমস্যা এক জায়গাতেই পুঞ্জীভূত প্রমোশন নেই, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। অন্য সব মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত যারা আছেন তারা টাইমস্কেল-সিলেকশন গ্রেড পেলেও সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বেসরকারি মাধ্যমিকে যারা কর্মরত তারা কিন্তু ঠিকই টাইমস্কেল পাচ্ছেন৷ সমস্যা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নেই। মাউশির অধীনে সরকারি কলেজ এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েগুলো থাকলেও কলেজ এবং স্কুলের জন্য শিক্ষা জাতীয়করনে রয়েছে আলাদা বিধি। ফলে কলেজগুলোকে সরকারি করা হলেও শিক্ষক এবং স্টাফদেরকে নিয়মিত করা হয় যেদিন সরকারীকরণ হয়েছে সেদিন থেকে। কিন্তু সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে কোন স্কুলকে জাতীয়করণ করা হলে সেই শিক্ষক এবং কর্মচারীগন যেদিন বেসরকারি স্কুলে যোগদান করেছিলেন সেদিন থেকে তাদেরকে জাতীয়করণ করা হয় ফলে নব্য জাতীয়করণকৃত স্কুলের শিক্ষকরা সিনিয়র হয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে মাধ্যমিকে চাপা ক্ষোভ থাকলেও কিছু করার নেই। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেও অন্য পেশায় চলে যান। বিভিন্ন প্রজেক্ট থেকে রাজস্বখাতে লোকবল স্থানান্তরের সবচেয়ে ভালো স্থান হচ্ছে সরকারি মাধ্যমিক। অন্যদিকে বেসরকারি মাধ্যমিকে ম্যানেজিং কমিটির দাপটে শিক্ষকরা নাজেহাল। নীরবে নীভৃতে অপমানিত হতে হতে কতজন যে চোখের পানি ফেলেন সে খবর কে রাখে।

লক্ষ লক্ষ কোমলমতি শিশুদের শিক্ষার জন্য যারা নিজেদেরকে বিলিয়ে দেন সেই মহান প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মানী কত, তাদের পরিবার কিভাবে চলে, তারা যে পরিমান শ্রম দেন সে অনুযায়ী কি তাদের বেতন-ভাতা ঠিক আছে? সে খবর কেউ রাখে না। মনে করিয়ে দেই, এক কেজি চালের দাম নুন্যতম ৬০ টাকা আর এক লিটার তেলের দাম অন্তত ১৮০ টাকা। এবার মিলিয়ে নিন একজন শিক্ষকের পরিবারে ৪-৫ জন সদস্য থাকলে তার বেতন-ভাতায় সংসার চলে কিভাবে!

মাধ্যমিক স্তরের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ এবং শিশুদের বয়সন্ধিকালের সময়টিতে নিজেকে সঠিকভাবে পরচালিত করার জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজন মানসিক কাউন্সেলিং বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেখা গেছে, ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে স্কুলপড়ুয়া ছাত্ররা এবং তাদের চালচলন-কথাবার্তায় আমুল পরিবর্তন। কাউকে পরোয়া করে না তারা। সাথে যোগ হয়েছে মাদকের সীমাহীন বিস্তার। অনেক শিক্ষার্থী নেশা করে ক্লাসে আসে, এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।

সাম্প্রতিক সময়গুলো সরকারি কলেজের বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থী এবং বহিরাগত কর্তৃক হামলায় ঘটনা ঘটছে। সামাজিক অবক্ষয়ের নুন্যতম স্তরকে ছাড়িয়ে ক্রমশ নামছি আমরা।

সবাই কোচিং বন্ধ করতে চায়। কোচিং বন্ধ করাই কি শিক্ষার সমাধান? একটি ক্লাসে ৬০-৭০ জন স্টুডেন্ট এর জন্য একজন শিক্ষক ৪০ মিনিট ক্লাস নেন। কতটুকু শেখাতে পারেন তিনি আর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কি সমান মেধা নিয়ে সমান শিক্ষা নিতে পারেন? কখনোই পারেন না। বহু শিক্ষক আছেন, যারা ফ্রি কোচিং করাতে চাইলেও তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা পড়বেন না। এটাও সত্য সবাই শিক্ষক হয়তো নামে কিন্তু আদর্শ মানদণ্ডে সবাই নয়।

আপনি ভালো শিক্ষক চাইবেন, ভালো শিক্ষা চাইবেন অথচ তাদেরকে অবহেলা করবেন; এভাবে আসলে হয় না। এশিয়ায় নুন্যতম বেতন-ভাতা পায় বাংলাদেশের শিক্ষকরা। কেমন আছে এমপিওভুক্ত কিংবা নন-এমপিও স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা?

তবু চাই শিক্ষকেরা ভালো থাকুক, ভালো শিক্ষা পাক আমাদের সোনামনিরা। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: সাবেক সহকারি শিক্ষক, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *